আইনের প্রয়োগে ব্যর্থতায় বাড়ছে শিশু ও নারীর প্রতি সহিংসতা

:: অমিতা সিনহা ::
প্রকাশ: ৩ সপ্তাহ আগে

নারী পৃথিবীর সৃষ্টির সূচনার লগ্ন থেকে নানাভাবে লাঞ্চনা-বঞ্চনার শিকার হচ্ছে। সেকেলের সতীদাহ প্রথা থেকে শুরু করে এই যুগের আধুনিক সময়ে এসেও থেমে যায়নি। বহু জ্ঞানী-গুণী মানুষ এ থেকে উত্তরণ পেতে আত্মত্যাগ করেছেন। বহু উদাহরণও দিয়ে গেছেন। তবুও এই শিক্ষার আলোয় গড়ে উঠা মানব সমাজে মানুষ রূপি পশুর আক্রমণ ঘ্রাস থেমে নেই।

নিত্যদিন কোথাও না কোথাও শিশু – নারী আক্রমণ হচ্ছেন মানুষ রূপি নর-পশুদের হাতে। এ থেকে পরিত্রাণ পেতে প্রয়োজন পরিবার-সমাজ ও রাষ্ট্রের আইনের বিচার কার্যকে বাস্তবায়ন করা। শক্ত হাতে দমন করা। যদিও অশুভ নর-পশুদের অপরাধ কর্মকান্ড আইনের আওতায় নিয়ে আসা হচ্ছে, কিন্তু বিচার কার্যদেশ বাস্তবে সঠিক সময়ে প্রয়োগ না হওয়ায় পাড় পেয়ে যায় অরাধীরা।

এর ফলশ্রুতিতে অপরাধিদের সংখ্যা ক্রমানয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা। সাম্প্রতিক সময়ে শিশু নির্যাতন- ধর্ষণের মতো অপরাধ ব্যাপক বৃদ্ধি পাচ্ছে। আইনের শাসনকে বুড়ি আঙুল দেখিয়ে স্বজনদের সম্মুখেও অপরাধ কর্মকান্ড করে যাচ্ছে নির্বিঘ্নে।

শিশু ধর্ষণ- নারী ধর্ষণের চিত্র বারংবার প্রকাশে চলে আসছে। তার মধ্যে গত ৫মার্চ মাগুরার শিশু আছিয়া (৮) বোনের শ্বশুরের হাতে ধর্ষিত হয়ে স্থানীয় হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। ৪মার্চ বরগুনার ৭ম শ্রেণির কিশোরী (১৪) প্রাইভেটে পড়ার পর বাড়িতে ফেরার পথে কয়েকজন বখাটের হাতে ধর্ষিত হন। পরের দিন ভিকটিমের পিতা থানায় মামলা করায়, পিতাকে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। আর ১৪ মার্চ পটুয়াখালীর বাউফলে ১০ম শ্রেণির ছাত্রী নাজনিন জাহান কুমকুম ইভটিজিংয়ে শিকার হন তারই বিদ্যালয়ের সহপাঠির দ্বারা। পরে সে নিজে গলায় ওড়না পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করেন।

সাম্প্রতিক সময়ে হাতে গুণা কয়েকতা ঘটনা প্রকাশ্যে উঠে আসায় উদ্বিগ্নে আছেন সাধারণ মানুষ। আর এই ভয় আতঙ্ক নিয়ে নিত্য দিন বেড় হতে হচ্ছেন সন্তানদেরকে। পরিসংখ্যানের দিক দিয়ে এই ঘটনাগুলো গনণায় ধরা হলেও প্রকৃত অর্থে প্রতিদিনই এই ঘটনাগুলো ঘটে যাচ্ছে সহস্রাধিক ঊর্ধ্বে বলে মনে করছেন গবেষক শাবির ডিন সমাজবিজ্ঞান অনুষদের লায়লা আশরাফুন।

তিনি নারী নির্যাতন ও ডমেস্টিক ভাইয়োলেন্স নিয়ে পিএইচডি করেছেন ফিনল্যান্ডে। তাঁর অভিজ্ঞতা থেকে শাবির ডিন লায়লা আশরাফুন প্রতিবেদককে বলেন, আমরা সমাজের বিভিন্ন কাঠামোতে বসবাস করছি। কিন্তু সেখানেও নারীর প্রতি সহিংসতা বা নারী নির্যাতন বা নারীর অবমূল্যায়ন বা নারীর প্রতি ক্ষমতায়ন কখনো দেওয়া হয়নি।

যার ফলশ্রুতিতে নারীরা ঘরে – বাইরে পদে পদে নানা ধরণের ভয়ংকর পরিস্থিতি ও প্রতিকূলতার মধ্যে পরতে হচ্ছে। এই বাস্তব বিষয়গুলো কখনো আমার কাছে, আপনার কাছে কিংবা অন্যের দ্বারা এসে পড়েছে , তাই প্রচার মাধ্যমে জানতে পেরেছি। কেউ সেটাকে আবার রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করে চলেছে আর কেউ করেনি। প্রকৃতপক্ষে নিত্যদিন ঘরে-বাইরে নারী ও শিশুর উপর যে পরিমাণের অমানবিক নির্যাতন চলছে তা বেড় হচ্ছে না। পর্দার আড়ালে থেকে যাচ্ছে।

