প্লট বাড়ি গাড়ি ঘের সবই আছে এসপি জসীমের

::
প্রকাশ: ২ মাস আগে
সংগৃহীত ছবি

রাজধানীর মিরপুরে পীরেরবাগের ঝিলপাড় ২ নম্বর সড়কের ২৯৯/৯ নম্বর বাড়িটি ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মিরপুর বিভাগের সদ্য সাবেক উপকমিশনার (ডিসি) জসীম উদ্দীন মোল্লার।

ছয়তলা ভবনের দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলা নিয়ে তৈরি ডুপ্লেক্সে পরিবার নিয়ে বাস করেন তিনি। চতুর্থ থেকে ষষ্ঠতলা পর্যন্ত প্রতি তলায় দুটি ইউনিট। এই ছয় ফ্ল্যাটে আছেন ভাড়াটিয়া। ওই বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, ‌প্রধান ফটকে ঝুলছে ‘টু-লেট’। বাসা ভাড়া নেওয়ার নাম করে কথা হয় নিরাপত্তাকর্মী আবদুস সাত্তারের সঙ্গে। তিনি জানান, নিচতলার ফ্ল্যাটটি ভাড়া দেওয়া হবে। ভবনের আর কোনো ফ্ল্যাট খালি নেই।

শুধু এই বাড়িই নয়, ঢাকা ও গোপালগঞ্জে পুলিশের সাবেক এই কর্মকর্তার আরও অনেক সম্পদের তথ্য পাওয়া গেছে।

জসীম মিরপুর বিভাগের ডিসি থাকাকালে তাঁর আওতাধীন থানার দুই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, টাকা ছাড়া তিনি কিছুই বুঝতেন না। সাত থানার ওসির কাছ থেকে নিতেন নিয়মিত মাসোহারা। অনেক সময় থানা থেকে আসামি ছেড়ে দিতে বাধ্য করতেন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আসামির বিষয়ে রাজনৈতিক তদবির আছে বলে জানাতেন। তবে এর নেপথ্যের কারণ কী, তা খোঁজার চেষ্টা করতেন না কোনো ওসি। মাদক কারবারি ও অপরাধীদের সঙ্গেও সখ্য ছিল তাঁর।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হওয়ার পর জসীমকে মিরপুর থেকে ডিএমপি সদরদপ্তরে সংযুক্ত করা হয়। এরপর ২১ আগস্ট তাঁকে রংপুর রেঞ্জ ডিআইজি কার্যালয়ে পুলিশ সুপার (এসপি) হিসেবে বদলি করা হয়। জুলাই-আগস্টে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আসামি হিসেবে প্রথম গ্রেপ্তার হন পুলিশের এই কর্মকর্তা।

অনুসন্ধানে জানা যায়, টুঙ্গিপাড়া মৌজায় ২৫ কাঠার একটি জমি রয়েছে, যার দাম কমপক্ষে ৫০ লাখ টাকা। একই মৌজায় আরও ১৮ কাঠা ও সাত কাঠার দুটি জমি রয়েছে। এসব জমির দাম ৫০ লাখ টাকার কম নয়। এ ছাড়া কোটালীপাড়ার কান্দিলাল শাপলার বিলে ১২ বিঘা জমিতে একটি মাছের ঘের রয়েছে জসীমের। এটির দামও অন্তত দেড় কোটি টাকা। ঢাকার মিরপুরের বর্ধিত পল্লবীর ৩ নম্বর রোডের এক ভবনে একটি ফ্ল্যাট রয়েছে তাঁর। এ ছাড়া পূর্বাচলে পাঁচ কাঠার একটি প্লট ও পীরেরবাগের ঝিলপাড় এলাকায় মালঞ্চ ভবনে আরও একটি ফ্ল্যাট রয়েছে।

জানা যায়, মিরপুরে এসি থাকাকালে মালঞ্চ ভবনের ফ্ল্যাটটি কিনেছিলেন। সেটিতেই থাকতেন। তবে দুই বছর আগে নতুন ভবন নির্মাণের পর ফ্ল্যাটটি ভাড়া দেন। পরিবারের জন্য রয়েছে প্রাইভেট কার। এর বাইরেও তাঁর আরও সম্পদ রয়েছে বলে জানিয়েছেন টুঙ্গিপাড়ার একাধিক বাসিন্দা।

