জুলাই বিপ্লবে আ. লীগের অর্থদাতা চট্টগ্রামের জামাল উদ্দিনকে দ্রুত গ্রেপ্তার দাবী

::
প্রকাশ: ৩ সপ্তাহ আগে

চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের নাজির মোহাম্মদ জামাল উদ্দিনের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ এনে তাকে গ্রেপ্তার ও বিচার দাবিতে জেলা প্রশাসনের অফিস, আদালত ভবনসহ বিভিন্ন স্থানে পোস্টার লাগানো হয়েছে।

তবে কে বা কারা এসব পোস্টার লাগিয়েছে, তা জানা যায়নি। এ ঘটনায় জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে।

পোস্টারে জামালকে ‘জুলাই আন্দোলনের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের অর্থদাতা, দুর্নীতিবাজ, ভূমিদস্যু’ আখ্যা দিয়ে দাবি করা হয়, তিনি বিভিন্ন নামে-বেনামে সরকারি খাস জমি অবৈধভাবে লিজ নিয়েছেন।

২০০৫ সালে অফিস সহকারী ও কম্পিউটার অপারেটর হিসেবে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে যোগ দেন জামাল। তিনি চট্টগ্রামের চন্দনাইশ উপজেলার গাছবাড়িয়ার তালুকদারপাড়া গ্রামের প্রয়াত মোহাম্মদ ফয়েজ আহমদের ছেলে। প্রথমদিকে জামাল বিভিন্ন উপজেলার ভূমি অফিসে কাজ করলেও ২০১৯ সাল থেকে অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে জেলা নাজির পদে নিযুক্ত হন।

সাবেক জেলা প্রশাসক মোমিনুর রহমান, আবুল বাশার ফখরুজ্জামানসহ একাধিক ডিসির ঘনিষ্ঠ ছিলেন জামাল। এই ঘনিষ্ঠতাকে কাজে লাগিয়ে তিনি দীর্ঘদিন ধরে ডিসি অফিসের বদলি ও পদায়নে প্রভাব খাটিয়ে আসছেন। এমনকি অভিযোগ রয়েছে, এমনকি ভূমি অফিসের কর্মচারীদের বদলির ক্ষেত্রেও তার ‘অনুমতি’ ছাড়া কিছু হয় না।

ডিসিদের প্রভাব খাটিয়ে তদবির, নিয়োগ, বদলিবাণিজ্যসহ নানা অনিয়মে জড়িত তিনি।

সামান্য তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারী হয়েও কোটি কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন। সাবেক দুই জেলা প্রশাসকের (ডিসি) কাছের মানুষ ছিলেন এই জামাল। এ কারণে তার দাপটে তটস্থ থাকেন ডিসি অফিসের সকল কর্মকর্তা/কর্মচারী।

ডিসিদের প্রভাব খাটিয়ে তদবির, নিয়োগ, বদলি-বাণিজ্য, জায়গার লিজ দেওয়াসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। তার দুর্নীতির বিষয়ে অনুসন্ধান করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। সাবেক সরকারের আমলে আ’লীগের ব্যানারে অবৈধভাবে বিভিন্ন পদ-পদবী হাতিয়ে নিয়ে আঙ্গুল ফুলে কলা গাছ হয়েছে।

অনুসন্ধানে আরও বেরিয়ে এসেছে চট্টগ্রাম শহরে দেড় কোটি টাকার বেশি দামের দু’টি অ্যাপার্টমেন্ট ও বৈধ- অবৈধ ব্যবসা বাণিজ্যের নানান হাট।

অভিযোগ রয়েছে, চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে নাজির হিসেবে কর্মরত জামাল উদ্দিন। পদোন্নতি পেয়ে তিনি এ পদে যোগ দেন ২০১৯ সালে। এর আগে তিনি উপজেলা ভূমি অফিসের অফিস সহকারী ছিলেন। সে সময় নানা তদবির ও অনিয়মের মাধ্যমে অঢেল সম্পদের মালিক হয়েছেন তিনি। নাজির হওয়ার পরও একই ধরনের কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাওয়ার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। সাধারণ মানুষ তার দুর্নীতির খতিয়ান তুলে ধরতে পোস্টার ছাপিয়েছেন এবং দেয়ালে দেয়ালে লাগিয়েছেন।

চট্টগ্রাম জেলার চন্দনাইশ উপজেলার গাছবাড়িয়ার তালুকদারপাড়া গ্রামের মৃত মোহাম্মদ ফয়েজ আহমদের ছেলে জামাল। ২০০৫ সালে অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর হিসেবে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে তিনি চাকরি নেন। শুরুতে বিভিন্ন উপজেলার ভূমি অফিসে চাকরি করেন। ২০১৯ সালের ১ অক্টোবর তিনি জেলা প্রশাসনের ‘নাজির’ হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পান।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জেলা প্রশাসনের দু’জন কর্মকর্তা গণমাধ্যমকে বলেন, সাবেক দুই ডিসির আমলে জামালের একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল। নিয়োগ, বদলি-বাণিজ্য থেকে শুরু করে প্রায় সব ক্ষেত্রে তার সম্পৃক্ততা রয়েছে। বিভিন্ন উপজেলার তহশিলদারদের পছন্দমতো বদলি বাবদ মোটা অঙ্কের ঘুষও নিতেন।

পলাতক ডিসি মো. আবুল বশর ফখরুজ্জামানের সাথে অভিযুক্ত জামাল উদ্দিন।

ওই দুই কর্মকর্তা জানান, সদ্য বিদায়ী জেলা প্রশাসক আবুল বাশার মো. ফখরুজ্জামান এবং সাবেক জেলা প্রশাসক মোমিনুর রহমানের প্রভাব খাটিয়ে জামাল বিভিন্ন অনিয়ম করেছেন।

জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর জামাল তেমন একটা অফিস করছেন না। এলেও কিছু সময় থাকেন। সার্কিট হাউসে একটি রুম নিয়ে সেখান থেকে কয়েক দিন অফিস করেছেন।

জামালের সর্ব সাকুল্যে বেতন ৩০ হাজার টাকার কিছু বেশি। কিন্তু তার নামে রয়েছে কোটি টাকার সম্পদ।

গত ২ আগস্ট চট্টগ্রাম কর অঞ্চল-৪-এ জামালের আয়কর রিটার্ন প্রাপ্তি স্বীকারপত্রে দেখা যায়, তিনি আয়কর রিটার্নে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে মাত্র অর্ধকোটি টাকার সম্পদের তথ্য উল্লেখ করেছেন। তবে বাস্তবে তার সম্পদের পরিমাণ কয়েক গুণ বেশি বলে জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে। কেননা গত বছর জামাল ও তার স্ত্রীর পৌনে ১ কোটি টাকার বেশি সম্পদের তথ্য সম্পদ বিবরণীতে উল্লেখ করা হয়েছিল।

দুদক সূত্রে জানা যায়, ২০২৩ সালে দুদক জামাল ও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে একটি অনুসন্ধান শুরু করে। এ জন্য তাদের সম্পদ বিবরণী জমা দিতে বলা হয়। পরে জামাল ও তার স্ত্রীর পৌনে ১ কোটি টাকার বেশি সম্পদের তথ্য সম্পদ বিবরণীতে উল্লেখ করেন। এর মধ্যে জামালের সম্পদের পরিমাণ ৩৭ লাখ টাকা (স্থাবর ১৩ লাখ ৭৬ হাজার টাকা ও অস্থাবর ২২ লাখ ৮৬ হাজার টাকা) ও তার স্ত্রী রুনা আক্তারের প্রায় অর্ধকোটি (স্থাবর ২৭ লাখ ৮৩ হাজার ৬০০ ও অস্থাবর ২৭ লাখ ৮৩ হাজার ৬০০) টাকার সম্পদ বিবরণীতে দেখানো হয়।

তার বিষয়ে দুদকের অনুসন্ধান এখনো চলমান রয়েছে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, নগরের কোতোয়ালির কোর্ট রোডে ‘কেসি দে গ্র্যান্ড ক্যাসেল’ নামে একটি বিলাসবহুল ভবনের চতুর্থ তলায় ফোর-সি ও ফোর-ডি নামে দু’টি অ্যাপার্টমেন্টে জামাল তার পরিবার নিয়ে দীর্ঘ সময় ধরে থাকছেন। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে ৮৭ লাখ ৬৬ হাজার ৫০০ টাকায় তিনি ওই অ্যাপার্টমেন্ট দু’টি (২ হাজার ৬৫ বর্গফুট) আবাসন প্রতিষ্ঠান ডি-ডেভেলপমেন্ট লিমিটেডের কাছ থেকে কেনেন। বর্তমানে এখানকার একটি অ্যাপার্টমেন্টের মূল্য প্রতি বর্গফুট ৭ হাজার টাকা। সেই অনুযায়ী জামাল উদ্দিনের অ্যাপার্টমেন্ট দু’টির বর্তমান বাজারমূল্য দেড় কোটি টাকার বেশি। অ্যাপার্টমেন্ট দেখা, কেনা, বায়নানামা, আর্থিক লেনদেন, চুক্তি, রেজিস্ট্রিসহ সবকিছুতেই শুরু থেকে জামালের উপস্থিতি থাকলেও এটার মালিকানা তিনি ২০২২ সালে কৌশলে শ্বশুরের নামে করিয়েছেন।

আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক শ্রম ও জনশক্তি প্রতিমন্ত্রী নজরুল ইসলাম চৌধুরীর জনসভায় অভিযুক্ত জামাল উদ্দিন।

এ ছাড়া নগরের কেসি দে রোডে সোসাইটি টাওয়ারে একটি আবাসিক হোটেলের যৌথ মালিকানার ব্যবসা রয়েছে জামালের। ২০১৫ সালে তিনি ওই বিনিয়োগ করেন। হোটেল ব্যবসার চুক্তিনামাপত্রে দেখা যায়, কেসি দে রোডে সোসাইটি টাওয়ারের পঞ্চম তলায় ৫ হাজার ৪০০ বর্গফুটের আবাসিক হোটেলটিতে ২০২৫ সাল পর্যন্ত জামাল তার নিজের নামে ১২ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছিলেন। খুলশী এলাকায় বিটিভি ভবনের ভেতরে ‘লা মেনসা’ নামের একটি বিলাসবহুল রেস্টুরেন্টে স্ত্রীর নামে ব্যবসায় বিনিয়োগেরও অভিযোগ রয়েছে।

অভিযোগ অস্বীকার করে জামাল বলেন, ‘কেসি দে রোডে আমি স্ত্রী-সন্তান নিয়ে ভাড়া বাসায় থাকি। আমি সরকারি চাকরি করি, অ্যাপার্টমেন্ট কিনব কীভাবে। এ ছাড়া আমার বিরুদ্ধে অনিয়ম, নিজের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থাকাসহ যা যা অভিযোগ শুনেছেন, সেগুলো কোনোটি সত্য নয়। আমার বিরুদ্ধে যারা এসব বলছেন, তাদের আল্লাহ বিচার করবে।’ সার্কিট হাউসে অফিস করার বিষয়টিও সত্য নয় বলে দাবি করেন তিনি।

দুর্নীতির অভিযোগে ২০২৩ সালে জামাল, তার স্ত্রী রুমা আক্তার হোসেন ও তিন সন্তানের নামে সম্পদ বিবরণী চেয়ে দুদকের নোটিশের বিষয়ে অভিযুক্ত জামাল বলেন, ‘কারা পোস্টার লাগিয়েছে, তা আমি জানি না। আমার কাজে ঈর্ষান্বিত হয়ে কেউ এটা করতে পারে। পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে অনেকের বিরাগভাজন হতে হয়। তাদের কেউ ক্ষুদ্ধ হয়ে এটা করতে পারে। আমি কোনো অন্যায়ের সঙ্গে জড়িত নেই।’

দুদকের তদন্ত সম্পর্কে জানতে চাইলে জামাল বলেন, ‘এটি মীমাংসিত বিষয়। এ নিয়ে আমি কিছু বলতে চাই না।’