আদালতপুর। বাংলাদেশের দক্ষিণ অঞ্চলের এক পিছিয়ে পড়া গ্রাম। সাতচল্লিশের বৃটিশ পরাজয়ের পর পূর্ব বঙ্গের মানুষের স্বাধীন ও আধুনিক চিন্তা চেতনার বিকাশ ঘটলেও তার বিন্দুমাত্র ছোয়া এ গ্রামটাতে দেখা যায়নি। তারপর একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রায় সব অঞ্চলে আধুনিকতার স্পর্শ লাগতে শুরু করে। কিন্তু আদালতপুর গ্রাম যেন ভিন গ্রহের কোন অঞ্চল। এখানে আধুনিকতার স্পর্শ লাগা নিষেধ। এ এক প্রাগ ঐতিহাসিক যুগের ধারক বাহক। কেননা স্বাধীনতা পরবর্তীকালীন বাংলাদেশের প্রায় সব অঞ্চলে আধুনিকতা ও সভ্যতার ছোঁয়া লেগেছে এবং ক্রমশ উন্নত জীবনের স্বাদ পেয়েছে। কিন্তু আদালতপুর এক ভিন্ন মৃত্যুপুরী। এখানে প্রত্যেকটা মানুষ প্রতিদিন জীবিত থেকেও মৃত্যুবরণ করে।
আসলে আদালতপুর গ্রামের নামের সাথে এখানকার মানুষের জীবনের কোন মিল নেই। এখানে এখনো ধর্মান্ধতা, কুসংস্কার ও কাটমোল্লাদের দৌরাত্ম্য প্রবল। গত এক দশক আগে বিদ্যুতের আলোর সুবিধা পেলেও এখানকার মানুষের মনের অন্ধকার এখনো আগের মতো ঘুটঘুটে।
তার একটা উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত গফুরের পরিবার। গফুরের পতামহ নোয়াখালী হতে জীবিকার সন্ধানে আদালতপুর গ্রামে আসে সেই দেশ বিভাগের আগে। এ অঞ্চলে তারা এখন স্থায়ী বাসিন্দা। গফুরের পিতামহ, পিতা, চাচারা এ গ্রামেই চিরনিদ্রায় শায়িত। মাঝে মাঝে গফুরের ভীষণ খারাপ লাগে এ গ্রামের অধিবাসী ভাবতে। আগে তার এরকম মনে হতো না। কিন্তু ইদানিং তার মনে এই অর্থহীন এই ভাবনা এসে ভর করে। তার অবশ্য একটা ইতিহাস আছে।
গফুর দশ সন্তানের পিতা। সাত মেয়ে আর তিন ছেলে। গফুরের স্ত্রী আলেমন বিবি প্রায় অসুস্থ থাকে। দৈত্যকার এ সংসারের ঘানি টানতে টানতে গফুর ও আলেমন বিবি ক্লান্ত। সাত মেয়ের মধ্যে পাঁচজনের বিবাহ হয়েছে। ছেলে তিনজন এখনো বিবাহের উপযোগী হয়নি। বাকী দুই মেয়ের মধ্যে জুলেখা ডাঙ্গর হয়ে উঠছে ধীরে ধীরে। জুলেখার বয়স এখন তের কি চৌদ্দ হবে। এরই মধ্যে তার বিবাহের তোড়জোড় শুরু হয়েছে।
জুলেখা স্থানীয় এক কওমি মাদ্রাসায় হিফজ বিভাগে পড়ে। ভাই তিনজন দাখিল মাদ্রাসায় কিছু দিন পড়ে লেখাপড়া বন্ধ করে দেয়। এখন তারা বাবা গফুরের সাথে খেত খামারে কাজ করে।
কয়েকদিন আগে জুলেখার একটা বিয়ের সমন্ধ আসে। পাত্র একজন হাফেজ। এ সমন্ধটি নিয়ে আসে জুলেখার কওমি মাদ্রাসার হিফজ বিভাগের ওস্তাদ হাফেজ আবদুল্লাহেল বাকী। বিয়ের কানাঘুষা কিছু সংবাদ জুলেখার কানে আসে। এজন্য তার মনমেজাজ অনেক খারাপ। বিয়ের আয়োজন নিয়ে বাড়িতে আজকাল প্রায়ই আলোচনা হয়। বিয়ের কথা শুনে জুলেখা ভয় পায়। সে জানে মানুষ বিয়ে করে কিন্তু কেন করে তা সে জানে না। তার মধ্যে একধরনের আতঙ্ক বিরাজ করে। কয়েকজন সহপাঠীর সঙ্গে বিয়ের বিষয়ে সে কথা বলে। কিন্তু তারাও জুলেখার মতো বিয়ের বিষয়ে তেমন কিছু জানে না।
দুই
