ফিরোজ মাহবুব কামাল:
পথটি বিদ্রোহের
বনি ইসরাইলীগণ মুখে হযরত মূসা (আ:)’র উপর বিশ্বাসের কথা বলতো। কিন্তু তাদের মুনাফিকি ধরা পড়ে যখন তাদের উপর শত্রুদের নির্মূলে জিহাদের হুকুম আসে। তাদের শরিয়ত দেয়া হয়েছিল সে অনুযায়ী বিচারকার্য পরিচালনার জন্য। সে জন্য জরুরি ছিল ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা। সে রাষ্ট্রের জন্য তাদের জন্য একটি ভূ-খন্ডও নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়। সেটি ছিল কানান –যা আজকের ফিলিস্তিন। কিন্তু সে সময় কানানের সে ভূমি ছিল জালেম শক্তির হাতে অধিকৃত। মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে বনি ইসরাইলীদের উপর দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল কানানের অধিকৃত ভূমিকে জালেম শাসকের হাত থেকে মুক্ত করে সেখানে শরিয়তী আইন ও খেলাফতে প্রতিষ্ঠা দেয়ার। কিন্তু বনি ইসরাইলীগণ জোয়াল ঢেলে দেয়। তারা জিহাদে অনিহা দেখায়। এবং অনিহা দেখায় মহান আল্লাহতায়ালার জমিনে তাঁর আইন প্রতিষ্ঠায়। বনি ইসরাইলীদের ঔদ্ধত্য ও বিদ্রোহ এ পর্যায়ে পৌছেছিল যে তারা হযরত মূসা (আ:)কে বলে, “তুমি ও তোমার আল্লাহ গিয়ে যুদ্ধ করো, আমরা অপেক্ষায় থাকলাম।” এটি ছিল বনি ইসরাইলীদের সেক্যুলারিজম। তাদের পার্থিব স্বার্থচেতনার ভাবনা আখেরাতের কথা ভূলিয়ে দেয়। ফলে অবাধ্য হয় মহন আল্লাহতায়ালার হুকুম পালনে।
প্রতিদেশে সেক্যুলারিস্টদের একই নীতি। বাংলাদেশের সেক্যুলারিস্টগণও বনি ইসরাইলী সেক্যুলারিস্টদের থেকে ভিন্নতর নয়। তারাও আগ্রহী নয় শরিয়তের প্রতিষ্ঠায়। তাদের এজেন্ডা স্রেফ পার্থিব স্বার্থ হাছিল। প্রতিটি অবাধ্য জাতিকে আযাব দেয়াই মহান আল্লাহতায়ালার সূন্নত। সেরূপ আযাবের গ্রাসে যেমন আজকের বাংলাদেশ, তেমনি আযাব নেমে এসেছিল বনি ইসরাইলীদের উপরও। তাদের উপর ৪০ বছরের জন্য কানানের ভূমিতে প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়। পরিণামে নানা দেশের পথে-প্রান্তরে উদ্বাস্তুর বেশে ঘুরতে হয়। অথচ জিহাদে নামলে মহান আল্লাহতায়ালার প্রতিশ্রুত সাহায্যও আসতো, ইসলামী রাষ্ট্র, খোলাফায়ে রাশেদা ও ইসলামী সভ্যতা নির্মিত হতো –যেমনটি হয়েছে নবীজী (সা:) ও তাঁর সাহাবাদের হাতে।
প্রতিটি ঈমানদারকেই প্রতি মুহুর্ত মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে অর্পিত দায়িত্ব পালন করে বাঁচতে হয়। সেটি তাঁর খলিফা রূপে দায়িত্ব পালনের। এটিই মুসলিম জীবনের মূল মিশন। এ দায়িত্ব পালনের পুরস্কার হলো জান্নাত। এ দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে শুধু যে এই পার্থিব জীবনে প্রতিশ্রুত আযাব ঘিরে ধরে -তা নয়। পরকালেও জাহান্নামে হাজির করে। এ বিষয়ে বার বার বয়ান এসেছে পবিত্র কুর’আনে। ঈমানদার রূপে বাঁচার অর্থ হলো মহান আল্লাহর শরিয়তী আইন মেনে বাঁচা। এক্ষেত্রে বিদ্রোহী হওয়ার অর্থ কাফের, জালেম ও ফাসেক হয়ে যাওয়া। এমন মানুষেরাই শয়তানের খলিফা হয়। তখন অনিবার্য হয় কঠোর শাস্তি –শুধু দুনিয়ার জীবনে নয়, আখেরাতেও।
