রমজান মাস আত্মশুদ্ধি, সংযম ও সহমর্মিতার শিক্ষা দেয়। এটি কেবল ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; বরং এর মূল বার্তা হলো সমাজের অসহায়, দুঃস্থ ও দরিদ্র মানুষের পাশে দাঁড়ানো। এই পবিত্র মাসে মানুষের মানবিক গুণাবলি বিকাশ লাভ করে এবং সামাজিক দায়বদ্ধতা আরও সুদৃঢ় হয়। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রপক্ষ ও সমাজের ধনী ব্যক্তিদের বিশেষ দায়িত্ব রয়েছে, যা সমাজের ভারসাম্য রক্ষায় সহায়তা করে। যদি সঠিকভাবে এই দায়িত্ব পালন করা হয়, তবে সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হবে এবং দরিদ্রদের কষ্ট লাঘব হবে।
দরিদ্র ও অসহায় মানুষের দুর্দশা: আমাদের সমাজে এখনও এমন অনেক মানুষ রয়েছে, যারা দৈনন্দিন খাদ্য সংগ্রহ করতেই হিমশিম খায়। রমজান মাসে তাদের এই সংকট আরও তীব্র হয়ে ওঠে। বিশেষ করে দিনমজুর, পথশিশু, বিধবা নারী, প্রতিবন্ধী ও ভাসমান জনগোষ্ঠী সবচেয়ে বেশি অসহায় অবস্থার সম্মুখীন হয়। ইফতার ও সেহরির জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রী কেনার সামর্থ্য তাদের নেই। অনেকে রাস্তায় কিংবা মসজিদের বারান্দায় রাত কাটায়। রমজানে নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির কারণে তাদের কষ্ট আরও বেড়ে যায়। এ অবস্থায়, সমাজের ধনী ও সচ্ছল ব্যক্তিদের এগিয়ে আসা উচিত, যাতে এই অসহায় মানুষেরা অন্তত এই পবিত্র মাসে দু’বেলা খাবারের নিশ্চয়তা পায়।
রাষ্ট্রপক্ষের দায়িত্ব: রমজান মাসে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা সহজ করতে রাষ্ট্রকে বিশেষ কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রথমত, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণ করা অত্যন্ত জরুরি। খাদ্যদ্রব্য, ওষুধ ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রীর দাম সহনীয় রাখতে বাজার মনিটরিং ব্যবস্থা শক্তিশালী করা দরকার। এছাড়া, অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে, যেন তারা কোনোভাবেই নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের কৃত্রিম সংকট তৈরি করতে না পারে।
রমজানে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য বিশেষ সহায়তা নিশ্চিত করতে রেশন কার্ডের মাধ্যমে খাদ্য বিতরণ ও সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি আরও জোরদার করা প্রয়োজন। বিশেষ করে হতদরিদ্র ও দিনমজুর শ্রেণির জন্য বিনামূল্যে বা স্বল্পমূল্যে খাদ্যসামগ্রী বিতরণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। সরকার যদি এই কর্মসূচিগুলো কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করতে পারে, তাহলে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কষ্ট অনেকাংশে লাঘব হবে।
বিশেষ করে গ্রাম ও শহরের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মাঝে খাদ্য সহায়তা নিশ্চিত করতে তৃণমূল পর্যায়ের প্রশাসনকে সক্রিয়ভাবে কাজ করতে হবে। ভাসমান ও ছিন্নমূল মানুষদের জন্য আলাদা সহায়তা প্রকল্প চালু করা যেতে পারে, যাতে তারা ক্ষুধার্ত অবস্থায় দিন কাটাতে না হয়। পাশাপাশি, দুর্গম এলাকার দরিদ্র জনগোষ্ঠী যেন সঠিক সুবিধা পায়, তা নিশ্চিত করা জরুরি।
জাকাত ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের উদ্যোগ থাকা উচিত, যাতে সম্পদ যথাযথভাবে গরিবদের মাঝে পৌঁছে যায়। পাশাপাশি, ইফতার ও সেহরির সময়ে বিদ্যুৎ ও পানির সরবরাহ স্বাভাবিক রাখা নিশ্চিত করা দরকার। ইফতার ও তারাবির সময়ে যানজট নিয়ন্ত্রণ করতে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় বিশেষ নজর দেওয়া উচিত, যাতে সাধারণ জনগণ নির্বিঘ্নে যাতায়াত করতে পারে। এ ছাড়া সুবিধাবঞ্চিতদের জন্য সরকারি সংস্থাগুলোর মাধ্যমে ফ্রি ইফতার আয়োজন করা যেতে পারে।