জুলেখার বিয়ের সমন্ধ পাকা হওয়ার পর থেকে তার চলাফেরায় বিশেষ বিধিনিষেধ আরোপ করে তার পরিবার। আগে যেভাবে নদীর ঘাটে কলসি নিয়ে পানি আনতে যেত এখন আর তা পারে না। মাদরাসা থেকে ঘরে ফিরে বিকালে বাড়ীর পাশের ছোট্ট নদীরটার পাড়ে গিয়ে সে বসত। আপন মনে নদীর সাথে কথা বলত। পাড়ার দুএকজন সমবয়সী মেয়েদের সাথে গোল্লাছুট খেলত। ফরিদ গাজীর আম্রকাননে আমের মুকুল ধরলে তার সুভাষিত গন্ধ নিত। গুটি আমের সময়ে কালবৈশাখী ঝড়ে পড়া আম কাচা লঙ্কা আর লবন দিয়ে মাখিয়ে খেলার সাথীদের সাথে খেত। এসব এখন তার জন্য বারণ।
জুলেখা এখন জলবন্দি আসামীর মতো। কোন কাজে তার স্বাধীনতা নেই। এরকম আবদ্ধ পরিবেশে সে হাফিয়ে ওঠে। তাই একদিন মাকে জিজ্ঞেস করে। বলে, মা তুমরা আমার লগে ক্যান এরকম করতাছো?
– কি করতাছি
– এইযে আমার হগল কাজে বাধা দিতাছো
– ঠিকই তো করতাছি। মাইয়া মানুষের বিয়া ঠিক অইলে তার আর আগের মতো চলন যায় না।
– এককান কথা কমু মা
– ক
– আমি বিয়াডা করতাম না
জুলেখার মা আলেমন বিবি আঁতকে ওঠে। চাপা স্বরে বলে, যা কইবার আমারে কইছোস। ইডা যেন তোর বাপের কানে না যায়। তোর বাপে শুনলে টুকরো কইরা কাইটা গাঙে ভাসাইয়া দিব।
জুলেখা কিছুটা নিথর হয়ে যায়। কিছুক্ষণ নিরব থেকে আবার বলে, মা আমি লেহা পড়া করতে চাই।
ক্ষিপ্ত হয়ে আলেমন বিবি বলে, চুপ থাক। এহান থাইকা যা।
– বাপজানরে এট্টু বুঝাইয়া কও না মা
– কি বুঝামু। বিয়ার দিন তারিখ ঠিক অইছে। এহন কি এসব কওন যাইবো?
জুলেখা স্তব্ধ হয়ে যায়। উঠে চলে আসার সময় একটু উচ্চস্বরে বলে, আমার কোন বইনতো লেহা পড়া করে নাই, আমি করতে চাইতাছি হেডাও তোমাগো চোহে বাধে।
আলেমন বিবি আর সহ্য করতে পারে না। উঠে এসে জুলেখার চুলের মুষ্টি ধরে স্বজরে মুখে একটা চড় কষে দেয়। আর বলে, মাইয়া মানসের বেশি বাড়া ঠিক না।
জুলেখা হতবিহ্বল হয়ে পড়ে। কিছুই বলে না। কাঁদতে কাঁদতে ঘরে যায়।
রাতে জুলেখার মা আলেমন বিবি গফুরকে বলে, এট্টা কথা কমু।
– কও
– রাগঝাগ করবেন নাতো
– রাগের কথা কইলেতো রাগ করুম।
– কইতেছিলাম আমাগো সাত মেয়ের কোনডাই বেশিদূর লেহাপড়া করে নাই। জুলেখা একটু পড়বার চায়। তাই তারে অহন বিয়াডা না দিলে কি এমন অইব।
কথাটা শুনে গফুর তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে। হুকুমের ছলে বলে, এইডা তোর কথা। আর কোন কিছু বলবার চাস।
– না। আপনে চাইলে মেয়েডা কিছুদূর পড়তো। তারপর নাহয় এই ছেলের লগে বিয়া দিমু
গফুর আরো ক্ষেপে যায়। উচ্চস্বরে বলে, মাইয়া মানসের এতো লেহাপড়ার দরকার নাই। বেশি লেহাপড়া করতে গেলে ঝামেলা হইব।
আলেমন বিবি আর কিছু বলে না।
তিন
পরের দিন মাদরাসার হুজুর আর জুলেখার বিবাহের পাত্র হাফেজ একরাম এসে হাজির। গফুর হুজুর আর একরামের সেবা শশ্র“ষায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে। গাছের ডাব, পাকা পেঁপে পেড়ে আনে। ডাব আর গাছের টাটকা পেপে খেয়ে হুজুর অনেক খুশি হয় । দুপুরের খাবার এর আয়োজন করে গফুর। খেতে খেতে হজুর আবদুল্লাহেল বাকী বলেন, গফুর মিয়া তোমার পুকুরের মাছের স্বাদই আলাদা।
