বাংলাদেশের পর্যটন শিল্প: অমিত সম্ভাবনা | অধ্যাপিকা জাহান আরা খাতুন

:: অধ্যাপিকা জাহান আরা খাতুন ::
প্রকাশ: ৪ সপ্তাহ আগে

এই পৃথিবীতে এক স্থান আছে-সবচেয়ে সুন্দর করুণ
যেখানে সবুজ ডাঙা ভরে আছে মধুকূপী ঘাসে অবিরল;
সেখানে গাছের নাম: কাঁঠাল, অশ্বত্থ, বট, জারুল, হিজল;
সেইখানে শঙ্খচিল পানের বনের মতো হাওয়ায় চঞ্চল,
(জীবনানন্দ দাস)

এই আশ্চর্য সুন্দর দেশের নাম বাংলাদেশ, যা যুগে যুগে কালে কালে রূপ-পিয়াসী হৃদয়কে বিস্ময় বিমুগ্ধ করেছে। এ দেশ সৌন্দর্যের চিরস্নিগ্ধ অমরাবতী। কোন এক রূপদক্ষ শিল্পী যেন সুন্দরের সমস্ত অনুষজ্ঞ তিল তিল করে আহরণ করে আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে এদেশকে তিলোত্তমা করে সৃজন করেছেন।
এদেশের নিসর্গ বিচিত্রমাত্রিক। ষড়ঋতুর লীলা-বিভঙ্গে অনন্য। এক এক ঋতুতে নিসর্গ ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিনন্দন আর মনোরঞ্জক চারুত্বে সেজে উঠে। অনির্বচনীয় সৌন্দর্য মাধুর্য ভালোলাগার মোহন আবেশে প্রাণ-মন রাঙিয়ে দেয়। রূপবিহ্বল কবি-কণ্ঠে হাজার তারের বীণার সুরে জাগে বিমুগ্ধ মূর্ছনা-
সার্থক জনম আমার জন্মেছি এই দেশে
সার্থক জনম মাগো তোমায় ভালোবেসে।
(রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)

এই রূপ লাবণ্য চিরদিন মায়াবি হাতছানিতে পর্যটকদের আকৃষ্ট করেছে। সৌন্দর্যের বহুবর্ণ অঙ্গরাগে রঞ্জিত করেছে ভ্রমণপিয়াসীদের অন্তঃকরণ। তাঁরা চিরসৌন্দর্যের অলকাপুরী বাংলাদেশের প্রশস্তি গেয়েছেন। জনৈক পর্যটকের কণ্ঠে শোনা যায়, “বাংলাদেশে প্রবেশের হাজার দুয়ার খোলা রয়েছে কিন্তু বেরুবার একটিও পথ নেই।” এই স্বতঃস্ফূর্ত উক্তির সূত্র ধরে আমরা এ দেশের পর্যটনডালা যেসমস্ত অনিন্দ্যসুন্দর উপচারে সাজানো এ বিষয়ে সামান্য আলোকপাত করব।
পর্যটনে এদেশের বর্ণোজ্জ্বল ঐতিহ্য সুপ্রাচীনকালের। বাংলার মসলিনের বিজয়গাথা একসময় সারাবিশ্বে সগৌরবে ধ্বনিত হত।
কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের কথায়,
বাংলার মসলিন বোগদাদ, রোম, চীন
কাঞ্চন তৌলেই কিনতেন একদিন।
বাংলাদেশের নিসর্গ পর্যটন শিল্পের অতুল বৈভব। এ অলংকারের প্রদীপ্ত প্রভায় পর্যটন-বলয় ভাস্বর। এ দেশে আছে হাজার নদীর ছন্দিত হাতছানি, পাহাড়-টিলা-বন-বনানীর শ্যামল ¯িœগ্ধশ্রী, অফুরন্ত প্রাকৃতিক সম্পদ, সুনীল সাগর আর দ্বীপাঞ্চলের মোহনীয় মায়া, রূপকথার মত সুন্দর সাগরকন্যা প্রবাল দ্বীপ; নানারকম চিত্তাকর্ষক জীববৈচিত্র্য, পার্বত্য জেলার নয়নাভিরাম দৃশ্যপট, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর স্বতন্ত্র জীবন ধারা, চিত্তরঞ্জক সংস্কৃতি ইত্যাদি।