তিনি বলেন, আমাদের যে আইনগুলো আছে সেগুলো যদি বাংলাদেশ সৃষ্টির সময় থেকে প্রয়োগ হতো, তাহলে হয়তো নারী নির্যাতনের এই চিত্রগুলো দেখতে পেতাম না। অনেকটা হ্রাস পেতে পারতো। আলোচিত শিশু আছিয়াকে উদাহরণ স্বরূপ দেখিয়ে ডিন আরো বলেন, সে একজন শিশু। এখনো সে নারী হয়ে উঠেনি, সেই শিশুর প্রতি আমাদের সমাজ হাত বাড়িয়েছে। কারা হাত বাড়িয়েছে। তারই স্বজনরা।

এই বিষয়তা লোকসমাজে চলে আসাই আমরা জানতে পেরেছি। অথচ নিত্যদিন ঘরের ভিতরে যে নারী নির্যাতনগুলো হচ্ছে তা কিন্তু আমরা পাচ্ছি না। তার কারণ বাংলাদেশ হওয়ার পর থেকেই সঠিক আইনের প্রয়োগ সঠিক সময়ে হয়নি। যার দরুণ নারী নির্যাতন ক্রমাগত বেড়েই চলছে। আমার মনে হয়, সঠিক সামাজিকরণ প্রক্রিয়া ঘরের ভিতরে কিংবা ঘরের বাইরে বলেন, সব কিছুতেই আমাদের শিক্ষাকে আনতে হবে। কারণ পারিবারিক শিক্ষার বিকল্প কিছুই নেই।
নারীর সম্মান প্রসঙ্গ তুলে ধরে ডিন লায়লা আশরাফুন আরো জানান, একজন নারীকে সম্মান করতে হবে, যখন সে কন্যা শিশু রূপে জন্ম গ্রহন করে তখন থেকেই। কন্যা শিশুকে আমি যদি মানুষ হিসেবে ধরে নেই, তবেই তার প্রতি নির্যাতন করা তা বন্ধ হবে। কাজেই আমাদেরকে সামাজিকরণ প্রক্রিয়াতাকে মানুষের মধ্যে পারিবারিক শিক্ষায় জাগ্রত করা। যারা মানুষের প্রতি সহিংস আচরণ করে, সেই দোষীদের উপর আইন প্রয়োগ করতে হবে। সমাজের শান্তির জন্য, কিংবা মানবতা প্রতিষ্ঠা করার জন্য আইনকে যথাযথ শক্তভাবে কার্যকর করা উচিত।

একই বিষয়ে মন্তব্য করে বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতির সিলেট বিভাগীয় সভাপতি সৈয়দা শিরিন আক্তার প্রতিবেদককে বলেন, দেশে এখন ক্লান্তিকাল চলছে। নারীর স্বাধীনভাবে যাওয়া-আসাতাকে রোধ করতে চাই। বর্তমানে তা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে তার কারণ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি শক্ত না থাকায়। বিচার ব্যবস্থাও একী রকম। যদি অন্যায়কারীদের বিরুদ্ধে শক্তভাবে বিচার হতোতাহলে অপরাধীরা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতো না। সহিংসতার মতো ঘটনাও ঘটে না। সামাজিকভাবে প্রতিরোধ ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি কার্যকর করা দরকার। দীর্ঘ দিনের সংস্কৃতির বিচারহীনতা, বিচার অবিলম্ব, ন্যায় বিচার না হওয়া এগুলোর দৃষ্টান্ত নাই।

এজন্য নারীর প্রতি নানাপ্রকার জুলুম নির্যাতন ঘটনায় অনেক মানুষ মামলাও করে না। বর্তমানে তথ্যবধায়ক সরকার শক্ত অবস্থানে যাচ্ছে না। যখন কোনো জায়গায় ঘটনা ঘটে যায় অনেক বড় ইস্যু হয়ে যায়, তখন ওরা শক্ত অবস্থানে যায়। এর আগে নই। এজন্য নারীর প্রতি নেতি বাচক দৃষ্টিভঙ্গি দায়ি।

বাল্য বিয়ে তুলে ধরে এডভোকেট শিরিন বলেন, এখনো আমরা নারীদের বাল্য বিয়ে দিচ্ছে ১৪ বছর বয়সে। এটা আমাদের লজ্জার। এখনো আমরা বাল্য বিয়ে বন্ধ করতে পারি নাই। অথচ জেলা- উপজেলাগুলোতে বাল্য বিবাহ মুক্ত হয়েছে বলে বিভিন্ন সভা-সেমিনারে তুলে ধরে ঘোষণা করা হচ্ছে। বাস্তবে দেশের আনাচে কানাচে এখনো বাল্য বিবাহ হচ্ছে। এই বিষয়তাকে গুরুত্ব দিতে হবে। মেয়েরা বাল্য বিবাহে শিকার হন বলে নির্যাতনেও শিকার হচ্ছে। এজন্য প্রয়োজন বাল্য বিবাহ বন্ধ করা।