সারা দেশে রাসেল ভাইপার সাপের উপদ্রব বেড়েছে। বিশেষ করে চরাঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে দেখা দিয়েছে এই সাপের আনাগোনা। অনেকেই মারা গেছেন এর দংশনে। সেইসঙ্গে এর প্রতিষেধক না থাকায় সবার মাঝেই আতংক বিরাজ করছে।
তাই মানুষের জীবন রক্ষার্থে এই প্রাণঘাতী রাসেলস ভাইপার মারলে স্থানীয় ভাবে ৫০ হাজার টাকা পুরস্কার দেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।
বৃহস্পতিবার (২০ জুন) সন্ধ্যায় জেলা আওয়ামী লীগের এক সভায় জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহ্ মো. ইশতিয়াক আরিফ তার বক্তব্যের এক পর্যায়ে রাসেলস ভাইপার সাপ নিয়ে এ পুরস্কার দেওয়ার ঘোষণা দেন।
সাধারণ সম্পাদক তার বক্তব্যে বলেন, ফরিদপুরে বিভিন্ন স্থানে বিশেষ করে চরাঞ্চলে প্রাণঘাতী রাসেলস ভাইপার সাপের আনাগোনা দেখা দিয়েছে। সাপের ভয়ে ক্ষেতে কাজ করতে যাচ্ছে না শ্রমিকরা। সবার মাঝেই আতঙ্ক বিরাজ করছে। ফরিদপুর কোতয়ালী এলাকায় কেউ যদি রাসেলস ভাইপার সাপ মারতে পারেন তাহলে তাকে ৫০ হাজার টাকা পুরস্কার দেওয়া হবে। এই সাপ থেকে মানুষকে রক্ষা করার চেষ্টা করি আমরা। এ কারণেই এ ঘোষণা দেওয়া হলো। যত জন যে কয়টি সাপ মারতে পারবে প্রত্যেককে সাপ প্রতি ৫০ হাজার টাকা পুরস্কার দেওয়া হবে।
রাসেলস ভাইপার সাপ চিনবেন যেভাবে:
বাংলাদেশের অত্যন্ত বিষধর সাপের মধ্যে একটি রাসেলস ভাইপার। এটি ‘চন্দ্রবোড়া’ নামেও পরিচিত। সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন জেলায় ভয়ঙ্কর এই সাপের উপদ্রব বেড়েছে উদ্বেগজনকহারে। বিশেষ করে পদ্মা তীরবর্তী কয়েকটি জেলা ও চরাঞ্চলের মানুষ এই সাপের ছোবলে আক্রান্ত হচ্ছেন।
রাসেলস ভাইপারের কামড়ে ৯০ শতাংশ রোগী মারা যাচ্ছেন বলে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন। বিষধর এই সাপটি চিনতে না পারায় চিকিৎসা নিতে দেরি করায় মৃত্যর ঘটনা বাড়ছে। শুধু বাংলাদেশে নয়, পুরো বিশ্বে প্রতি বছর সাপের কামড়ে যত মানুষ মারা যায়, তার উল্লেখযোগ্য একটি অংশ কেবল এ সাপের কামড়েই মারা যায়। ‘কিলিং মেশিন’ বিশ্বজুড়ে রাসেলস ভাইপারের দুর্নাম রয়েছে।
ভারতের মোদিনীপুর বিষয়ক ওয়েবসাইট মিডনাপুর ডট ইন-এর বন্যপ্রাণী বিষয়ক উপদেষ্টা রাকেশ সিংহ দেব বিস্তারিত একটি নিবন্ধ প্রকাশ করেছেন এ সাপের ওপর। সাপটির শনাক্তের বিষয়ে তিনি জানিয়েছেন, রাসেলস ভাইবার সাপের দেহ মোটাসোটা, লেজ ছোট ও সরু হয়ে থাকে। মাথা চ্যাপ্টা ত্রিকোণাকার। মাথার তুলনায় ঘাড় অনেকটাই সরু। শরীরের রঙ বাদামি, হলদে বাদামি অর্থাৎ কাঠ রঙের হওয়ায় শুকনো পাতার মধ্যে এই সাপ নিজেকে লুকিয়ে রাখতে পারে। সাপটির জিহ্বার রঙ বাদামি বা কালো। সারা গায়ে স্পষ্ট বড়ো গাঢ় বাদামি গোলগোল দাগ থাকে, এই দাগগুলোর মাথা ছুঁচালো। অনেকসময় দাগগুলো একসঙ্গে দেখতে শিকলের মতো লাগে। গোলাকার দাগগুলো দেখতে অনেকটাই চাঁদের মতো। দাগগুলোর চারপাশে কালো রঙের বর্ডার থাকে, তার মধ্যে সাদা বা হলুদের ছিটে লক্ষ্য করা যায়। পেটের দিকের আঁশ এর রঙ সাদা। এদের বিষদাঁত লম্বা। বিষদাঁতের দৈর্ঘ্য প্রায় ১৫-১৬ মিমি পর্যন্ত হয়ে থাকে। রাসেলস ভাইপারের বিষদাঁত পৃথিবীতে দ্বিতীয় সবচেয়ে বৃহৎ দাঁত।