“প্রকৃতপ্রস্তাবে, তৃতীয় বিশ্বের একটি উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশের পর্যটন শিল্প বিকাশের ক্ষেত্রে উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে। সম্প্রতি দেশে উৎসাহজনকহারে বাড়ছে বিদেশি পর্যটক ও পর্যটক খাত থেকে আসা বৈদেশিক মুদ্রার আয়। তবে প্রতিবেশি দেশগুলোর তুলনায় তা অতি ক্ষুদ্র। বর্তমানে বাংলাদেশের পর্যটন খাতের সম্ভাবনা আরো উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। সুইজারল্যান্ডভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘দ্য নিউ ৭ ওয়ান্ডার্স ফাউন্ডেশন অনলাইনে বিশ্বের প্রাকৃতিক সপ্তাশ্চর্য নির্বাচন প্রতিযোগিতায় শীর্ষ দশ স্থানের মধ্যে অবস্থান করছে বিশ্বের দীর্ঘতম অবিছিন্ন সমুদ্রসৈকত ‘কক্সবাজার’ ও বিশ্বের একক বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবন।” এসব প্রাকৃতিক বৈভব বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পকে বিশ্বের দরবারে অনায়াসেই সমুন্নত মহিমা দান করতে পারে।
জেলার ওয়ারি বটেশ্বর নামক দুটি গ্রামে প্রাকৃতিক রূপাল্পনার পাশাপাশি আরো কিছু অনুষঙ্গ এদেশের পর্যটনক্ষেত্রে মণি-কাঞ্চন হিসেবে গণ্য, যা অমিত সম্ভাবনায় পূর্ণ। যুগেযুগে কালে কালে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী শাসকগোষ্ঠীর প্রণোদনায় বাংলাদেশ পুরাকীর্তির ক্ষেত্রে সমৃদ্ধ হয়েছে। সেন রাজাদের পূর্বে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী পালরাজাদের শাসনামলে স্থাপত্য এবং ভাস্কর্যশিল্পের চরম উৎকর্ষ সাধিত হয়। চৈনিক পর্যটক ফা-হিয়েন ও হিউয়েন সাং এর বিবরণ এর বর্ণোজ্জ্বল সাক্ষ্য বহন করে। পুরাকীর্তির অন্যতম আকর্ষণ রাজশাহী জেলার পাহাড়পুড়ে অবস্থিত বৌদ্ধ বিহার যা বৌদ্ধযুগে নির্মিত হয়েছিল। এ ধারায় বগুড়া জেলার মহাস্থান গড় উল্লেখযোগ্য। এখানে খননকার্যের মাধ্যমে বহুসংখ্যক প্রাচীন নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে। যা প্রায় তিন হাজার বছর আগ থেকে শুরু করে মুসলিম যুগের শেষ পর্যন্ত সময়ের প্রতিনিধিত্ব করছে। প্রাপ্ত মন্দিরসহ বিভিন্ন ধর্মীয় ভগ্নাবশেষ, নানাবিধ ভাস্কর্য, প্রাচীন ধাতব মুদ্রা, ৩.৩৫ মিটার দীর্ঘ খোদাই পাথর, ব্রাহ্মী শিলালিপি, চওড়া খাদযুক্ত দুর্গ প্রভৃতি প্রাচীন নিদর্শন পর্যটক আকর্ষণে ব্যাপক ভূমিকা রাখছে। খ্রিস্টপূর্ব ৪৫০ অব্দের মৌর্য আমলের পূর্বের নিদর্শন পাওয়া গেছে নরসিংদী। প্রাপ্ত রাস্তাঘাট প্রাচীন নগর সভ্যতার কথা মনে করিয়ে দেয়। যে সভ্যতা সমুদ্র বাণিজ্যের সাথে সম্পৃক্ত ছিল। রৌপ্যমুদ্রা, হাতিয়ার, পাথরের পুঁতি প্রভৃতি দ্রব্যাদি একটি সমৃদ্ধ জনপদের সাক্ষ্য বহন করে।
এ ধারায় কুমিল্লার ময়নামতির স্থান অতি উচ্চে। এটি বৌদ্ধ সভ্যতার অন্যতম কেন্দ্র ছিল। এখানে হিন্দু ও জৈন ধর্মেরও নিদর্শন পাওয়া গেছে। স্থানটি ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে অত্যন্ত মূল্যবান। এখানে প্রাপ্ত প্রাচীন দিনের শিক্ষক শিক্ষার্থীদের আবাসন ব্যবস্থা আর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নানা নিদর্শন অতীতের সোনালি দিনের মোহন মায়ায় মনকে মুহূর্তের জন্য হলেও আবিষ্ট করে রাখে।
