ফিরোজ মাহবুব কামাল:
কাফেরদের বিজয় নিয়েও উৎসব
আলো ও আঁধার একত্র নাচানাচি করে না। আলোর আগমনে আঁধার বিলুপ্ত হয়। তেমনি মুসলিম ও কাফের কখনোই একত্রে কোন উৎসবে মত্ত হয় না। ইসলামের সমগ্র ইতিহাসে কোন কালেই সেটি হয়নি। কিন্তু বাঙালি মুসলিমগণ এক্ষেত্রে ইতিহাস গড়েছে। তারা শুধু বিশ্বমাঝে দুর্বৃত্তিতে ৫ বার প্রথম হয়েই রেকর্ড গড়েনি, রেকর্ড গড়েছে কাফেরদের সাথে একই বিজয়ের উৎসবে হাজির হয়। সেটি ১৯৭১’য়ে যুদ্ধে। মুসলিম ইতিহাসে বাঙালি মুসলিমগণ কোন আবিষ্কারে নাম না করলেও অন্ততঃ এ কারণে অবশ্যই বেঁচে থাকবে। ১৯৭১’য়ে যুদ্ধে বিজয় ছিল ভারতীয় হিন্দুত্ববাদীদের। সেটি বাঙালি মুসলিমদের বিজয় হয় কি করে? বিজয় কি ভারতীয় রাডারের গোলামী নিয়ে বাঁচায়?
যে কোন যুদ্ধের মূল্যায়নে দেখতে হয়, তাতে ইসলাম ও মুসলিমের কতটুকু লাভ বা ক্ষতি হলো। দেখতে হয়, তাতে শত্রু পক্ষের কতটা লাভ ও ক্ষতি হলো। যে যুদ্ধে ক্ষতি মুসলিমদের এবং লাভ অমুসলিমদের –সে যুদ্ধ হারাম। যে যুদ্ধে ভাঙ্গা হয় একটি মুসলিম দেশ এবং বিজয় ও ইজ্জত বাড়ে পৌত্তলিক কাফের শক্তির –সে যুদ্ধ হারাম। এমন একটি যুদ্ধে শেখ মুজিবের ন্যায় গণতন্ত্রের খুনি, ফ্যাসিবাদের জনক, ইসলামের শত্রু, এবং হিন্দুত্ববাদের প্রমাণিত সেবাদাস জড়িত হবে সেটিই স্বাভাবিক। কিন্তু কোন ঈমানদারেরও কি সেটি নীতি হতে পারে? এটুকু বুঝার জন্য কি আলেম বা আল্লামা হওয়ার প্রয়োজন পড়ে? সে বোধটুকু থাকায় একাত্তরের যুদ্ধে অংশ নিতে কোন ইসলামী দলের নেতাকর্মী এবং কোন হাক্কানী আলেম ও পীর সাহেব ভারতে যাননি। সে ভারতীয় যুদ্ধের পক্ষেও দাঁড়াননি। একাজ ছিল ইসলামে অঙ্গীকারশূণ্য সেক্যুলারিস্ট, ন্যাশনালিস্ট, কম্যুনিস্ট ও হিন্দুদের কাজ। আজও এরাই বাংলাদেশের বুকে ভারতীয় স্বার্থের চৌকিদার।
প্রশ্ন হলো, একাত্তরের যুদ্ধ নিয়ে একটি নিরপেক্ষ ও নির্মোহ বিশ্লেষণ কি আদৌ হয়েছে? আজ অবধি ১৯৭১’য়ের যুদ্ধ নিয়ে যত বই লেখা হয়েছে এবং যত বিশ্লেষন হয়েছে -তা হয়েছে ইসলামে অঙ্গীকারশূণ্য সেক্যুলারিস্ট, ন্যাশনালিস্ট, কম্যুনিস্ট ও হিন্দুত্ববাদীদের পক্ষ থেকে। একটি মুসলিম দেশের প্রেক্ষপটে সে বিচারটি হতে হবে ইসলামী দৃষ্টিকোন থেকে। কারণ, মুসলিমের বিচারের মানদন্ডটিও হালাল হতে হয়। সেক্যুলারিজম, জাতীয়তাবাদ, কম্যুনিজম, হিন্দুত্ববাদ –এগুলি হলো হারাম মতবাদ। কোন মুসলিমের কাছে এগুলির কোন