সাম্প্রতিক সময়ে চট্টগ্রাম নগরী, উত্তর চট্টগ্রাম ও দক্ষিণ চট্টগ্রামে মশার প্রকোপ উদ্বেগজনক হারে বেড়ে গেছে। শহরকেন্দ্রিক ডেঙ্গু সংকট আগেও ছিল, কিন্তু এখন গ্রামীণ এলাকাগুলোতেও মশাবাহিত রোগ ছড়িয়ে পড়ছে। জলবায়ুর পরিবর্তন, অপরিকল্পিত নগরায়ন, জলাবদ্ধতা এবং প্রশাসনিক উদাসীনতার কারণে এই সংকট দিন দিন ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে।
বিশেষ করে চট্টগ্রাম মহানগরীর বিভিন্ন ওয়ার্ড, উত্তর চট্টগ্রামের রাউজান, হাটহাজারী, ফটিকছড়ি এবং দক্ষিণ চট্টগ্রামের বাঁশখালী, আনোয়ারা, পটিয়া ও সাতকানিয়া—এসব এলাকায় মশার উৎপাত মাত্রাভিত্তিক বেড়ে গেছে। এডিস, কিউলেক্স ও অ্যানোফিলিস মশার আধিপত্যে সাধারণ মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে।
কেন চট্টগ্রামে মশার প্রকোপ বেড়েছে?
১. জলাবদ্ধতা ও অপরিকল্পিত নগরায়ন: চট্টগ্রাম নগরী দীর্ঘদিন ধরেই জলাবদ্ধতার সমস্যায় জর্জরিত। ড্রেনেজ ব্যবস্থা অপ্রতুল ও অপরিকল্পিত। কৃত্রিম জলাবদ্ধতার কারণে মশার বংশবৃদ্ধির জন্য আদর্শ পরিবেশ তৈরি হচ্ছে। নগরীর অধিকাংশ অঞ্চলে নর্দমার অবস্থা অত্যন্ত খারাপ, যা মশার প্রজনন ক্ষেত্র হিসেবে কাজ করছে। এছাড়া, নগরায়ন ও বর্ধিত জনসংখ্যার কারণে ফ্ল্যাট ও মাল্টি-স্টোরি ভবনের পাশাপাশি সাধারণ বাড়ির আশপাশে অপরিকল্পিত পানি জমা থাকার ফলে মশার আধিপত্য বেড়েছে।
২. গ্রামীণ অঞ্চলে মশক নিয়ন্ত্রণের অভাব: উত্তর ও দক্ষিণ চট্টগ্রামের বেশিরভাগ এলাকায় মশক নিয়ন্ত্রণের কার্যক্রম নেই বললেই চলে। নগরীতে যেসব মশা নিধনের কার্যক্রম নেওয়া হয়, সেগুলো গ্রামে কার্যকর হয় না। ফলে সেখানকার জনগণও এখন মশাবাহিত রোগের ঝুঁকিতে রয়েছে। জলাশয়, খাল-বিল, পুকুর ইত্যাদি এলাকাগুলোর পানির ওপর গাছপালা, আবর্জনা জমে থাকার কারণে মশার প্রজনন খুব সহজে হয়। গ্রামাঞ্চলের এসব এলাকাগুলোতে প্রচুর পরিমাণে মশার প্রজনন ঘটছে, যা স্থানীয় স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়াচ্ছে।
৩. পাহাড়ি ও উপকূলীয় এলাকার ঝুঁকি: উত্তর চট্টগ্রামের কিছু অংশে (ফটিকছড়ি, রাঙ্গুনিয়া, হাটহাজারী) পাহাড়ি এলাকা রয়েছে। এসব অঞ্চলে মশার জন্য উপযোগী পরিবেশ তৈরি হয়েছে, যেখানে জলাবদ্ধতা ও বনজ পরিবেশ মশার বিস্তার বাড়াচ্ছে। অন্যদিকে, দক্ষিণ চট্টগ্রামের উপকূলীয় এলাকাগুলোতে লবণাক্ত পানির কারণে নতুন ধরনের মশার বিস্তার হচ্ছে। সেখানকার উঁচু নিচু ভূখণ্ড, স্যাঁতসেঁতে পরিবেশ, এবং বৃষ্টি প্রাকৃতিকভাবে মশার জন্য আদর্শ পরিবেশ তৈরি করছে।
৪. পরিবেশগত ও জলবায়ু পরিবর্তন: জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে চট্টগ্রামে তাপমাত্রার পরিবর্তন ঘটছে, যা মশার প্রজনন বাড়াচ্ছে। অধিক তাপমাত্রা এবং অনিয়মিত বৃষ্টিপাত মশার বংশবৃদ্ধির জন্য উপযোগী পরিবেশ তৈরি করছে। তাছাড়া, নদী এবং জলাশয়ের পানি জমে থাকা এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক পরিবেশের পরিবর্তন মশার বিস্তারকে আরো ত্বরান্বিত করছে।
মশাবাহিত রোগের আশঙ্কা: ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া: ডেঙ্গু এবং চিকুনগুনিয়া এখন চট্টগ্রামের অন্যতম স্বাস্থ্যঝুঁকি। শহরসহ উত্তর ও দক্ষিণ চট্টগ্রামের গ্রামীণ এলাকাগুলোতে মশাবাহিত রোগে আক্রান্তের সংখ্যা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। ডেঙ্গু বিশেষত শহরের এলাকার একটি বড় সমস্যা হলেও, এখন গ্রামাঞ্চলও এর প্রভাব থেকে রক্ষা পাচ্ছে না।
