রাজস্ব আয়ে টেসলাকে ছাড়াল চীনের বিওয়াইডি

:: পাবলিক রিঅ্যাকশন ডেস্ক | পাবলিকরিঅ্যাকশন.নেট
প্রকাশ: ৩ মাস আগে

চীনের বৈদ্যুতিক গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান বিওয়াইডি প্রথমবারের মতো হারিয়ে দিয়েছে মার্কিন বিদ্যুৎ চালিত গাড়ি (ইভি) কোম্পানি টেসলাকে। গত তিন মাসের আয়ে ইলন মাস্কের কোম্পানিকে পেছনে ফেলেছে চীনা ইভি নির্মাতা প্রতিষ্ঠানটি।

চলতি বছরের তৃতীয় প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) বিওয়াইডি ২০ হাজার ১১০ কোটি ইউয়ান বা ২ হাজার ৮২৪ কোটি ডলার আয় করেছে, যা ২০২৩ সালের একই সময়ের তুলনায় ২৪ শতাংশ বেশি।

এই সময়ে টেসলার রাজস্ব আয় ছিল ২ হাজার ৫২০ কোটি ডলার।

গবেষণা বলছে, ২০২৭ সাল পর্যন্ত বিশ্বের ব্যাটারি চালিত বৈদ্যুতিক গাড়ির বাজারের ৫০ শতাংশ দখলে থাকবে চীনের।

চীনের বাণিজ্যিক মেগাসিটি শেনজেনে ১৯৯৫ সালে পথচলা শুরু হওয়া বিওয়াইডির। প্রচারবিমুখ এক প্রকৌশলী ওয়াং চনফুর হাত ধরে। ব্যক্তি ও ব্যবসায়ী জীবনে লো প্রোফাইল বজায় রাখা এই উদ্যোক্তার নেতৃত্বে এখনও পরিচালিত হচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি।

মজার ব্যাপার হলো কোম্পানির নাম বিওয়াইডি হলেও এই নামের নাকি কোন বিশেষ অর্থই নেই। এ ধরনের নামকরণের ব্যাপারে কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা ওয়াং এই ধরনের অদ্ভূত নাম বেছে নেয়ার কারণ হিসেবে বলেন, তিনি চেয়েছিলেন অন্যান্য স্টার্টআপের মধ্যে তার কোম্পানির নামকে আলাদাভাবে পরিচিত করাতে।

বর্তমানে এই অর্থহীন শিরোনামের কোম্পানিটিই পরিণত হয়েছে চীনের শীর্ষ বৈদ্যুতিক যান বা ইভি নির্মাতা, যারা ইউরোপ, দক্ষিণ আমেরিকা, দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যসহ সারা বিশ্বজুড়ে বৈদ্যুতিক ট্যাক্সি, বাস ও অন্যান্য যানবাহন রফতানি করে চলেছে। কোম্পানিটি টেসলার মতো শুধু সম্পূর্ণ বৈদ্যুতিক গাড়িই বিক্রিই করে না, একই সঙ্গে জ্বালানি সাশ্রয়ী প্লাগ ইন হাইব্রিড বা মিশ্র বৈদ্যুতিক গাড়িও তৈরি করে।

বৈদেশিক বাজারগুলোর মধ্যে ইসরাইল ও থাইল্যান্ডের বৈদ্যুতিক গাড়ির বাজারে বর্তমানে শীর্ষে অবস্থান করছে বিওয়াইডি। বিওয়াইডির সবচেয়ে জনপ্রিয় মডেলের গাড়িগুলোর মধ্যে রযেছে কিন ও সং মডেলের গাড়িগুলো। এর মধ্যে কিন মডেলের গাড়িগুলো সম্পূর্ণ বৈদ্যুতিক ও প্লাগ ইন হাইব্রিড এই দুই মডেলেই পাওয়া যায়।

 

দামে টেক্কা দিয়েই বাজিমাত বিওয়াইডির
অন্যান্য চীনা প্রযুক্তি পণ্যর মতই পশ্চিমা প্রতিদ্বন্দ্বী কোম্পানিগুলোর তুলনায় বিওয়াইডির তৈরি করা গাড়িগুলো অনেকটাই সস্তা। বিশেষ করে টেসলার তুলনায় বিওয়াইডির গাড়ি অনেক সাশ্রয়ী। পাশাপাশি দামে সস্তা হওয়ার কারণে মধ্যবিত্তরা সহজেই এই গাড়িগুলো কিনতে সক্ষম হন।