প্রশংসা শুনে গফুর খুব খুশি হয়। বলে, সবই মহান পরওয়ারদিগারের ইচ্ছা
– হ ঠিকই কইছো। তার ইচ্ছা ছাড়া কিছুই হইব না। আমরা শুধু অছিলা মাত্র।
খাওয়া শেষে হুজুর সুরভি জদ্দা দিয়ে পান চিবাতে থাকে আর গফুরকে ধর্মীয় বিষয়ে ছবক দেয়। একফাকে বলে, যাওনের সময় হইয়া যাইতাছে। মা জননীকে একবার নিয়া আসো একরাম বাবাজী একটু দেখব।
জুলেখা আসতে চায় না। ঘরের ভেতরে আলেমন বিবি বোঝায়। কিন্তু কিছুতে কোন কাজ হয় না। আলেমন বিবির ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায়। চুলের মুষ্টি ধরে বলে, ক্যান যাবি না ক। তোরে কি আজই লইয়া যাইব।
জুলেখা কাঁদে আর বলে, আমারে যদি বিয়াই দিবা তো এই লোকটার সাথে দিও না মা।
আলেমন বিবি একটু চিন্তায় পড়ে। বিষয়টা কি জানতে চায়। জুলেখাকে প্রশ্ন করে, ক্যান এই ছেলের লগে বিয়া বইতে অসুবিধা কি?
জুলেখা কিছু বলে না। ডুগরে কাঁদতে থাকে। এদিকে গফুর হাক মেরে বলে, কই গো জুলেখা মা। জলদি কইরা আয়। হুজুর অনেক ব্যস্ত মানুষ। তার মেলা কাম আছে।
গফুরের কথা শুনে আলেমন বিবি নড়েচড়ে বসে। জুলেখাকে একপ্রকার জোর করে হুজুর আর একরামের সামনে আনে। হুজুর বুঝতে পারে জুলেখা অহন বিবাহ করতে চায় না। তাছাড়া জুলেখা যখন ঘরের ভেতরে মায়ের কাছে জিদ ধরেছিল, সেসব অল্পবিস্তর কিছু কথা আবছা আবছা তার কানে আসে। তাই কিছু জ্ঞান দেয়।
বলে, মা জননী তুমার আপাতত মাদ্রাসায় না যাওয়াই ভালো। মাইয়া মানসের বিয়ার কথা চললে তার আর বেপর্দায় না চলাই ভালো।
একরামকে খোচা দিয়ে বলে, কিছু জিগাইবার থাকলে জিগাইতে পার।
একরাম বলে, আমি আর কি জিগামু। সেও আপনার কাছে দীক্ষা নিছে আমিও তাই।
– তারপরও তুমার কিছু জানার থাকলে জিগাও।
– আমার কিছু জানার নাই। একথা বলে একরাম মনে মনে খুশি হয়। কারণ জুলেখাকে তার পছন্দ হয়েছে।
চার
জুলেখার মতামতকে অগ্রাহ্য করে হাফেজ একরামের সাথে তার পরিবার তাকে বিয়ে দেয়।
অল্পবয়স্কা জুলেখা অল্প কিছুদিনের মধ্যে স্বামী সংসার নিয়ে হাফিয়ে ওঠে। যৌথ পরিবারের একগাদা সদস্যের মধ্যে কোন কূলকিনারা খুজে পায়না। চুন থেকে পান খসলেই তাকে নানান তিরস্কার শুনতে হয়। তার একমাত্র ভরসার যায়গা স্বামী একরামও তার বিরুদ্ধচারন করে প্রতি মূহুর্তে। জুলেখা কি করলে পরিবারের সকলের মন যোগাতে পারবে বুঝতে পারে না। লাঞ্চনা গঞ্জনার মধ্যে তার নিত্যদিন অতিবাহিত হয়। জুলেখা সমস্ত অপমান তিরস্কার মেনে নিয়ে সংসারী হওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু তা সে পারে না। সবচেয়ে বড় সমস্যা দেখা দেয় জুলেখার শাশুড়ী ও ননদের আচারণে। তারা সব সময় তার ভুল ধরার জন্য সচেষ্ট থাকে। একদিন তরকারিতে লবন কম হওয়ায় শাশুড়ী ননদরা মিলে জুলেখার সাথে ঝগড়া বাধিয়ে দেয়। স্বামী একরাম বাড়িতে এলে জুলেখা অভিযোগ করে। বলে, আপনের চোখে তো কোন কিছু পড়ে না। সংসারের এত কামকাজ আমি একা ক্যামনে সামলামু কন।
একরাম উত্তেজিত হয়ে যায়। চেচিয়ে বলে, ক্যামনে সামলাবি তা আমি কি করে কমু।
