ফিরোজ মাহবুব কামাল:
অসম্ভব করে সর্বশ্রেষ্ঠ নেক আমল
প্রশ্ন হলো, মহান নবীজী (সা:) যে আসনে বসেছেন সে আসনে কি চোর-ডাকাত, ভোট-ডাকাত ও দুর্বৃত্তদের বসানো যায়? সেটি হলে, ঘটে উল্টোটি। তখন দেশ দুর্বৃত্তিতে রেকর্ড গড়ে –যেমনটি হয়েছে বাংলাদেশে। গলিত আবর্জনার মাঝে সভ্য জীবনযাপন অসম্ভব। তেমনি জীবন দুর্বিষহ হয় যখন দেশ দুর্বৃত্তদের হাতে অধিকৃত হয়। তখন মৃত্যু ঘটে সুবিচার ও সুনীতির। তাই যে কোন রাষ্ট্রে সর্বশ্রেষ্ঠ নেক কর্মটি হলো দুর্বৃত্ত শাসনের নির্মূল। ইসলাম এ কাজকে জিহাদ তথা শ্রেষ্ঠ ইবাদতের মর্যাদা দিয়েছে। এ নেক কাজটি হাজার হাজার মসজিদ-মাদ্রাসা গড়ে হয় না। এ কাজটি এতোই গুরুত্বপূর্ণ যে নবীজী (সা:)’র অধিকাংশ সাহাবা সে কাজে শত্রুর হাতে শহীদ হয়েছেন। এজন্যই কোন মুসলিম দেশের শাসনক্ষমতা দুর্বৃত্তদের হাতে অধিকৃত হলে, প্রতিটি ঈমানদারের উপর ফরজ হয়ে যায় সে শাসনের নির্মূল। এ ফরজ ইবাদতটি পালিত না হলে নবীজী (সা:)’র শিক্ষাও পূর্ণ ভাবে পালিত হয়না। তখন ১০ বছর রাষ্ট্রপ্রধান রূপে দায়িত্বপালনের যে সূন্নত নবীজী (সা:) রেখে যান–সে সূন্নতটি তখন স্রেফ ইতিহাসের বইয়েই থেকে যায়। এবং অসম্ভব হয় পূর্ণ ইসলাম পালন। তখন বাঁচতে হয় শরিয়তের ন্যায় ইসলামের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিধানকে বাদ দিয়ে। সেক্যুলারিস্টদের অপরাধ, তারা অসম্ভব কবে সর্বশ্রেষ্ঠ এ নেক আমল।
অপূর্ণাঙ্গ ইসলাম পালনের কারণে শত্রুর হাতে শুধু পরাজয়ই আসে না, মহান আল্লাহতায়ার পক্ষ থেকে আযাবও আসে। তখন ফ্যাসিবাদী জালেমের দুর্বৃত্ত শাসনও আযাবের হাতিয়ারে পরিণত হয়। মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে আযাব শুধু ভূমিকম্প, প্লাবন, মহামারি ও ঘুর্ণিঝড় রূপে আসে না, ভয়ানক আযাব নামানো হয় জালেম শাসকের হাত দিয়ে। ভূমিকম্প, প্লাবন, মহামারি ও ঘুর্ণিঝড় দীর্ঘকাল থাকে না, কিন্তু জালেমের নৃশংস শাসন যুগ যুগ বাঁচে এবং শান্তি ও নিরাপত্তাকে অসম্ভব করে। এজন্যই সুরা মুমতেহানায় হযরত ইব্রাহীম (আ:) জালেম শাসকের আযাব থেকে বাঁচার জন্য করুণাময়ের কাছে দোয়া করেছেন। নবীজী (সা:) এবং তাঁর সাহাবাগণ জান ও মাল দিয়ে জিহাদ করেছেন। পরিতাপের বিষয় হলো, বাংলাদেশে বুকে আজ চলছে ফ্যাসিবাদী জালেমের নৃশংস শাসন। এবং বিস্ময়ের বিষয় হলো, বহু নামাজী, বহু রোজাদার, বহু ইমাম, বহু মৌলভী এ জালেম শাসকের চৌকিদারে পরিণত হয়েছে! এরূপ অবাধ্যতা নিয়ে কেউ কি সত্যিকার মুসলিম হতে পারে?