নানাবিধ প্রত্নত্বাত্তিক নিদর্শনে সজ্জিত ময়নামতি জাদুঘরটি অন্যতম দর্শনীয় স্থান। প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশে পর্যটকদের আকর্ষণ করার মত উপাদানের অভাব নেই। সোনারগাঁও প্রাচীন বাংলার মুসলিম সুলতানদের রাজধানী হিসেবে স্বতন্ত্র মর্যাদায় সমাসীন। গিয়াসউদ্দিন আযম শাহের মাজারসহ সে আমলের বহু সমাধি এখানে বিদ্যমান। এখানে আছে দৃষ্টিনন্দন সুরম্য প্রাসাদ। হিন্দু বণিকদের সুতা বাণিজ্যের কেন্দ্র পানাম নগর এখানে অবস্থিত। সোনারগাঁও এর গৌরব কালের কপোলতলে ¯িœগ্ধ সমুজ্জল করে রাখার মানসে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন কর্তৃক ১৯৭৫ সালে এখানে একটি বর্ণাঢ্য লোকশিল্প জাদুঘর প্রতিষ্ঠিত হয়। জাদুঘরটি বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পে রত্নখচিত বৈভব বিশেষ। এ জাদুঘরে রক্ষিত অলংকার, তৈজসপত্র, অস্ত্রশস্ত্র, জামদানিসহ নানাবিধ বস্ত্র, পালকি ইত্যাদি জীবনোপকরণ ভাবুক মনকে এক সমুন্নত মহিমার ভাবলোকে টেনে নিয়ে যায়। জীবনের অনিত্যতা বিষয়ে নানাবিধ প্রশ্নরাজি মনকে ভারাক্রান্ত করে তোলে। একদিন যে মানুষেরা ছিলেন এখন তাঁরা কই? ‘চিহ্ন তব পড়ে আছে তুমি হেথা নাই।’ তখন কোন সুদূরে যেন বাতার কাঁদানিয়া সুরে পারস্যের কবি ওমর খৈয়াম এর কণ্ঠে  শোনা যায়,
কেনইবা মোর জন্ম নেওয়া এই যে বিপুল বিশ্ব মাঝ
আসছি ভেসে কিসের স্রোতে হেথায় বা মোর কিসের কাজ ?
কোথায় পুনঃ কেইবা জানে ফিরতে হবে একটি দিন-
উধাও সেকোন মরুর পরে হাওয়ার মতই লক্ষ্যহীন।
এখানকার নৈসর্গিক পরিমণ্ডল পর্যটক আকর্ষণে অত্যন্ত কার্যকর। বিশাল দিঘি, গাছগাছালির স্নিগ্ধ ছায়া, সুবিশাল পরিসর ইত্যাদি অনুষঙ্গ যান্ত্রিক জীবনের শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশের বাইরে যেন আকাশ ভরা মেঘের সজল মায়াঞ্জন।
আর মাসব্যাপী বিস্তৃত বর্ণাঢ্য লোকমেলার বর্ণিলতা আর লোক ঐশ্বর্য সম্ভার পর্যটকদের আকর্ষণ করার জন্য অতুলনীয় এ কথা বলাই বাহুল্য। ঢাকার লালবাগের কেল্লাও অন্যতম দর্শনীয় স্থান। মোঘল শাসনামলে সম্পূর্ণ ইটের তৈরি দুর্গটি বর্তমানে জাদুঘর হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
আহসান মঞ্জিল মোঘল আমলের নবাবদের তৈরি অত্যন্ত দৃষ্টিনন্দন এবং সে সময়ের জীবনোকরণে সুসজ্জিত একটি প্রাসাদ। এটিও জাদুঘর হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে এবং পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে ব্যাপক স্বীকৃতি লাভ করেছে। প্রাসাদের প্রতিটি কক্ষ সুসজ্জিত। লম্বা বারান্দা, জলসাঘর, রংমহল, দরবার হল ইত্যাদি প্রত্যক্ষগোচর হওয়ায় প্রতিদিন বিপুলসংখ্যক দর্শনার্থীর কলগুঞ্জনে এলাকাটি মুখরিত হয়ে উঠে।
পর্যটক আকর্ষণে মসজিদ মন্দিরের ভূমিকাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এদেশে কারুকার্য খচিত মসজিদ মন্দিরের অভাব নেই। যা শাসকগোষ্ঠীর শিল্পানুরাগের সাক্ষী হয়ে কালের আকাশে তারকারাজির মত দীপ্ত হয়ে আছে। দু’একটা নাম আমরা উল্লেখ করছি। ষাট গম্বুজ মসজিদ, খান জাহান আলি মসজিদ (বাগেরহাট), বায়জিদ বোস্তামি মসজিদ (চট্টগ্রাম), হযরত শাহজালাল (রঃ) দরগাহ মসজিদ (সিলেট) ইত্যাদি স্থাপত্যে অনন্য। বায়তুল মোকাররম মসজিদ, তারা মসজিদ, সাত গম্বুজ মসজিদ, লালবাগ দুর্গ মসজিদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জামে মসজিদ ইত্যাদি মসজিদ ঢাকা জেলার স্থাপত্য কীর্তির অমূল্য নিদর্শন।
