গীতিকার এবং সুরকার উভয়ক্ষেত্রেই বাংলা কাব্যসংগীতের ধারায় নজরুলের অবদান অবিস্মরণীয়। অনবদ্য সৃজনশীলতা আর গবেষকের ধীশক্তির মণি কাঞ্চনযোগে সুর সৃষ্টি ও প্রয়োগেরক্ষেত্রে নজরুল সর্বাংশ সার্থক।
তাঁর সংগীতগ্রন্থের মধ্যে আছে, জুলফিকার,বুলবুল, চন্দ্রবিন্দু, বনগীতি গুলবাগিচা, গীতিশতদল, নজরুল গীতিকা ইত্যাদি।
নজরুলের সংগীতাকাশে গজল গানযে প্রদীপ্ত ধ্রুবতারা,এ বিষয়ের সূত্রধরে আমরা আরও কিছু বলার চেষ্টা করব।
বাংলা গজল এর সূত্রপাত করেছিলেন অতুল প্রসাদ। কিন্তু সেই ক্ষীণধারা নজরুল -প্রতিভার সোনার কাঠির স্পর্শে সার্বিক দিক থেকেই স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে উর্মি -মুখর সমুদ্রের ব্যাপ্তি লাভ করে ।
সমুচ্চ কাব্যগীতি গজল এর আদি নিবাস পারস্যদেশে । প্রকৃতার্থে গজল প্রেম সংগীত। পারমার্থিক ব্যঞ্জনায় দীপ্ত।
বাংলা গজল গান নজরুলের হাতেই কাব্যের হিল্লোলে, রাগের বর্ণ বি
ভঙ্গে, আবেগের স্বতঃস্ফূর্ত গুঞ্জরণে, অলংকারের দ্যুতিময়তায়, পল্লবিত, হিল্লোলিত,কুসুমিত হয়ে আছে।
শ্রেষ্ঠ পারস্য গজল মরমি ভাবধারায় স্নাত ভাব সংগীত। নজরুল খুব ভালো ফার্সি জানতেন।রুমি, হাফিজ প্রভৃতি কবিদ্বারা প্রাণিত হয়ে নজরুল বাংলা গজলকে এক অনন্য লাবণ্যশ্রী দান করেন।
পারস্য গজল কাব্যায়িত দর্শন। ভূমি থেকে ভূমায় তার উত্তরণ। এক্ষেত্রে নজরুলের গজল মানবীয় প্রেমভাবে উদ্বেল। এককথায় নজরুলের গজল ইন্দ্রিয়মেয়তায় মৃত্তিকাচারী জীবনের স্পন্দনে মুখরিত,।রোমান্টিক হৃদয়ের উল্লাস, বিস্ময়, চাওয়া, বিষাদ ইত্যাদি ইত্যাদিতে প্রাণবন্ত এবং সজীব।
পড়ুন: প্রথম অংশ: নজরুল সংগীতে চিত্তরঞ্জক অনুষঙ্গ | জাহান আরা খাতুন
” ‘বাগিচায় বুলবুলি তুই ‘নজরুলের প্রথম গজল রচনা। এটি ১৯৩৩ সালের মাঘ মাসে ‘কল্লোল’ এ আত্মপ্রকাশ করে। কিন্তু ‘আসে বসন্ত ফুল বনে’১৯৩৩ এর অগ্রহায়ণ পৌষ মাসের ‘সওগাত’ এ প্রকাশিত হয়। সেই হিসাবে এটিই নজরুলের প্রথম মুদ্রিত গজল । “
নজরুলের গজলের প্রধান সুর ভৈরবী হলেও পিলু, খাম্বাজ, সিন্ধু, কাফি, ভীমপলশ্রী, বেহাগ-খাম্বাজ, খাম্বাজ, সিন্ধু ভৈরবী, ভৈরবী আশাবরী, জৌনপুরী, মান্দ প্রভৃতি রাগে তিনি শিখরস্পর্শী শিল্পকুশলতার পরিচয় রেখেছেন।
নজরুলের কয়েকটি গজল গানের উদাহরণ’ কেন কাঁদে পরান কি বেদনায় কারে কহি,
মোরে ভালোবাসায় ভুলিও না, ‘তরুণ প্রেমিক প্রণয়বেদন জানাও জানাও বেদিল প্রিয়ায়,”তোমার আঁখির কসম সাকি’, ‘বাগিচায় বুলবুলি তুই’ ‘ কেমনে রাখি আঁখি বারি চাপিয়া, ‘ ইত্যাদি ।