– ইডা আপনে কেমুন কথা কন
– কেমুন কথা মানে
– আমি ছোট মানুষ। এত্তবড় সংসারের কাম কি আমি একলা পারুম।
– একলা না পারলে কেডা করব
– ক্যান আপনের মা বইনরাতো একটু কামকাজ করতে পারে।
একথা শুনে একরামের মেজাজ বিগড়ে যায়। উচ্চস্বরে বলে, কাম-কাজ জানিস না তা বিয়ায় বইছিলি ক্যান।
– আমিতো এহন বিয়া করতে চাইনি। আপনে আমার বাবারে ফুসলাইয়া আমারে বিয়া করছেন।
একরাম উত্তেজিত হয়ে যায়। রাগে কাঁপতে থাকে। এক পর্যায়ে চরম ক্ষিপ্ত হয়ে জুলেখাকে এলোপাতাড়ি কিল ঘুষি মারতে থাকে। পরিবারের অন্যরাও একরামের সাথে হাত মিলায়। কিশোরী জুলেখার দূর্বল শরীর এত বড়ো জুলুম সহ্য করতে পারে না। একপর্যায়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। নিথর ছোট্ট শরীরটা মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। নাক মুখ দিয়ে অঝোরে রক্ত ঝরতে থাকে।
পাঁচ
জুলেখার উপর এরকম নির্মম অত্যাচার নিয়মে পরিনত হয়। যে বয়সে তার খেলার সাথীদের সাথে খেলা করার কথা, সে বয়সে তাকে সংসারের ঘানি টানতে হয়। ধীরে ধীরে তার শরীর ভাঙতে থাকে।
সংসারের যাবতীয় কাজকর্ম সেরে রাতে জুলেখার আর শরীর চলে না। ক্লান্ত জুলেখা ঘুমে কাতর থাকে। তখনই চলে স্বামী একরামের যৌন নির্যাতন। প্রায় প্রতি রাতে তাকে স্বামীর যৌন ক্ষুধা মিটাতে হয়। মাঝে মধ্যে অপারগতা প্রকাশ করলে একরাম ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। কোমলমতি শিশুদের মত যন্ত্রণায় জুলেখা ছটফট করে। তার নীরব আহাজারি পাষন্ড একরামের মনে কোন দাগ কাটে না। যন্ত্রণার অথৈ জলে নীরব বেদনায় ভাসা ছাড়া কিশোরী জুলেখার কি করার আছে।
একদিন জুলেখার প্রচন্ড জ্বর আসে। জ্বরে সমস্ত শরীর তার পুড়ে যাচ্ছে। খাবারে তার অরুচি। সারাদিন কিছু খায়নি। শ্বশুর বাড়ির একজনও তাকে সেবাশুশ্রূষা করেনি। জ্বরে কাতর জুলেখা অচেতন হয়ে বিছানায় শুয়ে থাকে। রাতে একরাম বাড়িতে ফেরে। মাঝরাতে একরাম জুলেখাকে সোহাগ করতে চায়। অসুস্থ দূর্বল জুলেখা সাধ্যমত বাঁধা দেয়। কিন্তু একরাম তা ভ্রুক্ষেপ করে না।এদিকে জ্বরের ভারে জুলেখা কাতরাতে থাকে, অন্যদিকে স্বামী একরাম যৌন লালসা চরিতার্থ করে। অসুস্থ জুলেখা যন্ত্রণায় কাতরাতে থাকে।
জুলেখা আর পারে না। সে বাবার বাড়িতে চলে আসে। জুলেখা তার মাকে স্ববিস্তারে সব ঘটনা খুলে বলে। কিন্তু তার মা বিশ্বাস করতে চায় না। বরং বলে, মাইয়া মানসের এতো ত্যাজ ভালো না।
জুলেখা মেনে নিতে পারে না। সে প্রতিবাদ করে বলে, আমারে কাইটা গাঙে ভাসাইয়া দেও মা। আমি আর ঐ সংসারে ফিরে যামু না।
জুলেখার মা আলেমন বিবি ক্ষেপে যায়। বলে, ক্যান যাবি না
– তুমারে আর কতো করে কমু
– কওনের দরকার নাই। এমুন একটা হাফেজ মানসেরে স্বামী হিসেবে পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার।
জুলেখা স্তব্ধ হয়ে যায়। রাগে তার শরীর কাঁপতে থাকে। তারপর চিল্লায়ে বলে, আমারে সে প্রতি রাইতে ধর্ষণ করে। এইডা কি একজন হাফেজ মানসের নমুনা?