বিচ্যুতির ও বিদ্রোহের সাংস্কৃতিক ইঞ্জিনীয়ারিং
প্রতিটি পেশা, প্রতিটি কর্ম, প্রতিটি আচরন ও প্রতিটি যুদ্ধ-বিগ্রহে পথ দেখায় পবিত্র কুর’আন। এরূপ প্রতিটি বিষয়ে পবিত্র কুর’আন কাজ করে মহান আল্লাহতায়ালার দেয়া রোডম্যাপ রূপে। একমাত্র এই রোডম্যাপই জান্নাতের পথ দেখায়। অন্য সব পথ, মত ও ধর্ম নেয় জাহান্নামে। মহান আল্লাহতায়ালা জান্নাতের সে কুর’আনী রোডম্যাপটিকে আখ্যায়ীত করেছেন সিরাতাল মুস্তাকীম রূপে। কিন্তু সেক্যুলারিস্ট শাসক ও বুদ্ধিজীবীগণ মুসলিম জনগণকে সে পথে চলতে দিতে রাজি নয়। এক্ষেত্রে প্রতিটি স্বৈরাচারী শাসকই হলো উগ্র সেক্যুলার। ফলে তাদের চেতনায় আখেরাতের ভয় কাজ করে না। তাদের প্রতিটি ভাবনা ও কর্মের মূলে থাকে স্রেফ পার্থিব স্বার্থ হাছিলের বিষয়। সে স্বার্থসিদ্ধিতে তারা স্বেচ্ছাচারী। স্বার্থসিদ্ধির সে কাজকে বাধাহীন করার স্বার্থেই স্বৈরাচারী শাসকগণ দেশের সংবিধান, শিক্ষা-সংস্কৃতি, অর্থনীতি, আইন-আদালত, প্রশাসন, পুলিশ ও সেনাবিভাগের ন্যায় গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গনগুলিকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখে। এগুলিকে তাদের সেবকে পরিণত করে। তাদের কর্ম ও রাজনীতির উপর শরিয়তী আইন নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করুক -তা তারা চায় না। অথচ ঈমানদারী হলো, শরিয়তের প্রতিটি বিধান মেনে চলায় আপোষহীনতা। ঈমানদারের সর্বক্ষণের ভাবনাটি হতে হয় আখেরাতের কল্যাণ নিয়ে। কি করে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচা যায় -তা নিয়ে। তাই শুধু নামাজ-রোজা এবং হজ্জ-যাকাতের ফরজ-ওয়াজেব মানলে চলে না, তাকে ফরজ-ওয়াজেব এবং নবীজী (সা:) সূন্নত মানতে হয় রাজনীতিতেও। এ ক্ষেত্রে বিদ্রোহ ও বিচ্যুতি হলে অনিবার্য হয় অনন্ত-অসীম কালের জন্য জাহান্নামের আগুণ। অথচ বিদ্রোহ ও বিচ্যুতি নিয়ে বাঁচাই হলো সেক্যুলারিস্টদের সংস্কৃতি। তারা ক্ষমতায় গেলে তাদের সাংস্কৃতিক ইঞ্জিনীয়ারিং’য়ের লক্ষ হয় জনগণ আল্লাহতায়ালার বিরুদ্ধে বিদ্রোহী করা। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশী সেক্যুলারিস্টদের সফলতাটি বিশাল। জনগণ বাঁচছে নিজ দেশের আদালতে মহান আল্লাহতায়ালার শরিয়তী আইনের বিলুপ্তি মেনে নিয়ে এবং আত্মসমর্পণ করছে কাফেরদের প্রণীত আইনের কাছে। ফলে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশে বিজয়ের উৎসবটি শয়তানের শিবিরে। এবং পরাজয়টি ইসলামের।