অলংকরণ আর শিল্প বিন্যাসে আধ্যাত্মিক মূলবোধের পাশাপাশি মন্দিরের এক স্বতন্ত্র আবেদন বিদ্যমান। এ ধারায় আছে রত্ন মন্দির বলে খ্যাত পাবনার হাতি কমরুলের মন্দির, কুমিল্লার সতেরো রত্ন মন্দির, কুষ্টিয়ার বল্লভপুরের মন্দিরসমূহ, খুলনার নবরত্ন মন্দির, চট্টগ্রামের চট্টেশ্বরী মন্দির, সীতাকুণ্ড মন্দির, আদিনাথের মন্দির। ঢাকার রমনা কালীবাড়ি, ঢাকেশ্বরী মন্দির, সিদ্বেশ্বরীর কালীবাড়ি, দিনাজপুরের কান্তজীর মন্দির ইত্যাদি।
বাংলাদেশের প্রতিটি অঞ্চলই স্ব স্ব বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল। তবে যে অঞ্চল পর্যটনের বহুমাত্রিক ব্যঞ্জনায় উদ্ভাসিত এর নাম সিলেট। মৃন্ময় সিলেট চিন্ময় সৌন্দর্যে অনুরঞ্জিত এ কথা সর্বজন স্বীকৃত। মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি মেজর জেনারেল আতাউল গনি ওসমানি সিলেটের গর্ব-গৌরব। পাহাড়-টিলার সৌম্যশ্রী, চা ও রাবার বাগানের স্নিগ্ধতা, ঝরনা নদীর কলগুঞ্জন, দিগন্ত বিস্তৃত হাওড়াঞ্চলের ভাবময়তা, গাছগাছালির কমনীয়তা, দৃষ্টিনন্দন মসজিদ, মন্দির, জীববৈচিত্র্য, পার্বত্য জাতির স্বতন্ত্র সংস্কৃতি, জীবনচর্যা, তীর্থস্থান আর দরগার সমাবেশে ৩৬০ আউলিয়ার পুণ্যপদধূলিধন্য সিলেট বিভাগের প্রতিটি জেলাই স্ব স্ব বৈশিষ্ট্যে পর্যটনে ব্যাপক ভূমিকা রাখতে সক্ষম। সিলেটের রূপবৈভবে বিমোহিত হয়ে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘সুন্দরী শ্রীভূমি।’ এই শ্রীভূমির অপরূপ রূপেরডালা বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পকে বিচিত্রমাত্রিক নান্দনিকতায় অনায়াসেই ঋদ্ধ করছে।
মহান মুক্তিযুদ্ধে সিলেট বিভাগের হবিগঞ্জ জেলা হিরণ¥য় বর্ণ-বিভাসায় ভাস্বর। মুক্তিযুদ্ধের উপপ্রধান সেনাপতি মেজর জেনারেল অবঃ এম এ রব বীর উত্তম এ জেলার সূর্য সন্তান। জেলার তেলিয়াপাড়া চা বাগানের ডাক বাংলো একটি ঐতিহাসিক দর্শনীয় স্থান। বাংলোতে মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি মেজর জেনারেল আতাউল গনি ওসমানি সমগ্র দেশকে প্রাথমিক ভাগে চারটি সেক্টরে ভাগ করেন যা কৌশলগত পরিচালনায় মুক্তিযুদ্ধে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখে। এ ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী হিসেবে এখানে নির্মিত হয়েছে স্মৃতিস্তম্ভ। মুক্তিযুদ্ধের মহিমা-দীপ্ত স্তম্ভটি জেলার অন্যতম দর্শনীয় স্থান।
এছাড়া হবিগঞ্জে পর্যটনের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। এর মধ্যে আছে হাওড়, বাঁওড়, বনাঞ্চল, সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান, রেমা কালেঙ্গা বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য, ঐতিহাসিক মসজিদ, বিথঙ্গল আখড়া, চা ও রাবার বাগান, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জীবন বৈচিত্র্য, নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক পরিবেশে তৈরি ৫ তারকা হোটেল দ্য প্যালেস রিসোর্ট এন্ড স্পা ইত্যাদি।