আলেমন বিবি বেজায় বিরক্ত হয়। চোখ মোটা করে জুলেখার দিকে তাকায়। তারপর উচ্চস্বরে বলে, স্বামীর খেদমত করাই তো মাইয়া মানসের কাজ।
জুলেখা আর পেরে ওঠে না। ক্ষোভে দুঃখে নদীর পাড়ে চলে যায়।
ছয়
জুলেখা অনেক দিন বাবার বাড়িতে অবস্থান করে। এর মধ্যে একরাম তাকে নিতে আসে। কিন্তু জুলেখা আর যেতে চায় না। আলেমন বিবি জুলেখাকে বিভিন্নভাবে বোঝায় কিন্তু জুলেখা তার সিদ্ধান্তে অনড় থাকে। এদিকে একরামকে কি বলবে আলেমন বিবি বুঝতে পারে না। একরাম বুঝতে পারে জুলেখা আর তার কাছে থাকতে চায় না। কিন্তু সে না বোঝার ভান করে। গফুরও অনেক বার জুলেখাকে বলে কিন্তু কিছুতে কোন কাজ হয় না। এরকম উদভুদ্ধ পরিবেশে কিভাবে একরামকে বোঝাবে তার পরিকল্পনা করে গফুর ও আলেমন বিবি। এক পর্যায়ে গফুর একরামকে বলে জুলেখার শরীরটা একটু খারাপ। ও সুস্থ হলে তিনি নিজেই জুলেখাকে রেখে আসবে। একরাম গফুরের কথা মেনে নেয়। কিন্তু তার মধ্যে জিদ কাজ করে। মনে মনে সে এই অপমানের প্রতিশোধ নেওয়ার পরিকল্পনা করে।
জুলেখাদের বাড়ির দক্ষিণ পাশের খোলা মাঠে কবি গানের আসর বসে। কয়েক দিন ধরে কবি গানের পালা চলে। জুলেখা পাড়ার কয়েকজন সায়ীদের সাথে পালা গান শুনতে যায়। এ সংবাদ একরামের কানে পৌছে। একরাম ক্ষোভে অস্থির হয়ে পড়ে। অস্থির একরাম জুলেখাকে নিতে চলে আসে। জুলেখাকে শক্তভাবে শাসায়। তখন আলেমন বিবি একরামকে শান্ত করার চেষ্টা করে। কিন্তু একরাম কোন কিছু মানতে নারাজ। তার একটাই কথা। একজন আলেমের স্ত্রী হয়ে কিভাবে এরকম নাফরমানি কাজে জুলেখা গেল। কেউ কোন জবাব দিতে পারে না। গফুর একরামকে বুঝিয়ে বলে, বাজান তুমি এবারের মতো জুলেখাকে ক্ষমা করো।বয়স কম। আস্তে ধীরে সব ঠিক হইয়া যাইব।
একরাম বিরক্ত হয়ে বলে, আমি একজন কোরআনের হাফেজ। জেনেশুনে ক্যামনে এরাম পাপ কাজে সম্মতি দেই কন।
– তাতো সবই বুঝি বাজান। জ্ঞান গরিমা কম হলে যা হয়।
– আমি আর কথা বাড়াতে চাইনা। আজই আমি ওরে নিয়ে যেতে চাই।
আলেমন বিবি বলে, ঠিক আছে বাজান। তুমি যেভাবে চাও তাই হইব।
আট
একরাম জুলেখাকে একরকম জোর করেই নিয়ে যায়। জুলেখার উপর চালায় পাশবিক নির্যাতন। শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনে জুলেখার শরীরের অবস্থায় আগের চেয়ে আরও অবনতি ঘটে। তার প্রত্যেক কাজে একরামের পাশাপাশি শ্বশুর বাড়ির অন্যান্য সদস্যরা বাধা হয়ে দাড়ায়। সে হাফিয়ে ওঠে। মাঝে মাঝে আত্মহননের কথাও সে ভাবে। আবার এটাও ভাবে আত্মহত্যা মহাপাপ।