একটি মাত্র হুকুম অমান্য করায় অভিশপ্ত শয়তানে পরিণত হয়েছে ইবাদতে মশগুল থাকা ইবলিস। একই কারণে, রাজনীতির অঙ্গণে মহান আল্লাহতায়ালার কোন একটি হুকুমের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘটলে নামাজী ব্যক্তিও শয়তানে পরিণত হয়। শয়তান মূলত একটি চারিত্রিক ব্রান্ড বা মডেলের নাম -যার মূল বৈশিষ্ঠ হলো মহান আল্লাহতায়ালার হুকুমের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। অতএব যে কোন ব্যক্তি শয়তান হতে পারে যদি তার মধ্যে কুর’আনী বিধানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ পাওয়া যায়। তাই যারা আদালতে শরিয়তী আইনের বদলে মানুষের তৈরী আইন দিয়ে বিচার করে, ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বিরোধীতা করে এবং স্কুল-কলেজ থেকে কুর’আন-হাদীসের পাঠ বন্ধ করে -তারাও ইবলিসের চেয়ে কম শয়তান নয়।
ঈমানদার ব্যক্তির জীবনে প্রতিক্ষণের ভাবনা হলো নিজেকে অভিশপ্ত শয়তান হওয়া থেকে বাঁচানো। হৃদয়ে প্রতিক্ষণ এরূপ ভাবনা নিয়ে বাঁচাই হলো তাকওয়া। সে জন্য প্রতিপদে তাঁকে পবিত্র কুর’আনে বর্নিত প্রতিটি বিধানের পূর্ণ অনুসরণ করে বাঁচতে হয় –সে বিধানটি আচার-আচরণ, রাজনীতি ও বুদ্ধিবৃত্তিতে হোক বা শিক্ষা-সংস্কৃতি ও আইন-আদালতে হোক। অবাধ্য বা বিদ্রোহী হলে মৃত্যু ঘটে ঈমানের এবং বিলুপ্ত হয় তাকওয়া। অবাধ্য বা বিদ্রোহী হওয়াটি হলো শয়তানে পথ। এ জীবনে কে কতটা আত্মসমর্পিত এবং কে কতটা বিদ্রোহী -তা নিয়েই প্রতি মুহুর্তে চলে পরীক্ষা। জান্নাতপ্রাপ্তি তো ঘটে সে পরীক্ষায় পাশের মধ্য দিয়ে। মহান আল্লাহতায়ালার সে ঘোষণাটি এসেছে এভাবে,“মানুষ কি ভেবে নিয়েছে যে, ঈমান এনেছি এ কথা বললেই তাকে ছেড়ে দেয়া হবে এবং পরীক্ষা করা হবে না? আমরা তো তাদের পূর্ববর্তীদেরও পরীক্ষা করেছি এবং জেনে নিয়েছি ঈমানের দাবিতে কারা সাচ্চা এবং কারা মিথ্যাবাদী।” –(সুরা আনকাবুত, আয়াত ২-৩)। জীবনের চুড়ান্ত পরীক্ষাটি হয় রাজনীতিতে। এখানে নিরপেক্ষ থাকার উপায় নাই, তাকে একটি পক্ষকে ভোট দিতেই হয়। ফলে ধরা পড়ে সে কোন পক্ষে দাঁড়ালো, কাকে ভোট দিল বা কাকে বিজয়ী করতে অর্থ দিল ও অস্ত্র ধরলো। নামাজ-রোজা ও হজ্জ-যাকাতে সেরূপ পক্ষ নেয়ার প্রয়োজন পড়ে না; ফলে সুযোগ থাকে নিজের মুনাফিকি লুকানোর।
পড়ুন আগের চার পর্ব:
সেক্যুলারিস্টদের অপরাধের রাজনীতি ও বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্বৃত্তি (পর্ব-১)
সেক্যুলারিস্টদের অপরাধের রাজনীতি ও বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্বৃত্তি (পর্ব-২)
সেক্যুলারিস্টদের অপরাধের রাজনীতি ও বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্বৃত্তি (পর্ব-৩)
সেক্যুলারিস্টদের অপরাধের রাজনীতি ও বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্বৃত্তি (পর্ব-৪)