নজরুলের সংগীত-ডালা বিষয় বৈচিত্র্যে সমুজ্জ্বল । তিনি অন্যান্য বিষয়ে যে সমস্ত গান লিখেছেন এর কিছু আমরা চয়ন করব।
‘১নমঃ নমঃ নমো বাংলাদেশ মম
চির মনোরম
চির মধুর ‘।
আমার শ্যামলা বরণ বাংলা মায়ের,’ একি অপরূপ রূপে মা তোমায়’ (দেশাত্মবোধক)
‘২আমি বাউল হলাম ধূলির পথে লয়ে তোমার নাম’।
‘আমি ভাই ক্ষ্যাপা বাউল আমার দেউল আমার এই আপন গেহ ‘ (বাউল)
৩অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে ‘
বিদায় সন্ধ্যা আসিল ‘
‘নিশি নিঝুম ঘুম নাহি আসে'( রাগ প্রধান)
৪
‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ ‘।
পুবাল হাওয়া পশ্চিমে যাও কাবার পথে বইয়া ‘
ত্রিভুবনের প্রিয় মুহাম্মদ ‘(ইসলামি)
৫’কেন প্রাণ ওঠে কাঁদিয়া কাঁদিয়া কাঁদিয়া’
তুমি যদি রাধা হতে শ্যাম ‘(কীর্তন)
৬’নাচেরে মোর কালো মেয়ে মৃত্যুকালী শ্যামা নাচে ‘
জাগো শ্যামা জাগো শ্যামা, ‘
জাগো যোগমায়া জাগো মৃন্ময়ী (শ্যামা সংগীত )
৭আমার ভাঙা নায়ের বইঠা ঠেলে’,
‘আমি কূল ছেড়ে চললাম ভেসে বলিস ননদীরে ‘(ভাটিয়ালি)
‘আমার খোকার মাসি, ‘
‘আমার হরি নামে রুচি কারণ পরিণামে লুচি'( হাসি) ।
কলকাতা বেতারকেন্দ্রের সংগীত বিভাগীয় কর্মকর্তা সুরেশচন্দ্র চক্রবর্তী নজরুলসংগীতের জনপ্রিয়তা লক্ষ্য করে তাঁকে কেন্দ্রে নিয়ে আসেন। সে সময় কলকাতা বেতারে ত্রিরত্নের মেলবন্ধন ঘটে। গীত রচনা ও সংযোজনে নজরুল ইসলাম, যন্ত্রসঙ্গীতে সুরেন্দ্রলাল দাস এবং পরিচালনায় সুরেশচন্দ্র চক্রবর্তী। “কবির জন্য অনুষ্ঠান ছিল তিনটি। হারামণি, নবরাগ মালিকা এবং গীতি বিচিত্রা। ”
বেতারে জনপ্রিয়তার শীর্ষে ছিল গীতিবিচিত্রা।
“গীতি বিচিত্রার অঙ্গ হিসেবে আরও একটি অনুষ্ঠান গড়ে উঠেছিল কীর্তনের সুরে। ৮০ থেকে ৯০ টি অনুষ্ঠানের জন্য কবি কমপক্ষে পাঁচশ গান রচনা করেন। পাচঁশ্ গানের মধ্যে সমসাময়িককালে যে স্বল্পসংখ্যক গান রেকর্ড করা হয়েছিল (সংখ্যা ৫০ এর উর্ধ্বে নয়) সেগুলি ছাড়া আর একটিও পাওয়া যায় না । “বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রে এটা অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়। নজরুলের সংরক্ষণী মনোভাবের অভাব, উদাসীনতাসহ নানাকারণে তাঁর অনেক মূল্যবান গান বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে গেছে, বোদ্ধাজন স্বতঃস্ফূর্ত কণ্ঠে এ কথা বলে গেছেন প্রমাণসহ ।