নবীজী (সা:) ও তাঁর উম্মত যেমন শরিয়তী আইন পেয়েছে সেরূপ আইন পেয়েছিল হযরত মূসা (আ:) এবং তাঁর বনি ইসরাইলীগণ। কিন্তু বনি ইসরাইলীগণ তাওরাতে ঘোষিত সে শরিয়তী আইনের তেলাওয়াতকেই ইবাদত মনে করেছে, সেটিকে রাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠা দেয়নি। সে অবাধ্যতাই আযাব ডেকে এনেছিল। পরিতাপের বিষয় হলো, পবিত্র কুর’আনে বনি ইসরাইলীদের সে অবাধ্যতার কথা ও অবাধ্যতার কারণে অর্জিত শাস্তির কথা বার বার ঘোষিত হলেও বাঙালি মুসলিমগণ তা থেকে শিক্ষা নেয়নি। পবিত্র কুর’আনে সে বিবরণগুলি বার বার শুধু পাঠই করেছে। বরং বাস্তবে অনুসরণ করে চলেছে অভিশপ্ত ও বিদ্রোহী বনি ইসরাইলীদের পথ। সেক্যুলারিস্টদের কাজ হয়েছে বাঙালি মুসলিমদের সে বিদ্রোহে উস্কিয়ে দেয়া।
বনি ইসরাইলীদের অনুকরণে মুসলিম জীবনে বিদ্রোহের কিছু উদাহরণ দেয়া যাক। মুসলিমগণ অবিভক্ত ভারতে সংখ্যালঘু ছিল। হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ ভারতে মুসলিমদের পক্ষে অসম্ভব ছিল ভারতের আদালতে শরিয়তের প্রতিষ্ঠা দেয়া। কারণ হিন্দুগণ সে সুযোগ দিতে রাজী ছিল না। বর্তমান ভারতে সেটি ভাবাও যায় না। অথচ শরিয়ত ছাড়া পূর্ণ ইসলাম পালন হয় না। যারা শরিয়ত অনুযায়ী বিচারকার্য পরিচালনা করে না তাদেরকে সুরা মায়েদার ৪৪, ৪৫ ও ৪৭ নম্বর আয়াতে কাফের, জালেম ও ফাসেক বলা হয়েছে। ১৯৪৭ সালে ১৪ আগষ্ট বাঙালি মুসলিমদের উপর করুণাময় আল্লাহর রহমত নেমে আসে। ইংরেজ ও হিন্দুদের বিরোধীতা সত্ত্বেও পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে মহান আল্লাহতায়ালা বাঙালি মুসলিমদের সুযোগ করে দেন শরিয়ত প্রতিষ্ঠার ও তাঁর খেলাফত প্রতিষ্ঠার। ১৯৪৭’য়ের সে পাকিস্তান ছিল সমগ্র বিশ্বে সর্ববৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্র। উসমানিয়া খেলাফত ভেঙ্গে যাওয়ার পর সমগ্র মুসলিম বিশ্বে পাকিস্তানই ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্র। ভারতীয় মুসলিমই শুধু নয়, বিশ্বের তাবত মুসলিমের কাছে এ রাষ্ট্রের ইজ্জত ছিল। সে রাষ্ট্রে বাঙালি মুসলিমগণই ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠি। ফলে পাকিস্তানের অন্যান্য ভাষাভাষীদের তূলনায় বাঙলি মুসলিমদের উপর শরিয়ত প্রতিষ্ঠার দায়িত্বটি ছিল সবচেয়ে বেশী। কিন্তু বাঙালি মুসলিমগণ বনি ইসরাইলীদের মতই দায়িত্ব পালনে জোয়াল ঢেলে দেয়। ইসলামকে বিজয়ী করা ও শরিয়ত প্রতিষ্ঠার বদলে বাঙালি মুসলিমগণ জোয়াল কাঁধে নেয় বাঙালি জাতীয়তাবাদ, সেক্যুলারিজম ও সমাজতন্ত্রের ঘানি টানার জন্য। তারা জোট বাঁধে হিন্দুত্ববাদী আগ্রাসী ভারতের সাথে। ভারতের সাথে নিয়ে পাকিস্তানকে খণ্ডিত করে দক্ষিণ এশিয়ার মুসলিমদের স্বপ্ন পূরণের পুরা প্রজেক্টকেই ব্যর্থ করে দেয়। পৌত্তলিকদের সমগ্র ইতিহাসে সবচেয়ে বিজয়টি তাদের ঘরে তুলে দেয় এই বাঙালি মুসলিমগণই। মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে অর্পিত দায়িত্বের সাথে এর চেয়ে বড় গাদ্দারী আর কি হতে পারে? এই হলো ইসলাম ও বাঙালি মুসলিমদের বিরুদ্ধে বাঙালি সেক্যুলারিস্টদের সবচেয়ে বড় নাশকতা।
পড়ুন আগের দুুই পর্ব:
সেক্যুলারিস্টদের অপরাধের রাজনীতি ও বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্বৃত্তি (পর্ব-১)
সেক্যুলারিস্টদের অপরাধের রাজনীতি ও বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্বৃত্তি (পর্ব-২)