ফলে বিস্তৃত গ্রাহকশ্রেণীর কাছে রয়েছে এর আকর্ষণ। যেমন চীনে বিওয়াইডির গাড়িগুলোর দাম শুরু হয় মাত্র ১০ হাজার ডলার থেকে। অথচ টেসলার সবচেয়ে সস্তা গাড়িগুলোর দামও শুরু হয় ৩২ হাজার ডলার থেকে।

শূন্য থেকে যেভাবে বিওয়াইডিকে শীর্ষে তুললেন ওয়াং
নব্বইয়ের দশকে শেনজেনে অবস্থিত একটি চীনের রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত ব্যাটারি নির্মাতা প্রতিষ্ঠানে প্রকৌশলী হিসেবে চাকরি করতেন বিওয়াইডির প্রতিষ্ঠাতা ওয়াং। সে সময় অন্যান্য এশীয় দেশগুলোর মতোই চীনেও সরকারি চাকরিকেই নিশ্চিত ও নিরাপদ পেশাজীবন হিসেবে মনে করা হতো।

সরকারি চাকরি একবার পেলে সাধারণত ছাড়ার কথা ভাবতেন না কেউ। তবে ওয়াং ছিলেন ব্যতিক্রমী। কিছুদিন কাজ করার পরই চাকরি ছেড়ে খুলে বসলেন বিওয়াইডি। তবে যে সময়ে তিনি কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সে সময়কার চীনা সরকারের অর্থনৈতিক উদারীকরণ নীতিও অনুকূলে যায় ওয়াং এর ব্যবসা পরিচালনার পক্ষে।

চীনের প্রয়াত নেতা দেং শিয়া পিং তখন দেশের প্রথম বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন শেনজেনে। চীনা সরকারের ব্যবসা বান্ধব উদার নীতি এবং সস্তা শ্রম ও জমি, উৎপাদন ব্যবসার জঙ্গে জড়িত হাজার হাজার কোম্পানিকে আকর্ষণ করে এই অর্থনৈতিক অঞ্চল।

এ রকমই একটি সময়ে ১৯৯৭ সালে ওয়াং-এর প্রতিষ্ঠিত বিওয়াইডি একটি সাধারণ ক্ষুদ্র ওয়ার্কশপ থেকে মাঝারি আকৃতির মোবাইল ফোনের ব্যাটারি নির্মাতা প্রতিষ্ঠানে পরিণত হতে সক্ষম হয়। যার বার্ষিক টার্নওভার ছিলো দশ কোটি ইউয়ান বা ১ কোটি ৪০ লাখ ডলার।

সে সময় আর একটি ঘটনাও আশির্বাদ হয়ে দাঁড়ায় ওয়াং এর জন্য। নব্বই এর দশকের শেষের দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় দেখা দেয় ভয়াবহ অর্থনৈতিক সঙ্কট। যার ধাক্কায় বন্ধ হয়ে যায় ওয়াং এর প্রতিদ্বন্দ্বী অনেক মোবাইল ফোন ব্যাটারি নির্মাতা প্রতিষ্ঠানই।

তবে তুলনামূলক সস্তায় উৎপাদন করতে সমর্থ হওয়ায় সে ধাক্কা সামাল দিতে সফল হয় বিওয়াইডি। এর পর থেকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি ওয়াংকে। দ্রুত উন্নতি করতে থাকে বিওয়াইডি। ২০০৩ সালের মধ্যেই বিওয়াইডি পরিণত হয় বিশ্বের সর্ববৃহৎ নিকেল ক্যাডমিয়াম ব্যাটারি নির্মাতায়। সে সময়কার মোবাইল ফোনগুলোতে মূলত এই নিকেল ক্যাডমিয়াম ব্যাটারিই সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হতো।

 

ইভিতেই ভবিষ্যত দেখেছিলেন বিওয়াইডির প্রতিষ্ঠাতা
তবে এই সাফল্যেই সন্তুষ্ট ছিলেন না ওয়াং। দূরদর্শী ব্যবসায়ী হিসেবে তিনি সে সময়ই বুঝেছিলেন ভবিষ্যতে বৈদ্যুতিক যানবাহনের সম্ভাবনার কথা। তাই ২০০৩ সালে যখন তার সামনে শিয়ান নগরীকে অবস্থিত চীনের সরকার নিয়ন্ত্রিত একটি গাড়ি নির্মাণ প্লান্টকে সস্তায় কিনে নেয়ার সুযোগ এলো, তখন আর কালবিলম্ব না করে ৩ কোটি ৮০ লাখ ডলারে সেই প্লান্টকে কিনে নেন তিনি।

অবশ্য ওয়াং এর এই দূরদর্শিতার সঙ্গে সে সময় একমত হতে পারেননি তার কোম্পানির অনেক বিনিয়োগকারীই। যার ফলে হংকং স্টক এক্সচেঞ্জে নিবন্ধিত বিওয়াইডির শেয়ারের দাম পড়ে যায় ২১ শতাংশ।

অবশ্য এসব হতাশা স্পর্শ করেনি ওয়াংকে। নিজের সিদ্ধান্তে তিনি ছিলেন অবিচল। শেয়ারের দাম পড়ে যাওয়ার পর তিনি বলেছিলেন, আমি গাড়ি নির্মাণ করছি কারণ বৈদ্যুতিক গাড়ির ভবিষ্যতের ব্যাপারে আমি আশাবাদী।

ওয়ারেন বাফেটের বিনিয়োগে ভাগ্য খোলে বিওয়াইডির
ভাগ্য সাহসীদের সহায় হয় এই প্রবাদের যথার্থতা প্রমাণ করতেই যেন এর ঠিক ৫ বছরের মাথায় বিশ্বের খ্যাতনামা বিনিয়োগকারী ও অন্যতম শীর্ষ ধনী ওয়ারেন বাফেটের থেকে বিনিয়োগ পেতে সমর্থ হন ওয়াং।

২০০৮ সালে ওয়ারেন বাফেট বিওয়াইডিতে ২৩ কোটি ডলার বিনিয়োগ করেন। পরের বছরই এর শেয়ারের দাম বেড়ে যায় ১ হাজার ৩৭০ শতাংশ। সে সময় নিজের প্রথম প্লাগ ইন হাইব্রিড মডেলের গাড়ি বাজারে ছাড়ে বিওয়াইডি।

 

টেসলাকে পেছনে ফেলে বিওয়াইডি এখন ইভির রাজা
চীনের বাজারে ২০১৫ সাল থেকে একচ্ছত্র প্রভাব বিস্তার করতে থাকে বিওয়াইডি। সে সময় বিওয়াইডি চীনের অভ্যন্তরীণ বাজারে তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী টেসলাকে অতিক্রম করে।

মূলত দামের প্রতিযোগিতাতেই বিওয়াইডির কাছে ধরাশায়ী হয় টেসলা। কারণ চীনে টেসলার সবচেয়ে সস্তা গাড়ি মডেল থ্রির দামও শুরু হয় ৩২ হাজার ডলার থেকে, যার এক চার্জে ১৪০ মাইল প্রতি ঘণ্টায় চলার সক্ষমতা সর্বোচ্চ ২৭২ মাইল।

অপরদিকে বিওয়াইডির সিগাল মডেলের ইভির দাম শুরু হয় মাত্র দশ হাজার ডলার দিয়ে। প্রতি ঘণ্টায় ৮১ মাইল গতিতে যার চলার সক্ষমতা ২৫১ মাইল। অর্থাৎ টেসলার তিনভাগের এক ভাগ দামে কেনা গাড়িতেই টেসলার সমান দূরত্ব অতিক্রম করতে পারেন একজন বিওয়াইডি ইভি ক্রেতা।

২০২০ সালে বিওয়াইডির সক্ষমতার পালে যোগ হয় আর একটি সফলতা। সে সময়ই প্রথমবারের মতো লিথিয়াম আইরন ফসফেট (এলএফপি) ব্যাটারি প্রস্তুত করতে শুরু করে বিওয়াইডি।

ব্লেড ব্যাটারি হিসেবে পরিচিত এই এলএফপি ব্যাটারি শুধু বিওয়াইডির নিজস্ব গাড়িতেই ব্যবহৃত হয়না। এমনকি টয়োটা ও টেসলার মতো প্রতিদ্বন্দ্বী কোম্পানিগুলোও নিজেদের ব্রান্ডের ইভিতে ব্যবহার করে এই ব্লেড ব্যাটারি।