আকর্ষণীয় বেতনে কাজের প্রলোভন দেখিয়ে কাতার নিয়ে গিয়ে বাংলাদেশি নারীদের দেহ ব্যবসায় নিয়োজিত করছে একটি সুযোগসন্ধানী চক্র। চক্রের হোতা হিসেবে খোঁজ পাওয়া গিয়েছে এক বাংলাদেশি নারীর। ইতোমধ্যে দেশে ফেরত এসেছেন তিনজন ভুক্তভোগী, গ্রেপ্তারও হয়েছে তিনজন অপরাধী।
ভুক্তভোগীদের একজনের নাম পাখি (ছদ্মনাম)।
মাস দুয়েক আগে তিনি কাতার যান চাকরীর সন্ধানে। আশা করেছিলেন বেতনের টাকায় তার মাদ্রাসাপড়ুয়া মেয়েকে একটি সুন্দর জীবন উপহার দেবেন।
কিন্তু ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস! কাতার পৌঁছানোর সাথে সাথেই একটি আন্তর্জাতিক পাচারকারী চক্রের হাতে পড়তে হয় তাকে। যার ফলশ্রুতিতে ভেস্তে যায় পাখির স্বপ্ন।
কাতারে দেহব্যবসায় যাদেরকে বাধ্য করা হয়েছে তাদের মধ্যে পাখিই একমাত্র নন। পুলিশ এবং ভুক্তভোগীদের তথ্যমতে, কমপক্ষে ২৫ জন নারীকে একইভাবে দেহব্যবসায় বাধ্য করা হয়েছে।
পুরো ব্যাপারটি নজরে আসে যখন পাখি এবং আরও দুইজন ভুক্তভোগী কাতার পুলিশের সহায়তায় বাংলাদেশে ফিরে আসেন এবং গত ১৭ নভেম্বর কেরানীগঞ্জ থানায় একটি মামলা করেন। মামলার এজাহারে পাখি উল্লেখ করেন, পাচারকারী চক্রটি বাংলাদেশি মেয়েগুলোকে কাতারের রাজধানী দোহার জাবের বিন মোহাম্মদ সড়কের একটি ভবনের ফ্ল্যাটে বন্দী করে রেখেছে এবং তিনটি হোটেলে পুরুষদের সাথে অনৈতিক কর্মে নিয়োজিত হওয়ার জন্য বাধ্য করছে।
জানা গেছে, পাচারকারী চক্রটি দুইটি দলে বিভক্ত। একটি দল বাংলাদেশ থেকে নারীদেরকে কাতারে পাঠায়, ওপর দল কাতারে যাওয়ার পর নারীদেরকে অনৈতিক কর্মে বাধ্য করে।
পুলিশ ও ভুক্তভোগীদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, যারা এই নারীদেরকে বাংলাদেশ থেকে কাতারে পাচার করেছে তারা হলো- মাদারীপুর সদর উপজেলার সানজিদা আক্তার, সোহাগ ব্যাপারী, মতি ব্যাপারী ও মানসুরা আক্তার রিতু এবং নোয়াখালীর চাটখিলের ইউসুফ পাটোয়ারীসহ আরও কয়েকজন।
অপরদিকে, যারা কাতারে এই অবৈধ ব্যবসাটি পরিচালনা করছে তারা হলো- মাদারীপুরের তাসলিমা আক্তার প্রেমা এবং নারায়ণগঞ্জের সুমন উরফে রকি।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ঢাকা জেলার যুগ্ম পুলিশ সুপার শাহাবুদ্দীন কবির বলেন, পাচারকারী চক্রটির সাথে আন্তর্জাতিক মাফিয়া চক্রের যোগাযোগ থাকতে পারে। আমরা ইন্টারপোলের সহায়তায় ভুক্তভোগীদেরকে উদ্ধার করবো এবং চক্রের সদস্যদের গ্রেপ্তার করবো।
কীভাবে চক্রটির ফাঁদে পড়লেন জানতে চাইলে পাখি জানান, স্বামীর সাথে বিবাহবিচ্ছেদের পর থেকে তিনি তার মেয়েকে নিয়ে একাই বসবাস করতেন এবং একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরী করে জীবিকা নির্বাহ করতেন।