পরিবারের সদস্য বাদে আর কারোর সাথে জুলেখার কথা বলা এমনকি দেখা করাও নিষেধ। নিকট আতœীয় কোন পুরুষ মানুষের সাথে তার কথা বলা বারণ। জুলেখার খালাতো ভাই ফজল তার শ্বশুর বাড়ি আসলে তার সাথে জুলেখাকে দেখা করতে দেয় না। ফজল জুলেখার সমবয়সী। তারপরও সে দেখা করতে পারেনি। এক প্রকার অপমানিত হয়ে ফজল বিদায় নেয়।
এই বিষয় নিয়ে জুলেখা প্রতিবাদ করে। তখন তার শ্বশুর বাড়ির সকলেই জুলেখার সাথে খারাপ ব্যবহার করে। দুপুরে হেফজ খানা থেকে একরাম বাড়িতে আসলে জুলেখার শ্বাশুড়ি নালিশ জানায়। এসব অভিযোগ শুনে একরাম ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। জুলেখার সাথে ঝগড়া করে। গায়ে হাত তুলতে গেলে এই প্রথম জুলেখা শক্তভাবে প্রতিবাদ করে। বলে, খবরদার আপনে আমার গায়ে হাত তুলবেন না।
ক্ষিপ্ত একরাম বলে, কি বললি হারামজাদি।
– আপনে গালি দিতাছেন ক্যান
– তোরে সোহাগ করুম।
– আপনের সোহাগের আমার দরকার নেই।
একথা শুনে একরাম রাগে কাঁপতে থাকে। চিৎকার করে জুলেখাকে গালিগালাজ করতে থাকে। একরামের চিৎকার শুনে আশপাশের মানুষ এসে ভিড় করে। সবাই জুলেখাকে দূরছাই করে। প্রতিবেশিদের জুলেখার প্রতি এরকম তিরস্কার শুনে একরাম অনেক হিংস্র হয়ে ওঠে। হারামজাদী বলে জুলেখার চুলের মুষ্টি ধরে স্বজোরে আছাড় মারে। ব্যাথায় জুলেখা ডুগরে কেঁদে ওঠে। তার মধ্যে একধরনের অজানা শক্তি এসে ভর করে। সে কেমন যেন বেপরোয়া ও উন্মাদ হয়ে যায়। গগনবিদারী চিৎকার দিয়ে বলে, খানকির পোলা..তোরে আমি খাইছি।
পাশে থাকা উন্মুক্ত ধারালো তরকারি কাটার বটি নিয়ে একরামের গর্দানে স্বজোরে কোপ দেয়। অগ্নিমূর্তি জুলেখা কোপের পর কোপ দিতে থাকে। আশপাশের মানুষেরা জুলেখার এলোপাতাড়ি কোপ আর ঝাঝালো রক্ত চক্ষু দেখে ভয়ে দিক্বিদিক ছুটে যায়।
একরামের ক্ষতবিক্ষত রক্তাক্ত দেহ মাটিতে লুটিয়ে পড়ে।
আট
জুলেখার যাবজ্জীবন কারাদন্ড হয়। অনেকে জুলেখার এরকম কর্মকে ধিক্কার জানায়। এলাকার ইমাম সাহেব বলেন, কিয়ামত খুব সন্নিকটে।
হেফজ বিভাগের ওস্তাদ হাফেজ আব্দুল্লাহেল বাকী বলেন, নাউজুবিল্লাহ। এরকম একজন আল্লাওয়ালা হাফেজকে হত্যা করে জুলেখা তার পুরো পরিবারকে দোজখের বন্দোবস্ত করল।
কিন্তু একটা বিষয় সবাইকে অবাক করে। স্বামী একরামকে হত্যা করে জুলেখার মধ্যে কোন অনুশোচনা দেখা যায়নি। বরং তাকে অনেক পরিতৃপ্ত ও নির্ভার মনে হয়।