হবিগঞ্জে বসবাস করছেন নানা সম্প্রদায়ের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী। সমতল, পাহাড়, টিলা তথা বন-বনানীর ¯িœগ্ধতায় তাঁরা বিচিত্রমাত্রিক জীবনচর্যায় উদ্ভাসে সাংস্কৃতিক- বলয়ে যুক্ত করেছেন ভিন্নতর ব্যঞ্ছনা। অনন্য সুন্দরতা। এবার আমরা আরণ্য- সৌন্দর্যে উদ্ভাসিত কিছু পিঠা বিষয়ে আলোকপাত করব।
নানাস পিঠা, নকশি পিঠা, মূগপাকন, খেজুর পিঠা, পুলি পিঠা, চন্দ্রপুলি পিঠা ইত্যাদি। (সাঁওতাল সম্প্রদায়)
চিতই, ভাপা, পুলি, পাটিসাপটা ইত্যাদি। (ভুনার্জি সম্প্রদায়)
পয়সা, কাটা, বেণী, ক্লিপ ইত্যাদি। (রবিদাস)
অঙ্গুরি, মাল্টা, খাপড়া, লাড্ডু ইত্যাদি। (উরাং, ওরাঁও, মুন্ডা, তুরিয়া, খারিয়া, ঝরা)
সিমরুটি ইত্যাদি। (চা শ্রমিক)
ডুরি ইত্যাদি। (দেশওয়ালি বা কানু)
উটংচাক ইত্যাদি। (মনিপুরী, বিষ্ণুপ্রিয়া)
প্রস্তুতপ্রণালী-
সিমরুটি পিঠা- সিমের তরকারি রান্না করে ঠা-া হলে চালের গুঁড়া মিশিয়ে ম- তৈরি। তাওয়া বা কড়াই চুলায় বসিয়ে হালকা তেল মাখানো। চিতই পিঠারমত বানানো।
ডুরি পিঠা- মোটা দানার চালের গুঁড়া হালকা ভেজে বাদাম, চিনি, ভাজা ছোলার গুঁড়া, কিসমিস সুগন্ধি চালের ভাজা গুঁড়া ভালভাবে মিশিয়ে নিতে হবে। পরিমাণমত গুঁড়ে পানি দিয়ে ঘন আঠালো শিরা করে এতে পূর্বের মিশ্রণ দিয়ে ম- তৈরি করে নাড়–র মত আকৃতি।
উটংচাক পিঠা- বিন্নি চাল পরিমাণমত পানিসহ মুলি বাঁশের চোঙায় ঢুকিয়ে দিয়ে চোঙার মুখ বন্ধ করতে হবে। এবার নিচ থেকে অল্প আগুন দিয়ে বাঁশের চোঙা ভালভাবে পুড়িয়ে নিতে হবে। বাঁশ পুড়ে গেলে আস্তে আস্তে তা তুলে তরকারি বা ভর্তার সাথে পরিবেশন।
খাপরা পিঠা- ঢেঁকিতে করা আতপ চালের গুঁড়ার সাথে পানি মিশিয়ে মিশ্রণ তৈরি। বেশি পাতলা বা ঘন যেন না হয়। (পাটিসাপটার গোলার মত) চুলাতে কড়াই গরম হলে কলার ডোগার সাহায্যে তেল মাখিয়ে নিতে হবে। এখন ঐ পরিমান মিশ্রণ কড়াইতে দিতে হবে যাতে আকৃতিতে একটা পাতিলের মুখের সমান হয়। অর্থাৎ ঢাকনার সমান। এ পিঠা এঁটো করা যাবে না।
ওরাঁও, উরাং, সাঁওতাল, মু-া, খারিয়া, ঝরা সম্প্রদায়ে বিয়ের বর কনের গোসলের জন্য পানি সংগ্রহকরার সময় যে মাটির হাঁড়ি ব্যবহার করা হয়- খাপরা পিঠা এ হাঁড়ির ঢাকনা হিসাবে ব্যবহৃত হয়। পিঠা হাঁড়ির মুখে রেখে এমনভাবে নতুন মার্কিন কাপড় দিয়ে ঢেকে দেয়া হয় যাতে নির্ধারিত নারী পুরুষ ছাড়া অন্য কারো দৃষ্টিগোচর না হয়। এ কাজের জন্য দু’জন পবিত্র যুবতী নতুন বস্ত্র পরিধান করে। এদের সাথে যে দু’জন পুরুষ থাকে, এরা হল বর ও কনের ছোট ভাই। এরাও নতুন কাপড় পরে আর সাথে রাখে দু’টো ধারালো দা। আদিবাসী রীতি অনুসারে তখন চিত্তরঞ্জী গান, নাচ, বাজনা অনুষ্ঠানে প্রাণসঞ্চার করে। পানি আনার পর এ পিঠা প্রসাদ হিসাবে বিতরণ করা হয়।
