বাংলা সাহিত্যে নজরুলই প্রথম রাজনৈতিক কবি। দেশাত্মবোধ ও নির্যাতিত জনগণের আপোসহীন কণ্ঠস্বরে সাংবাদিক নজরুল অদ্বিতীয়।
নজরুল ও মুজফফর আহমদের যৌথ সম্পাদনায় ‘নবযুগ’ (১৯২০) প্রকাশিত হলে সংবাদপত্রের ইতিহাসে প্রাণ বন্যার জোয়ার আসে।
নবযুগের মাধ্যমে সাংবাদিকতায় কবির হাতেখড়ি হলেও নজরুলের স্বাধীনতাকামী, অকুতোভয় লেখার সোনারকাঠির ছোঁয়ায় পত্রিকাটি তীব্র অভিঘাতের সাথে সাথে হিন্দু মুসলিম উভয় শ্রেণির কাছে অভাবিত জনপ্রিয়তা লাভ করে।
কৃষক ও মজুর শ্রেণির দাবি জনসমক্ষে তুলে ধরে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে নজরুলের অগ্নিঝরা লেখনি বিষয়ে মুজাফফর আহমদ বলেন, “নজরুলের জোরালো লেখার গুণেই নবযুগ জনপ্রিয় হয়েছিল। “
সাংবাদিক নজরুলের সত্য, সুন্দর আর কল্যাণের পথে দুঃসাহসী মনো ভঙির অতুলনীয় নিদর্শন হল’ ধূমকেতু’ পত্রিকা।
অসহযোগ আন্দোলনের কারণে সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের উদ্দীপ্ত কণ্ঠ স্তিমিত হতে থাকলে নিরাশাগ্রস্ত,আত্মবিশ্বাসহীন সন্ত্রাসবাদীদের নতুন যুগচেতনায় উদ্দীপ্ত করে তাকেই দেশের মুক্তির উপায় রূপে কবি আহবান জানান।
অন্যায়, অত্যাচার, অসত্য, অসাম্যের বিরুদ্ধে দেশবাসীকে সচেতন করতে ‘ধূমকেতু’র কণ্ঠস্বর ছিল অত্যন্ত দুর্বার, অগ্নিগর্ভ। হিন্দু মুসলমানের মধ্যে বিভেদ দূর করে তাদের মিলনের পথ অবারিতকরাই ছিলঅসাম্প্রদায়িক ‘ধূমকেতু’র মূল সুর। এতে কবি লেখেন, “সর্বপ্রথম ‘ধূমকেতু’ ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতা চায়।”
প্রথম সংখ্যা থেকে শেষ সংখ্যা পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথের, “আয় চলে আয়রে ধূমকেতু আঁধারে বাঁধ অগ্নি সেতু।” কবিতাটি আশীর্বাদ হিসাবে ছাপা হত।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, মোজাফফর আহমদ, শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়, প্রবোধচন্দ্র সেন, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তসহ খাতনামা কবি সাহিত্যিকদের লেখায় ‘ধূমকেতু ‘ছিল বৈভব- দীপ্ত ।
পাঁচটি বিশেষ সংখ্যাসহ ধূমকেতুর মোট ৩২ টি সংখ্যার মধ্যে কুড়িটি সংখ্যা ছিল নজরুল সম্পাদিত।’ধূমকেতু ‘নারী জাগরণের ক্ষেত্রেও বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখে । নজরুলের ‘আনন্দময়ীর আগমনে, কবিতা ও লীলা মিত্রের’ বিদ্রোহীর কৈফিয়ত ‘ গদ্য প্রকাশের দোষে পত্রিকার ১২ ও ১৫ সংখ্যা বাজেয়াপ্ত করা হয়। রাজদ্রোহের অভিযোগে কবি ১৯২৩ সালে এক বছরের জন্য সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন।
নজরুলের প্রবন্ধ, কবিতা প্রভৃতি ছিল অনলবর্ষী। সার্বিক দিকথেকেই ধূমকেতুর উপযোগিতা ছিল অপরিমেয়। পত্রিকাটি শীর্ষস্পর্শী জনপ্রিয়তা লাভ করে।
এরপর লেবার স্বরাজ পার্টি গঠিত হলে মণিভূষণ মুখোপাধ্যায় এর সম্পাদনায় ‘লাঙ্গল (‘১৯২৫) প্রকাশিত হয় । তিনি নামেমাত্র সম্পাদক ছিলেন। প্রকৃতপক্ষে সম্পাদনার কোন কাজই করতেন না। পত্রিকার প্রধান পরিচালক নজরুলই ছিলেন পত্রিকার প্রাণপুরুষ। এতে কবির ‘সাম্যবাদী ‘কবিতাগুচ্ছ প্রকাশিত হয় । পরবর্তীতে এর নাম হয় ‘যুগবাণী’। এতে অন্যান্য প্রবন্ধের সাথে নজরুলের সুবিখ্যাত প্রবন্ধ’ মন্দির ও মসজিদ ‘ছাপা হলে ব্যাপকভাবে আদৃত হয়।
সার্বিক দিক থেকেই সাংবাদিক নজরুলের ভূমিকা ছিল অসামান্য। বিশেষ করে’ ধূমকেতু ‘সংবাদপত্রের আকাশে প্রদীপ্ত নক্ষত্র হয়ে থাকবে।
এ প্রসঙ্গে ডক্টর সুশীলকুমার গুপ্ত বলেন, “এদেশে সাংবাদিকতার ইতিহাসে নজরুলের ভূমিকা বিস্মৃত হবার মত নয়। জনজাগরণের ক্ষেত্রে সাংবাদিকতারসূত্রে রচিত তাঁর অগ্নি -ক্ষরা রচনাবলী এক বিশেষ ঐতিহাসিক মূল্যে ঐশ্বর্যশালী। “
সহায়ক গ্রন্থ:
১. নজরুল চরিত মানস, ডক্টর সুশীল কুমার গুপ্ত।
২. প্রতিভার খেলা, হায়াৎ মামুদ।
৩. নজরুল চর্চা, নারায়ণ চৌধুরী।
৪. নজরুল সন্ধানে, শান্তিরঞ্জন ভৌমিক।
লেখিকা: জাহান আরা খাতুন, অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ, হবিগঞ্জ সরকারি মহিলা কলেজ, হবিগঞ্জ।
[প্রিয় পাঠক, পাবলিক রিঅ্যাকশনের প্রায় প্রতিটি বিভাগে আপনিও লিখতে পারেন। আপনার অনুভূতির কথা আমাদের লিখে পাঠান। ছবিসহ মেইল করুন opinion2mail@gmail.com এই ঠিকানায়। যে কোনো খবর, ভ্রমণ, আড্ডা, গল্প, স্মৃতিচারণসহ যে কোনো বিষয়ে লিখে পাঠাতে পারেন। পাঠকের লেখা আমাদের কাছে সবসময়ই গুরুত্বপূর্ণ।]