এ প্রসঙ্গে অনিবার্যভাবেই আসে গ্রামোফোন কোম্পানিতে নজরুলের যুক্ত হওয়ার কথা। ব্রিটিশ কোম্পানিদ্বারা নজরুল আদৃত হবেন না, এটা বলাই বাহুল্য। কিন্তু কোম্পানি যখন জানল সুবিখ্যাত গায়ক শ্রী হরেন্দ্র ঘোষ নজরুলের দুটি কবিতার অংশ বিশেষ নিজের সুরে গ্রামোফোন কোম্পানির রেকর্ডে গেয়েছেন তখন তাঁরা নিজেরাই উদ্যোগী হয়ে এ গানের প্রকৃত রচয়িতা খুঁজে বের করলেন। কোম্পানির কর্মকর্তারা খুশি হয়ে রয়্যালটির পাওনা কয়েকশো টাকা নজরুলকে প্রদান করেন। নজরুলের জীবনে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হল। চুক্তিবদ্ধ হলেন কোম্পানির সাথে।
কবিবন্ধু নলিনীকান্ত সরকার যার নামকরণ করেছেন, ‘নজরুল দোহন’। সে সময় টাকা পেতেন রবীন্দ্রনাথ, অতুলপ্রসাদ, দ্বিজেন্দ্রলাল রায় আর নজরুল।
তাঁর সংগীতের মধুরিমা উৎসারে মঞ্চ, সিনেমাও সমৃদ্ধ হয়।’ ধ্রুব ‘চিত্রের সংগীত পরিচালনাসহ রবীন্দ্রনাথের ‘গোরা’ চিত্রেরও সংগীত পরিচালনার দায়িত্ব পালন করেন। ধ্রুব চিত্রের তিনটি গান নজরুল গেয়েছেন একক কণ্ঠে।
সাংগীতিক পরিমণ্ডলে নজরুলের অসাধারণ ধীশক্তির আরও একটি উদাহরণ হল, তিনি যেসব রাগ সৃষ্টি করেছেন সেসব রাগে গান রচনা করে গানের ভেতর রাগরূপটি প্রতিফলিত করেছিলেন।রাগে গ্রথিত গানে রাগের নামটিও যুক্তকরা সুতীব্র সৃজনশীলতা, মেধাশক্তির আশ্চর্য সম্মিলনে চমকপ্রদ, অনুপম এবং মূল্যবান। যেমন, ‘সাথী হারা ভৈরব কাঁদে( উদাসী
ভৈরব রাগ) ‘বনকুন্তল এলায়ে'(বনকুন্তলা রাগ)
‘শুনোও সন্ধ্যা মালতী ‘(সন্ধ্যামালতী রাগ), ‘দোলনচাঁপা বনে দোলে’ (দোলনচাঁপা রাগ) ইত্যাদি।
বস্তুত, বাংলা কাব্য সংগীতেরধারায় নজরুলের স্বকীয়তা চিরোজ্জ্বল। যুগে যুগে কালে কালে এর মাধুর্য শিল্পের আসরে বেঁচে থাকবে হিরণ্ময় বর্ণ – বিভাসায়।
তথ্যসূত্র নজরুল গীতি প্রসঙ্গ, করুণাময় গোস্বামী। নজরুলগীতি অখণ্ড, আব্দুল আজিজ আল আমান। বাংলা সংস্কৃতির শতবর্ষ, সম্পাদনা পরিষদ। নজরুল চরিত মানস,ডক্টর সুশীল কুমার গুপ্ত।
লেখক: জাহান আরা খাতুন, অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ, হবিগঞ্জ সরকারি মহিলা কলেজ, হবিগঞ্জ।
[প্রিয় পাঠক, পাবলিক রিঅ্যাকশনের প্রায় প্রতিটি বিভাগে আপনিও লিখতে পারেন। আপনার অনুভূতির কথা আমাদের লিখে পাঠান। ছবিসহ মেইল করুন opinion2mail@gmail.com এই ঠিকানায়। যে কোনো খবর, ভ্রমণ, আড্ডা, গল্প, স্মৃতিচারণসহ যে কোনো বিষয়ে লিখে পাঠাতে পারেন। পাঠকের লেখা আমাদের কাছে সবসময়ই গুরুত্বপূর্ণ।]