গ্রহণযোগ্যতা নাই। বিচারের মানদনন্ড বা দৃষ্টিকোন পাল্টে গেলে বিচারও পাল্টে যায়। সেক্যুলার ও জাতীয়তাবাদী চেতনায় একটি গ্রহণযোগ্য হালাল মূল্যায়ন অসম্ভব। কারণ সেক্যুলার ও জাতীয়তাবাদী চেতনায় থাকে ইসলামী মূল্যবোধের বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট বিদ্রোহ ও পক্ষপাতিত্ব। সেক্যুলার চেতনায় ব্যভিচারও প্রেম রূপে প্রশংসিত হয়। বেশ্যাবৃত্তিও তখন বৈধ পেশা রূপে স্বীকৃতি পায়।
অপরদিকে জাতীয়তাবাদী চেতনায় মানুষ নৃশংস অপরাধীতে পরিণত হয়। তখন অবাঙালিদেরকে ঘৃণা করা, হত্যা করা, তাদের নারীদের ধর্ষণ করা এবং তাদের গৃহ ও দোকানপাট দখল করা জায়েজ গণ্য হয়। বাংলাদেশে সে জাতীয়তাবাদী বিচারের শিকার ৬ লাখের বেশী বিহারী। এজন্যই জাতীয়তাবাদী এবং গোত্রবাদী হওয়া ইসলামে ফৌজদারী অপরাধ। নবীজী (সা:) ও সাহাবায়ে কেরামের যুগে এ অপরাধে অপরাধীদের পিঠে প্রকাশ্যে চাবুক মারা হতো। নবীজী (সা:) এমন গোত্রবাদীদের নিজের উম্মত রূপে গ্রহণ করতে রাজী নন। নবীজী (সা:)’র সহিহ হাদীস: “যারা গোত্রের জন্য যুদ্ধ করে -তারা আমার উম্মত নয়। যারা গোত্রের জন্য মারা যায় -তারাও আমার উম্মত নয়। (সূত্র: মুসনাদে আহমেদ)। ইমাম আল্লামা সূয়ুতীর মতে হাদীসটি সহিহ।
উল্লেখ্য যে, জাতীয়তাবাদ, বর্ণবাদ ও গোত্রবাদ সমগোত্রীয় মতবাদ (ideological cousins)। এ মতবাদগুলির জন্ম সেক্যুলারিজম তথা পার্থিব স্বার্থ চেতনা থেকে। এগুলির মাঝে মহান আল্লাহতায়ালার ভয় ও আখেরাতের ভয় নাই। সৃষ্টি করে না নবীজী (সা:)’র উম্মত হওয়ার আগ্রহ। শেখ মুজিব ও তাঁর জাতীয়তাবাদী অনুসারীদের গুরুতর অপরাধটি হলো, বিপুল সংখ্যক বাঙালি জনগণকে জাতীয়তাবাদী মতবাদে দীক্ষা দিয়ে তাদেরকে নবীজী (সা:)’র উম্মত হওয়ার অযোগ্য করেছে। এবং বন্ধু এবং সেবাদাস করেছে ভারতীয় হিন্দুত্ববাদীদের। বিদেশী শক্তির এই সেবাদাসগণই আবরার ফাহাদের ন্যায় নিরীহ দেশপ্রেমিক ছাত্রকে পিটিয়ে হত্যা করে। এসব খুনিগণ কোন ডাকাতপাড়ায় বা বন-জঙ্গলে বেড়ে উঠেনি; বরং বেড়ে উঠেছে বাঙালি জাতীয়তাবাদী শিবিরের প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে। নবীজী (সা:)’র সূন্নত শুধু মুখে দাড়ি, মাথায় টুপি এবং গায়ে সূন্নতী লেবাস নয়। বরং নবীজী (সা:) যেমন ভাষা, বর্ণ, ভৌগলিক পরিচয়ের উর্দ্ধে উঠে আরব, কুর্দি, ইরানী, হাবসীদের নিয়ে উম্মতে ওহাদা গড়েছেন সে