ভৌগোলিক, সাংস্কৃতিক, ইতিহাস, ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ প্রাচীন জনপদ হবিগঞ্জকে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে তুলে ধরার ব্যাপকতর সুযোগ রয়েছে। ‘পাহাড় টিলা হাঁওড়বন: হবিগঞ্জের পর্যটন। এই স্লোগানের মাধ্যমে হবিগঞ্জ জেলা প্রশাসন যে উদ্যোগ নিয়েছে তা পত্রপুষ্পে সুশোভিত হয়ে পর্যটন শিল্পে বিশেষ ভূমিকার মাধ্যমে গৌরব-দীপ্ত আসনলাভে সমর্থ হবে এ আমাদের সুদৃঢ় বিশ্বাস।
প্রকৃতপক্ষে বিপুল অর্থনৈতিক আয়ের ক্ষেত্র হিসাবে পর্যটন শিল্পের গুরুত্ব অপরিসীম বিশ্বের বহু দেশের জাতীয় আয়ের সিংহভাগ পর্যটন খাত থেকে অর্জিত হয়। বাংলাদেশেও এ খাত সৃষ্টি করা সম্ভব। ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ বিনির্মাণে বর্তমান সরকার নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনন্য নেতৃত্বে দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলেছে বাংলাদেশের উন্নয়ন অভিযাত্রা।
পর্যটন শিল্পেও লেগেছে উন্নয়নের অভিঘাত। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের পর্যটন সম্ভাবনাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপদানের উদ্যোগ গৃহীত হয়। ফল শ্রুতিতে বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশন নামে একটি প্রতিষ্ঠান জন্মলাভ করে। যা প্রথমে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে পরবর্তীতে বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন করা হয়।
পর্যটন শিল্পের বিকাশ ও উন্নয়নে সরকার অত্যন্ত তৎপর। কারণ অর্থনৈতিক দিক থেকে বাংলাদেশের জন্য এর গুরুত্ব অসীম। এজন্য পর্যটনকে ১৯৯১ সালে শিল্প হিসাবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। জাতীয় আয় বৃদ্ধি, আন্তর্জাতিক যোগাযোগস্থাপন, বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন, জ্ঞানার্জনের অন্যতম উপায়, নিজ দেশের ইতিহাস ঐতিহ্য বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরা, বেকারত্ব হ্রাস, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, কর্মসংস্থান বৃদ্ধি, কুটির শিল্প ও মাঝারি শিল্পের উন্নয়ন পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা, রাজস্ববৃদ্ধি, প্রাকৃতিক সম্পদ উন্নয়ন, বৈচিত্র্যময় অর্থনৈতিক কর্মকাÐ বৃদ্ধি, বৈদেশিক বিনিয়োগ বৃদ্ধি ইত্যাদি বিষয়ে পর্যটনের ভূমিকা অপরিসীম। এসবের পাশাপাশি পর্যটনের মাধ্যমে বিশ্বভ্রাতৃত্ব ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বৃদ্ধি পায়। মানুষে মানুষে গড়ে উঠে আত্মীয়তার বন্ধন। বিভিন্ন দেশের মানুষের মধ্যে পারস্পরিক জ্ঞান ও ভাবের আদান প্রদানের মাধ্যমে দূর হয় কূপমণ্ডকতা। প্রসারিত দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে গড়ে উঠে উদার মানসিকতার দীপ্তোজ্জ্বল পরিমণ্ডল যা সর্বক্ষেত্রেই ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে সক্ষম। এক কথায় পর্যটনের গুরুত্ব অপরিসীম। এক্ষেত্রে সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোক্তরাও এগিয়ে এলে উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে বলে আমাদের বিশ্বাস। এ শিল্পের বিকাশে বিরাজমান সমস্যাগুলোর মধ্যে যোগাযোগ ব্যবস্থার দুর্বলতা, বিপজ্জনক রাস্তা, আধুনিক হোটেল মোটেলের অপর্যাপ্ততা, রাজনৈতিক অস্থিরতা ইত্যাদির কথা বলা যায়।