ম্যালেরিয়া ও ফাইলেরিয়াসিস: পাহাড়ি অঞ্চলে ম্যালেরিয়ার প্রকোপ এখনও বিরাজমান। মশার কারণে ম্যালেরিয়া, ফাইলেরিয়াসিসসহ অন্যান্য রোগ ছড়িয়ে পড়ছে, যা জনগণের স্বাস্থ্যের জন্য বড় ঝুঁকি তৈরি করছে। বিশেষ করে ভ্রমণকারী ও শ্রমিক শ্রেণি এর মধ্যে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে।
১. নগরীতে নিয়মিত ও কার্যকর মশক নিধন কর্মসূচি পরিচালনা করা; চট্টগ্রাম নগরীসহ গ্রামীণ ও পাহাড়ি অঞ্চলে নিয়মিত মশক নিধন কার্যক্রম চালু করা জরুরি। মশার প্রজননস্থলগুলোর মধ্যে ড্রেনেজ ব্যবস্থা, জলাশয় এবং নর্দমাগুলোর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিত করতে হবে।
২. উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে মশার ওষুধ ছিটানোর কার্যক্রম শুরু করা: গ্রামাঞ্চলে মশার উত্থান রোধ করতে হবে। এজন্য প্রতিটি উপজেলায় নিয়মিত মশক নিধন কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। বিশেষত, মশার প্রজননস্থলে জীবাণুনাশক স্প্রে ও জলাশয় পরিষ্কারের ব্যবস্থা নিতে হবে।
৩. জলাবদ্ধতা নিরসনে চট্টগ্রামের ড্রেনেজ ব্যবস্থা উন্নত করা: নগরী ও গ্রামাঞ্চলে জলাবদ্ধতা দূর করার জন্য আধুনিক ড্রেনেজ ব্যবস্থা চালু করতে হবে। নিয়মিত ড্রেন পরিষ্কার রাখতে হবে এবং পানি জমে থাকার স্থান চিহ্নিত করে দ্রুত নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করতে হবে।
৪. স্বাস্থ্যসেবা বৃদ্ধি ও সচেতনতা কার্যক্রম: মশাবাহিত রোগের ব্যাপারে জনগণের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে হবে। স্কুল, কলেজ, মসজিদ, মন্দিরসহ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করা উচিত। একসঙ্গে, বিনামূল্যে ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া ও চিকুনগুনিয়া পরীক্ষার ব্যবস্থা চালু করতে হবে।
৫. পাহাড়ি ও উপকূলীয় এলাকায় বিশেষ গবেষণা ও মশা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম চালু করা: পাহাড়ি ও উপকূলীয় অঞ্চলে বিশেষ মশক নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। নতুন ধরনের মশার বিস্তার ঠেকাতে সেখানে বিশেষ গবেষণা চালানো প্রয়োজন।
চট্টগ্রাম মহানগরীসহ উত্তর ও দক্ষিণ চট্টগ্রামে মশার প্রকোপ এখন ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। এটি কেবল একটি সাময়িক সমস্যা নয়, বরং দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্য সংকটের ইঙ্গিত দিচ্ছে। তাই এখনই প্রশাসনের উচিত জরুরি ভিত্তিতে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা, যাতে নগর ও গ্রাম উভয় জায়গার মানুষ নিরাপদে থাকতে পারে।
লেখক: মোহাম্মদ ছৈয়দুল আলম, সাংবাদিক ও গবেষক।
লেখকের অন্যান্য লেখা:
শবে বরাত: রহমত, মাগফিরাত ও আত্মশুদ্ধির মহিমান্বিত রাত
বসন্ত উৎসব, বইমেলা ও ভালোবাসার দিন, একই দিনে তিন উৎসব
দৈনিক পূর্বকোণ: চার দশকের নির্ভীক পথচলা ও নামকরণের গল্প
ভোটার তালিকা হালনাগাদ: দায়সারা উদ্যোগে গণতন্ত্র ও আইনগত প্রশ্ন
তৈলারদ্বীপ সেতু টোলমুক্ত প্রসঙ্গ | মোহাম্মদ ছৈয়দুল আলম
বাঁশখালীর খাল ও ছড়াগুলো মুক্ত করা জরুরি | মোহাম্মদ ছৈয়দুল আলম
হোল্ডিং নাম্বার ও ট্যাক্স আদায়ের নামে বাণিজ্য বন্ধ করুন
[প্রিয় পাঠক, পাবলিক রিঅ্যাকশনের প্রায় প্রতিটি বিভাগে আপনিও লিখতে পারেন। আপনার অনুভূতির কথা আমাদের লিখে পাঠান। ছবিসহ মেইল করুন opinion2mail@gmail.com এই ঠিকানায়। যে কোনো খবর, ভ্রমণ, আড্ডা, গল্প, স্মৃতিচারণসহ যে কোনো বিষয়ে লিখে পাঠাতে পারেন। পাঠকের লেখা আমাদের কাছে সবসময়ই গুরুত্বপূর্ণ।]