সূন্নতটিও গ্রহণ করতে হয়। এবং সূন্নতের অবাধ্য হওয়ার অর্থ মহান আল্লাহতায়ালার অবাধ্য হওয়া – যা ঘোষিত হয়েছে সুরা নিসার ৮০ নম্বর আয়াতে। কিন্তু বাঙালি জাতীয়তাবাদীদের জীবনে সে সূন্নত দেখা যায় না। তারা বরং ভাষা ও ভৌগলিক পরিচয়ের ভিত্তিতে মুসলিমদের মাঝে বিভক্তি গড়েছেন। তাদের বিদ্রোহটি তাই নবীজী (সা:)’র সূন্নতের বিরুদ্ধে। প্রশ্ন হলো, যারা নবীজী (সা:)’র সূন্নতের বিরোধী -তারা কি তাঁর উম্মত হতে পারে? তারা কি আখেরাতে তাঁর শাফায়াত পাবে? আর যারা নবীজী (সা:)’র উম্মত হতে ব্যর্থ, তাদেরকে বাঙালি মুসলিমগণ নেতা, পিতা বা বন্ধু রূপে গ্রহণ করে কীরূপে? এটিই বাঙালি মুসলিমদের জাতীয় অপরাধ।
ইতিহাসটি কেবল বাঙালি সেক্যুলারিস্ট মুসলিমদের
একাত্তরের যুদ্ধে বিজয়টি ভারতের। ভারতের সে বিজয়ে বাঙালি সেক্যুলারিস্ট, ন্যাশনালিস্ট, সোসালিস্টদের সাথে দেশী-বিদেশী মুর্তিপূজারী, গো-পূজারী, ইহুদী-খৃষ্টান ও নাস্তিকদের বিপুল আনন্দ দিয়েছে। কারণ তারা সবাই একটি কোয়ালিশনের অংশ। প্রতিবছর সে বিজয় নিয়ে বাংলাদেশে যেমন উৎসব হয়, তেমনি উৎসব হয় ভারতেও। সমগ্র মুসলিম ইতিহাসে এমন ঘটনা কখনোই ঘটে নাই যে, পৌত্তলিকদের সাথে মুসলিমগণ একত্রে কোন বিজয় উৎসব করলো। কারণ, পৌত্তলিক কাফেরদের যেখানেই বিজয়, সেখানেই মুসলিমদের নিশ্চিত ক্ষতি ও পরাজয়। যা কিছু কাফেরদের হাঁসায়, তাই মুসলিমদের কাঁদায়। দিনের আলো ও রাতের আঁধার কখনোই একত্রিত হয় না, তেমনি পৌত্তলিক কাফেরদের বিজয় আর মুসলিমদের বিজয় কখনোই একই রণাঙ্গণে ঘটে না। সে সাক্ষ্য ইতিহাসের। সেক্যুলারিস্টদের সে বোধ নাই। তাদের অপরাধ হলো, একাত্তরে ভারতীয় হিন্দু কাফেরদের বিজয়কে তারা বাঙালি মুসলিমদের বিজয় রূপে চিত্রিত করেছে।
১৯৭১ নিয়ে বহু বই লেখা হয়েছে। বহু আলোচনাও হয়েছে। যুদ্ধ মানব জীবনে অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। হাজার মানুষের প্রাণনাশ ও শত শত কোটি টাকার সম্পদ নাশ হয় যুদ্ধে। সে যুদ্ধ কখনোই কোন ব্যক্তির বা দলের ক্ষমতা লাভের হাতিয়ার হতে পারে না। প্রতিটি যুদ্ধে মুসলিমকে দেখতে হয় মুসলিম উম্মাহর সামগ্রিক কল্যাণের বিষয়টি। তাকে দেখতে হয় হারাম-হালাল হওয়ার বিষয়টিও। মুসলিমের যুদ্ধ হতে হয় একমাত্র আল্লাহর দ্বীনকে বিজয়ী করা ও কাফেরদের হামলার মুখে মুসলিম ভূমি ও মুসলিমদের জান-মাল ও ইজ্জতের সুরক্ষার লক্ষ্যে। এছাড়া