পর্যটন বিকাশে করণীয় বিষয় হিসেবে প্রথমেই বলতে হয়, নান্দনিকতা এ শিল্পের প্রাণ। কেন্দ্রগুলো কিভাবে আরো দৃষ্টিনন্দন আর মনোরঞ্জকরূপে বিপুল সংখ্যক পর্যটক আকর্ষণে সমর্থ হবে এ বিষয়ে নতুন নতুন চিন্তাভাবনা অত্যাবশ্যক।
রাস্তাঘাটের দুর্গমতা নিরসন অত্যন্ত জরুরি। সুষ্ঠু যাতায়াতব্যবস্থাসহ নিরাপদ ভ্রমণের পথ সুগম না হলে পর্যটনের অগ্রযাত্রা ব্যাহত হবে। বিনোদনের বিষয়টিকেও গুরুত্ব দিতে হবে। আবাসন সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। অবকাঠামোগত দুর্বলতা একটি বড় সমস্যা। তা নিরসনও অতীব জরুরি। এ শিল্পের উন্নয়নে পর্যটনকর্মীদের আধুনিক প্রশিক্ষণে দক্ষ করে গড়ে তোলা দরকার। আর পর্যটকদের নিরাপত্তার বিষয়টি সর্বাগ্রে নিশ্চিত করতে হবে। সাথে নির্বিঘ্নে চলাফেরার বিষয়টিও সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। তাঁদের মূল্যবোধের প্রতি সহনশীল হওয়া অর্থাৎ-অতীব জরুরি। চুরি, ছিনতাই, হত্যা, রাহাজানিসহ সবরকম সহিংসতা থেকে পর্যটকদের রক্ষা করার বিষয়টির উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা অতি আবশ্যক। নইলে এ শিল্প যথাযথভাবে বিকশিত হতে পারবে না। বৈশ্বিক বলয়ে দেশের ভারমূর্তিও ক্ষুন্ন হবে।
মূলত বাংলাদেশ সৌন্দর্যের অপরূপ লীলা-নিকেতন। দ্বিজেন্দ্রলাল রায় এর কথায়,
‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি,
সকল দেশের রানী সে যে আমার জন্মভূমি।’
সপ্তম শতকে বাংলাদেশ ভ্রমণে এসে চৈনিক পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ বিমুগ্ধ হয়ে বলেছিলেন, ‘A sleeping beauty emerging from mists and water – এই প্রশংসার হিরণ্ময় উদ্ভাসকে চির ভাস্বর রাখতে আমরা বদ্ধপরিকর। আমাদের পর্যটন শিল্প বিশ্বের দরবারে আপন বিভাসায় প্রদীপ্ত হয়ে উঠুক এ আমাদের সুগভীর প্রত্যাশা। বিশ্ববাসী বাংলাদেশের রূপ-বৈভবে বিমুগ্ধ হোক। তাদের কণ্ঠে সুধাগন্ধে হিল্লোলিয়া উঠুক রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতায়-
বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি,
তাই আমি পৃথিবীর রূপ খুঁজিতে যাই না আর।

তথ্যসূত্র:
১। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-গীতবিতান।
২। জীবনানন্দ দাশ- রূপসী বাংলা।
৩। ড. হায়াৎ মামুদ- ভাষা শিক্ষা।
৪। ওরম খৈয়াম-কান্তিচন্দ্র ঘোষ।
৫। পাহাড় টিলা হাওরবন: হবিগঞ্জের পর্যটন, জেলা প্রশাসন, হবিগঞ্জ

লেখিকা: অধ্যাপিকা জাহান আরা খাতুন, অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ, হবিগঞ্জ সরকারি মহিলা কলেজ, হবিগঞ্জ।


[প্রিয় পাঠক, পাবলিক রিঅ্যাকশনের প্রায় প্রতিটি বিভাগে আপনিও লিখতে পারেন। আপনার অনুভূতির কথা আমাদের লিখে পাঠান। ছবিসহ মেইল করুন opinion2mail@gmail.com এই ঠিকানায়। যে কোনো খবর, ভ্রমণ, আড্ডা, গল্প, স্মৃতিচারণসহ যে কোনো বিষয়ে লিখে পাঠাতে পারেন। পাঠকের লেখা আমাদের কাছে সবসময়ই গুরুত্বপূর্ণ।]