জসীমের গ্রামের বাড়ি গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায়। তাঁর প্রয়াত বাবা লাল মিয়া পদ্মা নদী থেকে বালু তুলে নৌকায় করে বিক্রি করতেন। লাল মিয়ার বসতভিটা ও মাঠে তিন বিঘা ফসলি জমি ছিল। এলাকাবাসী জানিয়েছেন, লাল মিয়া টুঙ্গিপাড়া পৌরসভার ৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছিলেন একবার। তাঁর চার ছেলের মধ্যে জসীম উদ্দীন তৃতীয়। বাবার মুক্তিযোদ্ধা কোটায় জসীমের চাকরি হয়। তবে এলাকায় মুক্তিযুদ্ধে লাল মিয়ার অংশগ্রহণ নিয়ে রয়েছে বিতর্ক। এলাকাবাসীর অভিযোগ, লাল মিয়া মুক্তিযোদ্ধা না হয়েও সনদ নিয়েছেন। সেই সনদের সুবিধা নিয়ে চাকরিতে যোগ দেন জসীম।

টুঙ্গিপাড়া মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার শেখ জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, এই উপজেলায় ৪১৮ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা। এর মধ্যে ২২ জন ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা। এ তালিকায় লাল মিয়ার নাম আছে। তাঁর বিষয়ে অনেকেই অভিযোগ করেছিলেন। পরে তদন্ত হয়; কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

তথ্য বলছে, জসীম উদ্দীন ২৪তম বিসিএসে ২০০৫ সালে সহকারী পুলিশ সুপার হিসেবে চাকরিতে যোগ দেন। তাঁর চাকরির বেশির ভাগ সময় কেটেছে ঢাকা মহানগর পুলিশে (ডিএমপি)। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর থেকেই তিনি ডিএমপিতে চাকরি করেছেন। অবশ্য এর মধ্যে তিন বছর ঢাকার বাইরে ছিলেন। ঢাকায় চাকরি করেছেন ১২ বছরেরও বেশি সময়।

জসীম মিরপুর বিভাগের ডিসি হিসেবে আসার আগে ২০২১ সালের ২২ মে থেকে ২০২২ সালের ২৩ জুলাই পর্যন্ত লালবাগ বিভাগে একই পদে দায়িত্ব পালন করেন। এর আগে ২০২০ সালের ৮ জুলাই থেকে ২০২১ সালের ২২ মে পর্যন্ত মিরপুর ট্রাফিক বিভাগের ডিসি ছিলেন। ২০১৯ সালের ৩০ জুলাই থেকে ২০২০ সালের ৮ জুলাই পর্যন্ত তেজগাঁও ট্রাফিক বিভাগে ডিসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি মিরপুর বিভাগে সহকারী পুলিশ কমিশনার (এসি) এবং অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।

মিরপুরে চাকরি করেছেন– এমন একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা ও কনস্টেবল জানিয়েছেন, প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হয়েও চরম পর্যায়ে ‘দলকানা’ ছিলেন জসীম। প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীকে দমনপীড়নে ছিলেন অতি উৎসাহী। এমনকি আওয়ামী লীগ মতাদর্শের নয়, এমন পুলিশ সদস্য বা সিভিল স্টাফদের সঙ্গে অসদাচরণ করতেন।

বিশ্বস্ত একটি সূত্র জানিয়েছে, উপপুলিশ কমিশনার কার্যালয়ের একজন সিভিল স্টাফের রাজনৈতিক মতাদর্শ নিশ্চিত হওয়ার জন্য এক এসিকে দিয়ে তদন্ত করান। তদন্তে উঠে আসে, ওই কর্মচারীর আত্মীয়স্বজন আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ একটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত। পরে জসীম ওই কর্মচারীকে অফিসিয়াল কোনো সভায় উপস্থিত থাকতে দিতেন না।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলন চলাকালে মিরপুর এলাকায় গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে জসীমের বিরুদ্ধে। মিরপুর বিভাগের সাতটি থানা এলাকায় জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার ওপর হামলা, গুলি ও হত্যার ঘটনায় তিনি অন্তত ৩৫ মামলার আসামি। গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধে গত ৩০ অক্টোবর গ্রেপ্তার হন জসীম। ওই দিন তাঁকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়। ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বে তিন সদস্যের বিচারিক প্যানেল তাঁকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। কারাবন্দি থাকায় জসীম উদ্দীনের বক্তব্য নেয়া যায়নি।

সৌজন্যে: দৈনিক সমকাল।