মুসলিম জীবনে কোন যুদ্ধই হালাল হতে পারে না। কিন্তু একাত্তরের সে যুদ্ধে কতটুকু মানা হয়েছে মহান আল্লাহতায়ালার দেয়া হালাল-হারামের বিধান। যুদ্ধের হালাল-হারামের বিষয় নিয়ে কি একাত্তরের যুদ্ধের উপর লেখা হয়েছে কোন একটি বই? সেরূপ নির্মোহ বিচারের সামর্থ্য কি বাঙালি বাকশালী সেক্যুলারিস্টদের কোন কালে ছিল? ফ্যাসিস্টদের সে সামর্থ্য থাকে না। ফ্যাসিবাদীদের তান্ডব শুধু রাজনীতিতে নয়, বরং সেটি প্রকট ভাবে দেখা যায় বুদ্ধিবৃত্তির অঙ্গণেও। তারা শুধু নিজেদের মতটাই জনগণের চাপিয়ে দেয়, এবং ভিন্নমতের প্রকাশকে শাস্তিযোগ্য অপরাধে পরিণত করে। বুদ্ধিবৃত্তির অঙ্গণে একাত্তরকে নিয়ে বাঙালি সেক্যুলারিস্টদের সে ফ্যাসিবাদী তান্ডবটি অতি প্রকট। এটি তাদের আরেক অপরাধ।
প্রতিটি মুসলিমের ঈমানী দায়বদ্ধতা হলো, প্রতিটি কর্মের ন্যায় প্রতিটি যুদ্ধকেও বিচার করতে হয়, সে যুদ্ধে কতটা মানা হয়েছে কুর’আন-হাদীসের বিধানকে। অথচ এক্ষেত্রে প্রচণ্ড অবহেলা হয়েছে। এ বিচার আজ না হলেও শত বছর পর অবশ্যই উঠবে। তাছাড়া এ নিয়ে অবশ্যই বিচার বসবে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের দরবারে । কারণ, প্রতিটি কর্ম ও আচরণের ন্যায় রাজনীতি এবং বুদ্ধিবৃত্তিও মহান আল্লাহতায়ালার রাডারের নীচে। তখন কি জবাব হবে বাঙালি মুসলিমের? প্রতিটি মুসলিমকে সেদিন শুধু নামাজ-রোজার হিসাব দিলেই চলবে না, রাজনীতি ও যুদ্ধবিগ্রহে তার নিজস্ব ভূমিকারও হিসাব দিতে হবে। যদি কোন কর্মে ও রাজনীতিতে কাফেরদের বিজয় বাড়ে এবং পরাজয় বাড়ে ইসলাম ও মুসলিমদের, তবে সেটি যে ইসলামের সাথে প্রচণ্ড গাদ্দারী -তা নিয়ে কি সামান্যতম সন্দেহ চলে? অথচ একাত্তরে তো সেটিই হয়েছে।
পড়ুন আগের পাঁচ পর্ব:
সেক্যুলারিস্টদের অপরাধের রাজনীতি ও বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্বৃত্তি (পর্ব-১)
সেক্যুলারিস্টদের অপরাধের রাজনীতি ও বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্বৃত্তি (পর্ব-২)
সেক্যুলারিস্টদের অপরাধের রাজনীতি ও বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্বৃত্তি (পর্ব-৩)
সেক্যুলারিস্টদের অপরাধের রাজনীতি ও বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্বৃত্তি (পর্ব-৪)
সেক্যুলারিস্টদের অপরাধের রাজনীতি ও বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্বৃত্তি (পর্ব-৫)