লাড্ডু পিঠা- ঢেঁকিতে করা আতপ চালের গুঁড়া, পানি ও গোটা মরিচ এর উপকরণ।
পবিত্র তরুণীর দল নতুন ডালায় আতপ চাল নিয়ে গান গেয়ে ঢেঁকিতে গুঁড়া করে। এ গুঁড়া হাতের আঙুল ও মুঠোর সাহায্যে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে পিঠার আকৃতি দেয়। এবার পরিষ্কার হাঁড়িতে পরিমাণমত পানি দিতে হয়। পানির উপরে কিছু পোয়াল/খড় ছড়িয়ে দিয়ে আবারও খড় ছড়িয়ে দিতে হবে। অর্থাৎ দু’বার খড় বিছিয়ে দেবার পর এর উপর উপকরণ ঢেলে ঢাকনা দিয়ে সেদ্ধ করার মাধ্যমেই পিঠা বানানোর কাজ শেষ হয়।
বিয়ের আগের দিন বর- কনে উভয়পক্ষই মাড়োয়া পূজা করে। যখন কালসা গাঁথা হয়, তখন এ পিঠা নতুন ডালায় সাজিয়ে পূজাস্থলে আনা হয়। একটা নতুন মাটির কলসিতে বিশেষ প্রক্রিয়ায় ধানের শিষ লাগানোকে কালসা বলে। কালসার মাধ্যমে মাড়োয়া পূজা শুরু হয়। তখন আদিবাসী বাজনা ও সানাই বাজানো হয়, কিন্তু কোনো গান হয় না।
অন্যদিকে কালসা গাঁথার সময় বাজনারসাথে গানও থাকে। পূজা শেষে লাড্ডু প্রসাদ হিসেবে বিতরণ করা হয়। সাথে থাকে হাঁড়িয়া। এ সমস্ত পিঠার মাধ্যমে হবিগঞ্জের পিঠা- সংস্কৃতি আপন মাধুর্যে উদ্ভাসিত হওয়ার সাথেসাথে ঐতিহ্যের বর্ণোজ্জ্বল চলমানতার সাক্ষ্য বহন করে।
এসব পিঠার আলোচনায় যে সত্যটা দিবালোকের মত বিভাসিত তা হল, “সংস্কৃতির ¯্রােত প্রবাহিত হয় বিভিন্ন খাতে’ এবং এর বিকাশ ঘটে একটি জনগোষ্ঠীর দীর্ঘকালের বুদ্ধিবৃত্তিক, সামাজিক, নৈতিক, রাজনৈতিক, নান্দনিক প্রভৃতি বিচিত্র কর্মকা-ে।”
এই নান্দনিক ভুবনে পিঠা আপন বিভায় দীপ্ত।
উপযোগিতা- পিঠার উপযোগিতা ব্যাপক, বিস্তৃত এবং অবশ্যই কল্যাণকামী। এর মাধ্যমে মনন উৎকর্ষ সাধিত হয়। প্রতিফলিত হয় মানুষের সহজাত শিল্পবোধ, বর্ণজ্ঞান, হৃদয়ানুভূতি, সূক্ষ্ম সৌন্দর্যবোধ ইত্যাদি। এর মাধ্যমে মনোভূমিতে অন্ত:সলিলা ফল্গুধারার মত শোভন ও সুন্দরতা শতধারায় উৎসারিত হয়। পিঠা শিল্পীর সহজাত অনুষ্ঠান রূপে, রঙে, বর্ণে, ছন্দে, স্বাদে হিল্লোলিয়া ওঠে।