তিনি জানান, এই বছরের ২৮ই ফেব্রুয়ারি সানজিদার সাথে আমার মিরপুরের একটি বিউটি পার্লারে পরিচয় হয়। পরিচয়ের এক পর্যায়ে সানজিদা আমাকে দোহার একটি পার্লারে মাসিক এক লাখ টাকা বেতনে একটি চাকরির অফার করে। একটি সুন্দর জীবনের আশায় আমি চাকরিটা করতে রাজি হই এবং সানজিদা আমাকে রিতুর সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। পরবর্তীতে আমি ২৫ হাজার টাকা খরচ করে পার্লারের কাজ শিখি।
পাখির দেয়া ভাষ্যমতে, তিনি মানব পাচারকারী চক্রটির সহায়তায় পাসপোর্ট তৈরি করেন এবং চুক্তি অনুযায়ী সোহাগ ও রিতুকে কাতার যাওয়ার জন্য ৩ লাখ টাকা পরিশোধ করেন। অক্টোবরের ৩ তারিখ পাখিকে কাতার নেয়া হয় এবং একটি ফ্ল্যাটে রাখা হয়।
পাখি আরও জানান, আমি ঐ ফ্ল্যাটে আরও দশ-বারোজন মেয়েকে দেখতে পাই যাদের বয়স বিশ বছরেরও কম ছিলো। তখনই আমি বুঝতে পারলাম যে আমি একটি পাচারকারী চক্রের হাতে পড়েছি।
পাখির দেয়া তথ্যানুযায়ী, তাসলিমা আক্তার প্রেমা কাতারে এই চক্রটি পরিচালনা করছে এবং সুমন, ইউসুফ এবং আরও তিনজন ব্যক্তি প্রেমাকে সাহায্য করছে। অপরদিকে, রিতু, সোহাগ এবং অন্যদের সহায়তায় সানজিদা বাংলাদেশে চক্রটি পরিচালনা করছে।
তিনি আরও জানান, আমাকে কয়েকজন ব্যক্তি কর্তৃক যৌন নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছিলো এবং পুরো দৃশ্য রেকর্ডও করা হয়েছিলো। অতঃপর আমাকে দেড় মাসব্যাপী দোহার তিনটি হোটেলে অনৈতিক কর্মে অংশ নিতে হয়।
ভুক্তভোগী বলেন, আমাকে শুধু খাবার দেয়া হতো কিন্তু কোনো টাকা দেয়া হতো না। যে ফ্ল্যাটে আমি থাকতাম সেটি সোহাগ ভাড়া করেছিলো। এটি হরিজন হোটেলের পাশে অবস্থিত। কাতারের জরুরী পুলিশ সেবার মাধ্যমে পুলিশকে পুরো ব্যাপারটি জানানোর পর তারা আমাকে ও আরও দুইটি মেয়েকে উদ্ধার করে এবং রিতুকে গ্রেপ্তার করে। ছয়দিন জেলে থাকার পর রিতুকে এবং আমাদেরকে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেয়া হয়।
পাখি আরও জানান, মামলা করার পর থেকে বিভিন্ন জায়গা থেকে আমাকে হুমকি দেয়া হচ্ছে যে আমার ভিডিওগুলো ছড়িয়ে দেয়া হবে। আমার বাবা একজন মসজিদের ইমাম এবং আমার মেয়ে একটি মাদ্রাসার ছাত্রী। ভিডিওগুলো ছড়িয়ে দেয়া হলে আমার আত্মহত্যা করা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না।
পাখির করা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা অলক কুমার দে জানান, পুলিশ গত ১৭ নভেম্বর সানজিদা, সাগর এবং ইউসুফকে গ্রেপ্তার করেছে। তাদের মধ্যে সানজিদা এবং ইউসুফ গত ২৫ নভেম্বর ঢাকার একটি আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে।