প্রতিবন্ধকতাকে জয় করা আলোকবর্তিকা ওরা

:: অমিতা সিনহা ::
প্রকাশ: ৪ সপ্তাহ আগে

প্রতিবন্ধকতাকে জয় করা বিজয়ের সারথি ওরা। শত বাধাঁ উপেক্ষা করে মনের জোরে ওরা উচ্চ শিক্ষার উজ্জ্বল আকাশে নক্ষত্রের আলোকবর্তিকা।

১৯ বয়সী শাফিয়া বেগমের হাত-পা কোনোটিই নেই। তার শরীর বলতে মাথা থেকে উরু। শারীরিক এমন অক্ষমতাকে ডিঙিয়ে উচ্চ শিক্ষার গলিতে পা রেখেছেন। পড়ছেন সিলেট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে। ইংরেজি বিভাগে ২য় বর্ষের ১ম সেমিস্টারের শিক্ষার্থী। একই বিদ্যাপীঠ থেকে ইংরেজি বিভাগে অনার্স ও মাস্টার্স সম্পন্ন করেছেন মীর জামিল আলম জিবাল (২৫)। জিবালের প্রতিবন্ধকতা আরো বিচিত্র। সে কারো কথা বুঝার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করতে পারে না। পারে না কিছু মুখস্ত করতে। শারীরিকভাবে সুস্থ্য হলেও মানসিকভাবে প্রতিবন্ধকতা বড় বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল তার। তবুও তার নিজস্ব প্রতিভার বলে উচ্চ শিক্ষার স্বপ্নের সিড়িঁ অতিক্রম করতে পেরেছে।

শাফিয়া আর জিবালের মতো সিলেট শহরের বাগবাড়ির শামীমাবাদে অবস্থিত সিলেট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি বিগত পাঁচ বছর ধরে বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন, সুবিধা বঞ্চিত ও অনগ্রসর শিক্ষার্থীদের খুব যত্নে পাঠদান করাচ্ছে। অতিরিক্ত সময় দিয়ে তাদের পাঠদানের বাইরেও দেওয়া হচ্ছে ব্যক্তিগত পরিচর্চা, কাউন্সিলিং। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ে মেধাবী ও বিশেষ শিক্ষার্থীদের জন্য সুবিধা দিচ্ছে ভর্তি ক্ষেত্রে ছাড় ও স্কলারশিপ (শিক্ষাবৃত্তি)।

সরেজমিনে বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখা হলে বাগবাড়ীর শামীমাবাদের বাসিন্দা শিক্ষার্থী শাফিয়া বেগম প্রতিবেদককে বলেন, জন্মলগ্ন থেকেই আমার শরীর সাধারণ মানুষের মতো স্বয়ংসম্পন্ন নয়। নিজে নিজেই লিখতে শিখি। আমার লেখা দেখে এক সময় বাবা নিজে থেকেই আমাকে প্রাথমিক স্কুলে ভর্তি করতে যান। কিন্তু শারীরিক প্রতিবন্ধকতার জন্য কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আমাকে ভর্তি নিতে চাইনি। আমার বাবা খুব কষ্ট পেয়েছিল। পরে সিলেট শহরের রাধারাণী সরকারি প্রাথমিক স্কুলে ভর্তি হই। কিন্তু আজ আমি কলেজের গন্ডি পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স পড়ছি।

ছাত্রী শাফিয়া জানান, আমি হাঁটা চলা করতে পারি না বলে মা-বাবা সর্বদা একজন লোক রেখে দিয়েছেন। আমার প্রয়োজনে ওরা আমাকে কোলে করে নেন। আমি হাতের কনুই এর উপরি ভাগ দিয়ে জোর করে অনেকটা কষ্ট করে লিখতে পারি।

বিদ্যাপীঠের প্রসঙ্গে শিক্ষার্থী আরো বলেন, আমার ইউনিভার্সিটি খুব বেশি যত্নশীল পরিবেশে পড়িয়েছেন, আর সব ধরণের সহযোগীতার জন্য সহানুভূতিশীল। তার মধ্যে ইংরেজি বিভাগের প্রধান প্রণবকান্তি দেব স্যার খুবই আন্তরিক একজন শিক্ষক।

তিনি বলেন, আমার ইচ্ছে পড়াশোনা শেষ করে একজন ভালো শিক্ষক হবো।

সিলেটের সুবিদবাজারের বাসিন্দা একই বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ শিক্ষার্থী মীর জামিল আলম জিবালের পিতা বাংলাদেশ বেতারের অবসরপ্রাপ্ত ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা মীর শাহ আলম।

তিনি প্রতিবেদককে বলেন, ছেলে আমার সিলেট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি থেকে ইংরেজিতে অনার্স ও মাস্টার্স সম্পন্ন করেছে। যদিও সে মানসিকভাবে প্রতিবন্ধি। পুত্র জিবাল সহজেই কারো সাথে মিশে না কিংবা মিশতে চায়না। ওর মতো করে সব কিছু বুঝে সে। সেটি পড়াশোনা বলেন অথবা কারো সাথে বুঝার ক্ষেত্রে বলেন। ও নিজস্ব গতিতে চলতে ভালোবাসে। মুখস্ত বিদ্যা কখনো করতে পারে না। সব কিছু তার মতো করে বুঝে তারপর পরীক্ষায় লিখে জিবাল। শৈশবে প্রাথমিকে পিএসসি পরীক্ষার সময় প্রত্যাখ্যান হয়েছিল একমাত্র মুখস্ত করতে পারে না বলে। পরে জিবাল অন্য স্কুল থেকে পিএসসি পরীক্ষায় দেয়। অর্নাস ভর্তির সময় সিলেটের নর্থ ইস্ট ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি নেননি মুখস্ত বিদ্যা পারে না বলে। ওই সময় সিলেট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির একজন শিক্ষকই তাকে এখানে ভর্তি করান।এখানে আমার ছেলে ইংরেজি বিভাগে অনার্স ও মাস্টার্স সম্পন্ন করেছে।

সিলেট ইন্টারন্যাশনাল ইউনির্ভাসিটির বিভাগীয় ইংরেজি বিভাগের প্রধান ও সহযোগী অধ্যাপক প্রণবকান্তি দেব প্রতিবেদককে বলেন, সিলেট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ইংরেজি বিভাগ সব বর্ণের নির্বিশেষে সবার জন্য শিক্ষা- মূলমন্ত্রে বিশ্বাসী। শুধুমাত্র আর্থিক সহযোগিতা নয়, আমাদের কর্তৃপক্ষ, বিভাগের শিক্ষকমন্ডলী যেকোনো চ্যালেঞ্জিং শিক্ষার্থীর ব্যাপারে সবসময় সহানুভূতিশীল এবং শ্রদ্ধাশীল। এই বিশেষ শিক্ষার্থী ছাড়াও চা শ্রমিকসহ বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীরা আমাদের বিভাগে আসে। তারা ভাষাসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংকটে পড়ে শুরুর দিকে। তখন আমরা চেষ্টা করি তাদের স্বাভাবিক নিয়মে সকল শিক্ষার্থীদের সাথে অভিন্ন পাঠদান সুবিধা নিশ্চিত করানোর। এতে শিক্ষার্থীরা নানা প্রতিবন্ধকতা স্বত্বেও স্বপ্ন জয়ের পথে হাঁটতে পারছে।