বর্তমানে অপসংস্কৃতির বিষবাষ্পে সমাজ-মানস বিক্ষত-জর্জরিত সংস্কৃতির সুস্থ চর্চার মাধ্যমে আবর্তমান বাংলার প্রাণধারা বহমান।
এই প্রাণধারাকে সতেজ, সজীব, বেগবান, সৃষ্টিশীল অর্থাৎ শেকড়মুখী মন-মনণ তৎপরতা ইত্যাদি সৃষ্টির ক্ষেত্রে বাঙালি সংস্কৃতি বর্ণিল পিঠা আপন স্বাতন্ত্র্যে, মহিমায় বিশিষ্টতাজ্ঞাপক। দক্ষতাবৃদ্ধি, সার্বিক উন্নয়ন, দেশপ্রেম, সামাজিক মূল্যবোধ, সম্প্রীতিরক্ষা তথা কল্যাণমুখি মানসগঠনে পিঠার ভূমিকা অপরিমেয়।
শেকড় থেকেই শিখরে শেকড়ের লালন, ধারণ, পরিবর্ধন, উন্নয়নে তৎপর থাকা আমাদের জাতীয় কর্তব্য। কারণ, পিঠার ঐতিহ্য আবহমানকালের হাজার বছরের সাহিত্য, লোকসাহিত্য, বর্তমান সাহিত্য এমনকি রূপকথায়ও নানাবিধ পিঠার সমাহার ঐতিহ্যের কলগুঞ্জনে মুখরিত।
পিঠার প্রদীপ্ত পথধরে আমরা আপন সংস্কৃতিকে ভালবেসে দেশপ্রেমে আরো উজ্জবিত হয়। কারণ, পিঠা এক উন্নত মানের শিল্পকর্ম। আর সত্য, সুন্দর ও কল্যাণই হল শিল্পের প্রাণ-ভোমরা।
আমাদের অন্তর-জগতে পিঠার সৌন্দর্য বিকিরিত হোক। দেশপ্রেমের মায়াবি অরুণিমা আমাদের ঋদ্ধ করুক। চিন্তা-চেতনা মধুরিমা তরঙ্গ-বিভঙ্গে হোক কল্যাণকামী।
এককথায় পিঠা-সংস্কৃতির অমিয়াধারা সিঞ্চনে আমাদের মন- মনন সমুদ্ভাসিত হোক ঐতিহ্য- গৌরবের সমুন্নত মহিমায়।
তথ্যসূত্র:
১। রূপসী বাংলা, জীবনানন্দ দাশ, বুকসফেয়ার, ঢাকা, ২০২২, পৃ. ২৫
২। শ্রীভূমি সিলেটে রবীন্দ্রনাথ, নৃপেন্দ্রলাল দাশ, উৎস প্রকাশন, ঢাকা, ২০১৯, পৃ. ২২
৩। পাহাড় টিলা হাওড় বন: হবিগঞ্জের পর্যটন, জেলা প্রশাসন, হবিগঞ্জ, ২০১৮, পৃ. ৮৬
৪। সমগ্র বাংলা সাহিত্যের পরিচয়, শ্রী পরেশচন্দ্র ভট্টাচার্য, জয়দুর্গা লাইব্রেরি, কলকাতা, ১৯৯৪, পৃ. ৫৮-৫৯
৫। জগৎজীবন দর্শন, ড. আমিনুল ইসলাম, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, ১৯৯৫, পৃ. ৪০
৬। ব্যক্তি- পৃথ্বিশ চক্রবর্তী, হ্যাপি ভৌমিক, রেনু বেগম, হরেন্দ্র ওরাং, গৌতমচন্দ্র দাশ, কামাল আহমেদ, মামুন আহমেদ।
লেখক: জাহান আরা খাতুন, অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ, হবিগঞ্জ সরকারি মহিলা কলেজ, হবিগঞ্জ।
[প্রিয় পাঠক, পাবলিক রিঅ্যাকশনের প্রায় প্রতিটি বিভাগে আপনিও লিখতে পারেন। আপনার অনুভূতির কথা আমাদের লিখে পাঠান। ছবিসহ মেইল করুন opinion2mail@gmail.com এই ঠিকানায়। যে কোনো খবর, ভ্রমণ, আড্ডা, গল্প, স্মৃতিচারণসহ যে কোনো বিষয়ে লিখে পাঠাতে পারেন। পাঠকের লেখা আমাদের কাছে সবসময়ই গুরুত্বপূর্ণ।]