গায়ের রঙ এবং প্যাটার্নের মিল থাকায় অনেকেই বিষহীন বালুবোড়া সাপের সঙ্গে বিষাক্ত রাসেলস ভাইবারকে গুলিয়ে ফেলেন। এছাড়া অনেকে ছোট অজগর ভেবে ভুল করেন। কিন্তু ভালো করে পর্যালোচনা করলে সহজেই সাপ দুটোর মধ্যে পার্থক্য করা যায়।
সাধারণত সব সাপ মানুষকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করে, কিন্তু রাসেলস ভাইপার সাপের স্বভাব ঠিক উল্টো। এরা সচরাচর পালিয়ে যায় না। নিজেদের বিপন্ন মনে করলে আক্রমণ করে বসে। বিষধর সাপ হিসেবে পৃথিবীতে রাসেলস ভাইপারের অবস্থান পঞ্চম। কিন্তু হিংস্রতা আর আক্রমণের দিক থেকে এর অবস্থান প্রথম। আক্রমণের ক্ষেত্রে এই সাপ এত ক্ষিপ্র যে, ১ সেকেন্ডের ১৬ ভাগের ১ ভাগ সময়ের ভেতরে কামড়ের সম্পূর্ণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে পারে। এরা প্রচণ্ড জোরে হিস হিস শব্দ করতে পারে।
২০১৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল লাইব্রেরি অব মেডিসিন-এ প্রকাশিত একটি গবেষণায় বলা হয়েছে, রাসেলস ভাইবার সাপের কামড়ের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া তাৎক্ষণিকভাবে কিংবা কয়েক ঘণ্টা পরে শুরু হতে পারে। প্রতিক্রিয়া শুরু হওয়ার বিষয়টি কামড়ের গভীরতা, বিষের মাত্রা, সাপের দৈর্ঘ্য ও বয়সের ওপর নির্ভর করে।
মিডনাপুর ডট ইন-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাসেল ভাইবার সাপের কামড়ে তীব্র জ্বালাযন্ত্রণা শুরু হয়। কামড়ের জায়গা দ্রুত ফুলতে থাকে, দংশনের স্থান থেকে চুঁইয়ে রক্ত বের হতে পারে। চোখের কোণ, দাঁতের মাড়ি, নাক বা যে কোনো কাটা অংশ থেকে, থুতুর সঙ্গে, বমি, প্রস্রাব বা পায়খানার সঙ্গে রক্ত আসতে পারে। চোখ লাল হয়ে যায়, কোমরের দিকে ও পাঁজরের নিচের দিকে ব্যথা শুরু হয়। সারা শরীর বিশেষ করে পা ফুলতে থাকে।
রাসেলস ভাইপার সাপের বিষ তীব্র রক্তধ্বংসকারী বা হোমটক্সিন প্রকৃতির। এই বিষে শরীরের রক্ত জমাট বাঁধতে শুরু করে। ফলে ফুসফুস বা কিডনি বিকলের কারণে রোগী মারা যেতে পারে। উপযুক্ত চিকিৎসা না করালে কামড়ের একদিন থেকে ১৪ দিনের মধ্যেও রোগীর মৃত্যু হতে পারে।
সাপে কামড়ালে আতঙ্কিত না হয়ে শান্ত থাকতে হবে। যে জায়গা কামড়েছে, সেই জায়গা খুব বেশি নড়াচড়া করানো যাবে না। সাপে কামড়ানোর পর প্রথম ১০০ মিনিট খুব গুরুত্বপূর্ণ। ওই সময়ের মধ্যে সঠিক চিকিৎসা দেওয়া গেলে রোগী সুস্থ হয়ে উঠতে পারেন। যেহেতু রাসেলস ভাইপার সাপের কামড়ে রোগীর কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, তাই রোগীকে এমন হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া উচিত যেখানে ডায়ালাইসিসের সুব্যবস্থা রয়েছে।