মানুষের মৌল এবং অপ্রতিরোধ্য এক অনুভূতির নাম প্রেম। শব্দটি বিচিত্রগামী অর্থাৎ বহুবর্ণ অঙ্গরাগে রঞ্জিত এবং বিস্তৃত হলেও আপাতদৃষ্টিতে নর-নারীর দুরন্ত দুর্বার হৃদয়লীলার মাঝেই এর মূর্ছনা সুধাগন্ধে হিল্লোলিয়া ওঠে। বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন চর্যাপদসহ সর্বকালের সাহিত্যভুবনে প্রেমের অবিনাশীধারা সতত বহমান। মৃত্তিকাচারী জীবনের সাথে প্রণয়লীলা নয়নের মাঝে নয়নের পাতারমতই অচ্ছেদ্য।
শিল্পসাহিত্যের বিস্তৃত অঙ্গন বিশেষ করে কবিতার নীল যমুনা প্রেমের ললিত কোমল তরঙ্গ-বিভঙ্গে উদ্বেল, সজীব,কান্ত, সুরম্য এবং হৃদয়রঞ্জক।
কবি হেলাল হাফিজের কবিতা এর বর্ণিল উদাহরণ। তাঁর প্রেম এক বিশিষ্ট জীবনচেতনা এবং রসবোধের কলনাদী নির্ঝর। তিনি প্রেমের কবি। কামনা, বাসনা, মান, অভিমান, রাগ অনুরাগের এক সৌভিক চিত্রকর। তাঁর অতলান্ত প্রেমানুভূতি, বিরহ-দগ্ধ হৃদয়ার্তির নীলপদ্ম থরে বিথরে ফুটে আছে কাব্য-সরোবরে, যা স্বকীয়তায়, মাধুর্যে, বিভাসায়, মূর্ছনায় সর্বোপরি গভীরতায় দীপ্র। এবার সে-বিষয়ে আলোকপাতের প্রয়াস।
“ভাদ্রের বর্ধিত আষাঢ়ে সখ্য হয়েছিলো-
সে প্রথম, সে আমার শেষ। ”
(সম্প্রদান)
আষাঢ়ের নিবিড় সখ্যের এই অসহ যন্ত্রণা কবিকে সারাজীবন দগ্ধীভূত করেছে। ক্ষতবিক্ষত জীবনচর্যার দহন, ক্ষরণ আর যন্ত্রণা বর্ণনায় কবি একান্তই আত্মমগ্ন, অকপট-
“একদিন
সককিছু
ছিলো তোর
ডাক নামে,
পোড়ারমুখী
তবু তোর
ভরলো না মন,
এই নে হারমজাদী একটা জীবন। ”
(সম্প্রদান)
কবির আকুল ইচ্ছেরা চিত্তহারী বর্ণ – রাগে পাখা মেলেছে। প্রেম বিহ্বল কবি আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে স্বপ্নের আল্পনা এঁকেছেন। কিন্তু হায়! আশা, কল্পনা স্বপ্ন সবকিছুই হারিয়ে গেল বিরহ মহাসিন্ধুর অতলান্ততায়। তখন ব্যথাবিষে নীলকণ্ঠ কবির অসহায় হাহাকারে বুঝি দিগন্তদেশও পরিব্যাপ্ত-
“ইচ্ছে ছিলো রাজা হবো
তোমাকে সম্রাজ্ঞী করে সাম্রাজ্য বাড়াবো,
আজ দেখি রাজ্য আছে
রাজা আছে
ইচ্ছে আছে’
শুধু তুমি অন্য ঘরে। ”
(ইচ্ছে ছিলো)
কবির প্রেম নিরন্তর অনুধ্যানের সম্পদ। চেতনার নবতরলোকে স্থিত, অবিচল, অনড়। কিন্তু পরিবর্তনশীলতার অমোঘ স্পর্শে বদলে যায় সমাজ, পরিবেশ তথা চিরচেনা পৃথিবী। তখন কবির ধ্রুব প্রেম অনিবারণ যন্ত্রণায় প্রতিনিয়ত রক্তাক্ত, সকাতর-
“মনে পড়ে একদিন জীবনের সবুজ সকালে
নদীর উল্টোজলে সাঁতার দিয়েছিলাম
….অথচ পাল্টে গেলো কতো কিছু- রাজনীতি,
সিংহাসন, সড়কের নাম, কবিতার কারুকাজ
কিশোরী হেলেন। ”
(নিখুঁত স্ট্র্যাটেজি)
দুঃখ, তাপ পতন, তথা যাবতীয় অসুন্দর আর অশান্তি থেকে একমাত্র নারীর কাছেই পাওয়া যায় উজ্জ্বল উদ্ধার। জীবনের সফেন সমুদ্রের মাঝে নারী সবুজ ঘাসের দেশ। অসহায় কবির বাঁচার একমাত্র দারুচিনি দ্বীপ, জীয়ন কাঠি, শান্তির অমল ধবল হাওয়া-
“আমাকে স্পর্শ করো,
নিবিড় স্পর্শ করো নারী।
তোমার স্পর্শেই শুরু আমার উদ্ধার।
….এতোদিন নারী ও রমণীহীন ছিলাম বলেই ছিলো
দুঃখের আরেক নাম হেলাল হাফিজ।”
(দুঃখের আরেক নাম)
সাহিত্য আলোচনায় রবীন্দ্রনাথের উক্তিটি সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ- “ভাব বিষয় তত্ত্ব সাধারণ মানুষের। তাহা একজন যদি বাহির না করে তো কালক্রমে আর একজন বাহির করিবে। কিন্তু রচনা লেখকের সম্পূর্ণ নিজের। তাহা একজনের যেমন হইবে আর একজনের তেমন হইবেনা। সেই জন্য রচনার মধ্যেই লেখক যথার্থরূপে বাঁচিয়া থাকে, ভাবের মধ্যে নহে, বিষয়ের মধ্যে নহে।” অর্থাৎ শৈল্পিক উৎকর্ষহীন রচনা রচনাই থেকে যায়, সাহিত্যের সমুন্নত মহিমা লাভের যোগ্যতা তার থাকে না। এ নিরিখেও কবি হেলাল হাফিজের প্রেম-ভাবনা বিশিষ্ট এবং নানাবিধ সাহিত্য সৌকর্যে সুরম্য। আমরা কিছু দৃষ্টান্ত চয়ন করব-
.”…বুঝবে হেলেন, এ আঙুল সহজে বাজেনা।
একদিন একটি বেহালা নিজেকে বাজাবে বলে আমার আঙুলে এসে দেখছিলো
তার বিষাদের চেয়ে বিশাল বিস্তৃতি,
আমি তাকে চলে যেতে বলিনি তবুও
ফিরে গিয়েছিলো সেই বেহালা সলাজে। ”
(নিরাশ্রয় পাঁচটি আঙুল)
এই অভিনব চিত্রকল্প রূপদক্ষতায় অনন্য। সংস্কৃত আলঙ্কারিক বলেন, “কাব্যং রসাত্মাকং বাক্যং।” অর্থাৎ, রসাত্মক বাক্যই কাব্য। সাহিত্যের নয়টি রসের (শৃঙ্গার, হাস্য, বীভৎস, করুণ, রৌদ্র, বীর, ভয়ানক, অদ্ভুত, শান্ত) অধিকাংশের গুঞ্জরণ হেলাল হাফিজের কবিতায় শোনা যায়। নর-নারীর পারস্পরিক অনুরক্তি বা আসক্তি থেকে জাত শৃঙ্গার, আদি বা মধুর রস ভরা বর্ষার কূল উপচানো নদীর মত তাঁর কবিতায় বেগবান-
“যৌবনে এই তৃষ্ণা কাতর লকলকে জিভ
এক নিশীথে কুসুম গরম তোমার মুখে
কিছু সময় ছিল বলেই সভ্য হলো….
নারী খেলার অভিজ্ঞতার প্রথম এবং পবিত্র ঋণ
তোমাকে নিয়ে কবিতা লিখে সত্যি কি তার শোধ হয়েছে?”
(হিরণবালা)
দয়িতাকে না পাওয়ার আর্তি, হাহাকার, ক্ষোভ প্রভৃতি হেলাল হাফিজের কবিতার মূল সুর। আর অসহ চিত্তদাহ থেকেই করুণ রস সতত বহমান-
“এক জীবনে কতোটা আর নষ্ট হবে,
এক মানবী কতোটাই বা কষ্ট দেবে?”
(প্রস্থান)
একসময় সুখ, দুঃখ, প্রাপ্তি, অপ্রাপ্তি, হারাবার ভয় কিছুই আর কবিকে বিচলিত করতে পারেনা-
“সবকিছু হারিয়েই সে মানুষ
হারাবার ভয় হারিয়েছে,
তারপর তীর্থ হয়েছে।”
(তীর্থ)
এই ভাবতন্ময়তার অতলেই সাহিত্যের শান্ত রসের ধারা নীরবে নিভৃতে বহমান।
সর্বজনীনতা সাহিত্য বিচারে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রবীন্দ্রনাথ বলেন, “নিজের জিনিসকে বিশ্বমানবের এবং ক্ষণকালের জিনিসকে চিরকালের করিয়া তোলা সাহিত্যের কাজ।” এ গুণে আলোচ্য কবির কবিতা অত্যন্ত বৈভব-দীপ্ত। তাঁর নিতল প্রেমানুভব, বেদনাবোধ, চিত্তদীর্ণ হাহাকার, চাওয়া পাওয়া ইত্যাদির সাথে অগণিত মানব মানবীর হৃদয় -বাণী মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। আর সর্বজনের অন্তঃগ্রাহ্য হওয়ায় এই যোগসূত্রতার মাঝে সর্বজনীনতা হাজার বসন্তের ফুলের মত ফুটে ফুটে ওঠেছে।
শৈল্পিক উৎকর্ষ বিচারে অলংকারের গুরুত্ব অপরিমেয়। অলংকার বিষয়ে বহুমানিত আচার্য্য দণ্ডী বলেন, “কাব্যের সৌন্দর্য বিধায়ক ধর্মই অলংকার। “কবি হেলাল হাফিজের প্রেমের সৌধ শব্দালংকার এবং অর্থালংকারের দীপ্তিতে কান্তিমান। যেমন_
১।” প্রেমের কষ্ট, ঘৃণার কষ্ট, নদী এবং নারীর কষ্ট।”
(ফেরিঅলা, অনুপ্রাস অলংকার)
২।” হৃষ্ট পুষ্ট কষ্ট ”
(ফেরিঅলা, সমাসোক্তি অলংকার)
যথার্থ কবিতা বিষয়ে সর্বমান্য সংজ্ঞা দিয়েছেন Coleridge”, Best words in the best order। “এ আলোকেও আলোচ্য কবির প্রেমের কবিতা শিল্প সফল এবং অত্যন্ত হৃদয়রঞ্জক-
“জন্মাবধি ভেতরে এক রঙিন পাখি কেঁদেই গেল
শুনলো না কেউ ধ্রুপদী ডাক,
চৈত্রাগুনে জ্বলে গেলো আমার বুকের গেরস্থালি
বললো না কেউ তরুণ তাপস এই নে চারু শীতল কলস।
….কেউ ডাকেনি তবু এলাম, বলতে এলাম ভালোবাসি।”
(যাতায়াত)
শব্দ চয়নের কী অপূর্ব মধুরতা!
কাব্যমালার মধ্যমণি’ ফেরিঅলা’ কবিতাটি শব্দ-প্রভা, অপরূপ লাবণ্যশ্রী, সর্বোপরি প্রেমের কাব্যমধুর উদ্ভাসে অনন্য সুন্দর। কবি এখানে নিটোল কষ্টের সর্বজনস্বীকৃত রূপকার। অকপট প্রেমের নিপুণ কারিগর-
“কষ্ট নেবে কষ্ট
লালকষ্ট, নীল কষ্ট, কাঁচাহলুদ রঙের কষ্ট,
পাথর চাপা সবুজ ঘাসের সাদা কষ্ট,
আলোর মাঝে কালোর কষ্ট….”
(ফেরিঅলা)
সবশেষে আমরা বলব, তাঁর প্রেম একান্তই মনুষ্যধর্মা। ব্যক্তিগত অনুভূতির মায়াবি অরুণিমায় ভাস্বর। কবির হৃদয়িক অনুভবের বর্ণিল উৎসারণ মানবীয় রসসিঞ্চনে রমণীয়। পাশাপাশি প্রত্যক্ষগোচর, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য, অবিরল, ক্লান্তিহীন। আর এই অপূর্বতার মাঝেই দিব্যরাগে বিভাসিত প্রেমের ধ্রুবকণ্ঠ কবি হেলাল হাফিজ।
লেখিকা: জাহান আরা খাতুন, অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ, হবিগঞ্জ সরকারি মহিলা কলেজ, হবিগঞ্জ।
[প্রিয় পাঠক, পাবলিক রিঅ্যাকশনের প্রায় প্রতিটি বিভাগে আপনিও লিখতে পারেন। আপনার অনুভূতির কথা আমাদের লিখে পাঠান। ছবিসহ মেইল করুন opinion2mail@gmail.com এই ঠিকানায়। যে কোনো খবর, ভ্রমণ, আড্ডা, গল্প, স্মৃতিচারণসহ যে কোনো বিষয়ে লিখে পাঠাতে পারেন। পাঠকের লেখা আমাদের কাছে সবসময়ই গুরুত্বপূর্ণ।]