রমজানে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে চুরি, ছিনতাই ও দুর্নীতি রোধে প্রশাসনের তৎপরতা বাড়ানো দরকার। একই সঙ্গে শ্রমিকদের জন্য বিশেষ সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা উচিত, যাতে তারা সঠিক সময়ে বেতন-বোনাস পায় এবং কম শ্রমঘণ্টার সুবিধা ভোগ করতে পারে। এছাড়া, শ্রমজীবী মানুষ যেন রমজানের পবিত্রতা বজায় রেখে কাজ করতে পারে, সেজন্য তাদের জন্য বিশেষ ছুটির ব্যবস্থাও করা যেতে পারে।
বিত্তশালীদের দায়িত্ব: ধনী ব্যক্তিদের জন্য রমজান মাস সম্পদের সঠিক ব্যবস্থাপনা ও দানের মাধ্যমে নিজেদের পরিশুদ্ধ করার সময়। জাকাত ও সদকা প্রদান করা তাদের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব। বিত্তশালীরা দরিদ্রদের জন্য বিনামূল্যে ইফতার ও সেহরির ব্যবস্থা করতে পারেন। বিশেষত, মসজিদ, হাসপাতাল, এতিমখানা ও পথশিশুদের জন্য এ ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করা উচিত।
এ ছাড়া সমাজের অসহায় ও বিধবা নারীদের সহায়তা করা জরুরি। বৃদ্ধাশ্রম, এতিমখানা এবং দরিদ্র পরিবারের মাঝে পোশাক ও ঈদ উপহার বিতরণ করলে এই উৎসব সবার জন্য আনন্দময় হয়ে উঠবে। পাশাপাশি, দরিদ্র শিশুদের জন্য শিক্ষাবৃত্তির ব্যবস্থা করাও বিত্তশালীদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হতে পারে।
বিশেষ করে গ্রামে বসবাসকারী দরিদ্র জনগোষ্ঠী, যারা মৌসুমি কাজের উপর নির্ভরশীল, তাদের জন্য কর্মসংস্থানমূলক উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। ধনীরা চাইলে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য সুদমুক্ত ঋণ প্রদান করতে পারেন, যাতে তারা স্বাবলম্বী হতে পারে।
স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রেও বিত্তশালীরা বড় ভূমিকা রাখতে পারেন। মেডিক্যাল সহায়তার উদ্যোগ নেওয়া দরকার, যাতে দরিদ্র জনগোষ্ঠী বিনামূল্যে চিকিৎসা ও ওষুধ পায়। এছাড়া, ফ্রি স্বাস্থ্য ক্যাম্প আয়োজন করা যেতে পারে, যেখানে দরিদ্র রোগীরা প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসেবা পেতে পারে।
ব্যবসায়ীদের নৈতিক দায়িত্ব হলো মুনাফার লোভে পণ্যের দাম বাড়ানো ও কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি না করা। তারা যেন স্বচ্ছতা ও ন্যায়বিচার বজায় রাখেন, সেটি নিশ্চিত করা জরুরি। কর্মচারীদের জন্য বিশেষ বোনাস ও সুযোগ-সুবিধা প্রদানও ধনী ব্যক্তিদের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব। শ্রমিক ও কর্মচারীদের বেতন সময়মতো পরিশোধ করা হলে তাদেরও ঈদের আনন্দ উপভোগের সুযোগ তৈরি হবে।
পরিশেষে, রমজানের মূল শিক্ষা হলো মানবতা, সহমর্মিতা ও সাম্যের চর্চা। রাষ্ট্র ও বিত্তশালীরা যদি নিজেদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেন, তাহলে সমাজে দারিদ্র্য বিমোচন, সামাজিক ন্যায়বিচার ও অর্থনৈতিক ভারসাম্য প্রতিষ্ঠিত হবে। এই মাসের প্রতিটি দিন আমাদেরকে উদারতা, দানশীলতা ও পারস্পরিক সহযোগিতার অনুশীলন করার সুযোগ দেয়। দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিলে সমাজে শান্তি ও কল্যাণ নিশ্চিত হবে। সমাজের সকল স্তরের মানুষ যদি তাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করে, তবে রমজান সত্যিকারের শান্তি, কল্যাণ ও ঐক্যের প্রতীক হয়ে উঠবে।
লেখক: মোহাম্মদ ছৈয়দুল আলম, সাংবাদিক ও গবেষক।
[প্রিয় পাঠক, পাবলিক রিঅ্যাকশনের প্রায় প্রতিটি বিভাগে আপনিও লিখতে পারেন। আপনার অনুভূতির কথা আমাদের লিখে পাঠান। ছবিসহ মেইল করুন opinion2mail@gmail.com এই ঠিকানায়। যে কোনো খবর, ভ্রমণ, আড্ডা, গল্প, স্মৃতিচারণসহ যে কোনো বিষয়ে লিখে পাঠাতে পারেন। পাঠকের লেখা আমাদের কাছে সবসময়ই গুরুত্বপূর্ণ।]