সেক্যুলারিস্টদের অপরাধের রাজনীতি এবং বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্বৃত্তি (পর্ব-৪)

::
প্রকাশ: ২ years ago

ফিরোজ মাহবুব কামাল:

অপরাধটি শয়তানের পক্ষকে বিজয়ী করার
যে রাজনীতিতে ইসলামের বিজয় নাই, বুঝতে হবে বিজয়টি সেখানে শয়তানের। তৃতীয় কোন পক্ষ নাই। ইসলামের পরাজয় এবং শয়তানের বিজয় কখনোই দেশের আলোবাতাস ও জলবায়ুর কারণে ঘটে না। সেটির জন্য দায়ী জনগণ। জনগণের সে অপরাধ কখনোই গোপন থাকে না। জীবন ও জগত নিয়ে কার কীরূপ ধারনা এবং কে কোন পক্ষের চৌকিদার ও লাঠিয়াল -সেটি জায়নামাজে প্রকাশ পায় না। প্রকাশ পায় রাজনীতিতে। মহান আল্লাহতায়ালার শরিয়তী বিধানের প্রতি কে কতটা অনুগত বা বিদ্রোহী -সেটিরও প্রকাশ ঘটে রাজনীতিতে। রাজনীতির বিজয়ী পক্ষই নির্ধারণ করে কোন দিকে যাবে দেশের শিক্ষা-সংস্কৃতি, রাষ্ট্রীয় নীতি, অর্থনীতি ও আইন-আদালতের ন্যায় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলি। রাজনীতিই নিয়ন্ত্রিত করে ধর্মের প্রচার ও প্রতিষ্ঠা। রাষ্ট্র মসজিদ-মাদ্রাসগুলোকে ঘোড়ার আস্তাবলেও পরিণত করতে পারে –যেমনটি কম্যুনিস্ট শাসিত সোভিয়েত রাশিয়ায় হয়েছে। এমন কি মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষকদেরও রবীন্দ্রনাথের পৌত্তলিক গান গাইতে বাধ্য করতে পারে –যেমনটি বাংলাদেশে হচ্ছে। কোন মুসলিম দেশ সেক্যুলারিস্টদের দখলে গেলে সে রাষ্ট্রে সরকারের লক্ষ্য হয়, জনগণকে ইসলামশূণ্য করা। রাষ্ট্রের উপর নিয়ন্ত্রণ এজন্যই ইসলামের এতো গুরুত্বপূর্ণ। একাজে নবীজী (সা:) ও তাঁর সাহাবীদের জিহাদের পর জিহাদ করতে হয়েছে। শত শত সাহাবীকে শহীদ হতে হয়েছে। এরূপ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে একজন ঈমানদার নীরব ও নিষ্ক্রিয় থাকে কীরূপে?

ঈমানদারকে তো বাঁচতে হয়, ইসলামকে বিজয়ী করার এজেন্ডা নিয়ে। মহান আল্লাহতায়ালার খলিফা রূপে এটিই হলো প্রতিটি ঈমানদারের দায়বদ্ধতা। নিজেদের এবং সে সাথে অন্যদের জীবনকে যারা সিরাতুল মোস্তাকীমে পরিচালিত করতে চায় -রাজনীতির নিয়ন্ত্রনকে স্বহস্তে নেয়া ছাড়া তাদের সামনে বিকল্প পথ নেই। খোদ নবীজী (সা:) ও তাঁর মহান খলিফাদের এ জন্যই রাষ্ট্রনায়কের আসনে বসতে হয়েছে। তাই রাষ্ট্রের ড্রাইভিং সিটে বসা ও নেতৃত্বের দায়ভার স্বহস্তে নেয়া তাই নবীজী (সা:)’র মহান সূন্নত। ইসলামের জয়-পরাজয় নির্ধারিত হয় -এ সূন্নত পালনের মধ্য দিয়ে। মহান নবীজী (সা:)’র সাহাবাদের জান-মালের বেশীর ভাগ ব্যয় হয়েছে সে সূন্নত পালনে। রাজনীতির ময়দানে ঈমানদার ব্যক্তি তাই নীরব দর্শক হয় না, বরং তার অবস্থান হয় প্রথম সারিতে। কিন্তু সেক্যুলারিস্টদের অপরাধ, এ ফরজ দায়িত্ব পালন থেকে মুসলিমদের তারা বিরত রাখতে চায়। মুসলিম ভূমিতে ইসলামকে পরাজিত রাখার এটিই হলো শয়তানের স্ট্রাটেজী।

পানাহারের ন্যায় হারাম-হালালের সুস্পষ্ট বিধান রয়েছে রাজনীতিতেও। যে রাজনীতিতে ইসলামকে বিজয়ী করা ও শরিয়তী আইনকে প্রতিষ্ঠা দেয়ার এজেন্ডা নাই, বরং এজেন্ডা যেখানে আদালতে শরিয়তকে বিপুপ্ত রাখা -সে রাজনীতি সম্পূর্ণ হারাম। কোন ঈমানদার সে সেক্যুলার রাজনীতিতে অংশ নিতে পারে না। এ রাজনীতিতে কেউ মারা গেলে শহীদ হয়না, বরং জাহান্নামে যায়। এমন সেক্যুলার ও জাতীয়তাবাদী রাজনীতিতে বিজয়ী হয় শয়তান ও তার অনুসারীগণ। ব্যক্তির দৈহিক, আর্থিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক সামর্থ্যগুলি হলো ব্যক্তির উপর মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে অর্পিত আমানত। সে মহা মূল্যবান আমানতের খেয়ানত হয় যদি সেগুলি জাতীয়তাবাদ, ফ্যাসিবাদ, সেক্যুলারিজম ও সমাজতন্ত্রের ন্যায় হারাম মতবাদের প্রতিষ্ঠায় ব্যয় করা হয়। এবং পরাজিত করা হয় ইসলামকে। অথচ বাঙালি জনগণ সে হারাম রাজনীতিকে বার বার ভোট দিয়ে, অর্থ দিয়ে ও বুদ্ধিবৃত্তিক সমর্থন দিয়ে বিজয়ী করেছে। এ রাজনীতির কারণেই বাংলাদেশের আদালতে মহান আল্লাহতায়ালার শরিয়তী আইনের প্রয়োগ নাই। এভাবেই বাঙালি মুসলিমগণ বিজয় ও বিপুল আনন্দ দিয়েছে শয়তান ও তার অনুসারীদের। এ হলো মহান আল্লাহতায়ালার বিধানের বিরুদ্ধে বাঙালি মুসলিমদের জাতীয় বিদ্রোহ। এরূপ প্রতিটি বিদ্রোহই তো কুফুরি। এরূপ বিদ্রোহ যে ভয়ানক আযাব নামিয়ে আনবে -সেটিই কি স্বাভাবিক নয়? বাংলাদেশের মত দেশে সেক্যুলারিস্টগণ জনগণকে জাহান্নামে নেয়ার সে রাজনীতিকেই বিজয়ী করেছে।

প্রতিটি জাতির মাঝেই কিছু ভাল লোক থাকে। কিন্তু জাতীয় পরিচয়টি সে স্বল্প সংখ্যক ভাল মানুষদের কারণে নির্মিত হয় না। রাজনীতিতে বিচার হয় সমগ্র জনগণের দর্শন, কর্ম, রাজনীতি, বুদ্ধিবৃত্তি ও আচরণের মান থেকে। এখানে পরীক্ষা হয় জনগণের ঈমান, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, শত্রু-মিত্রের পরিচয় জানার সামর্থ্যের। পরীক্ষা হয়, শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধের এবং ভাঙ্গার বদলে গড়ার সামর্থ্যের। সে পরীক্ষায় ফেল করলে বাড়ে পরাজয়, বিপর্যয় ও অপমান। তেমন একটি পরীক্ষা ১৯৭১’য়ে বাঙালি মুসলিম জীবনেও এসেছিল। কিন্তু সে পরীক্ষায় বাঙালি মুসলিমগণ নিদারুন ভাবেই ফেল করেছে। তারা চিনতে ব্যর্থ হয়েছে হিন্দুত্ববাদী ভারতের ন্যায় অতি পরিচিত আগ্রাসী শত্রুকে। অন্য জাতির ও অন্য ধর্মে লোকেরা বৃহৎ রাষ্ট্র গড়া নিয়ে গর্ব করে। নানা বর্ণ ও নানা ভাষার প্রতিবেশী হিন্দুরাও বিশাল রাষ্ট্র গড়েছে। এক কালে সেরূপ বিশাল রাষ্ট্র গড়াই মুসলিম রাজনীতির মূল চরিত্র ছিল। ফলে মুসলিমগণ পৃথিবী পৃষ্ঠে নানা ভাষা ও নানা বর্ণের মানুষদের নিয়ে বিশ্বের সর্ববৃহৎ রাষ্ট্র গড়েছে।

কিন্তু বাঙালিরা গর্ব করে ভাঙ্গার রাজনীতি নিয়ে। সেটি পাকিস্তানের ন্যায় বিশ্বের সর্ব বৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্র ভাঙ্গার। মুসলিমগণ চিরকাল যুদ্ধ করেছে কাফরদের পরাজিত করতে। আর বাঙালি মুসলিমগণ যুদ্ধ করে পৌত্তলিক কাফেরদের ঘরে তাদের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় বিজয়টি তুলে দিতে। অন্যরা গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করে। অথচ বাঙালি মুসলিমগণ নিজ দেশে গণতন্ত্রকে কবরে পাঠায়। এবং সেটি তাদের নির্বাচিত নেতা শেখ মুজিবের নেতৃত্বে। তারা নিজেদের ইজ্জত না বাড়িয়ে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ এনেছে এবং অর্জন করেছে আন্তর্জাতিক অঙ্গণে তলাহীন ভিক্ষার ঝুলির খেতাব। বাঙালির সমগ্র ইতিহাসে এমন বিপর্যয় ও অপমান আর কোন কালেই জুটেনি। বাঙালি মুসলিম ইতিহাসের এ হলো অতি অপমানের এক কালো অধ্যায়। বাঙালি মুসলিমের চেতনার পচনটি নির্ভুল ভাবে ধরা পড়ে শেখ মুজিবের ন্যায় বাকশালী স্বৈরাচারের জনক, গণতন্ত্রের হত্যাকারী, বহু হাজার মানুষের হত্যকারী ও হিন্দুত্ববাদী ভারতের এজেন্টকে পিতা ও বঙ্গবন্ধু বলার মধ্য দিয়ে।

মুসলিম জীবনের পুরস্কারটি বিশাল। সেটি নিয়ামত ভরা জান্নাত। জান্নাতের এক ইঞ্চি ভূমিও কি হিমালয়ের সমান স্বর্ণ দিয়ে কেনা যায়? সে বিশাল পুরস্কার লাভের জন্য সবচেয়ে বড় পরীক্ষাটি হয় জিহাদে। কারণ মহান আল্লাহতায়ালার দ্বীন বিজয়ী হবে কি হবে না, সেটি মসজিদ-মাদ্রাসা এবং নামাজ-রোজা ও হজ্জ-যাকাতের উপর নির্ভর করে না। নির্ভর করে মুসলিমগণ জিহাদের অঙ্গণে ইসলামকে কতটা বিজয়ী করতে পারলো -তার উপর। একমাত্র জিহাদের অঙ্গণেই পরীক্ষা হয় অন্যায়ের নির্মূলে ও ন্যায়ের প্রতিষ্ঠায় শ্রম, অর্থ, মেধা ও রক্তের বিনিয়োগে ঈমানদারের সামর্থ্যের। এই জিহাদই হলো মু’মিনের রাজনীতি। অন্যদের কাছে রাজনীতি হলো ক্ষমতাদখলের হাতিয়ার। ফলে সে রাজনীতিতে যেমন মিথ্যাচার ও ভন্ডামী আছে, তেমনি সন্ত্রাস ও ভোটডাকাতিও আছে। আছে শত্রুদেশকে নিজ দেশের অভ্যন্তরে ডেকে আনার ষড়যন্ত্র। বাংলাদেশে সেরূপ ষড়যন্ত্র যেমন একাত্তরে ঘটেছে, তেমনি আজও হচ্ছে। এরই প্রমাণ, বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রী আব্দুল মোমেন ভারতের কাছে আবেদন পেশ করেছে যে কোন উপায়ে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় রাখতে। কিন্তু ঈমানদারের কাছে রাজনীতি হলো ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রকে ইসলামীকরণের ইবাদত। এটিই দেশ গড়া ও ইসলামকে বিজয়ী করার জিহাদ। ইবাদতের রাজনীতির সে পবিত্র সূন্নত প্রতিষ্ঠা করতেই নবীজী (সা:) নিজে আমৃত্যু রাষ্ট্র-প্রধান থেকেছেন। এটিই নবীজী (সা:) এর শ্রেষ্ঠ সূন্নত। এ পথেই আসে ইসলামের বিজয়। তখন মহান আল্লাহতায়ালার জমিনে প্রতিষ্ঠা পায় তাঁর সার্বভৌমত্ব। মুসলিমগণ একমাত্র এ পথেই নিরাপত্তা ও ইজ্জত পায়।

পড়ুন আগের তিন পর্ব:
সেক্যুলারিস্টদের অপরাধের রাজনীতি ও বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্বৃত্তি (পর্ব-১)
সেক্যুলারিস্টদের অপরাধের রাজনীতি ও বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্বৃত্তি (পর্ব-২)
সেক্যুলারিস্টদের অপরাধের রাজনীতি ও বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্বৃত্তি (পর্ব-৩)