যেসব কথা দ্বারা কাউকে খাটো বা হেয় করা হয় তাই গালি। মানুষ তাদের পরিভাষায় যেসব শব্দকে গালি, উপহাস ও তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য মনে করে শরীয়তের দৃষ্টিতে তাই গালি হিসেবে বিবেচিত। গালি দেওয়া ও অশ্রাব্য ভাষায় কথা বলা কোনো ঈমানদার মানুষের জন্য শোভনীয় নয়। এমনকি শয়তানকেও গালি দেওয়া যাবে না।
১. আল্লাহ ও রাসুলকে গালি দেওয়া কুফরি: মহান আল্লাহ্ ও তাঁর রাসুলকে গালমন্দ করা, তাঁদের ব্যাপারে খারাপ মন্তব্য করা, ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ বা কটাক্ষ করা বড় কুফরি। আল্লাহ ও তাঁর রাসুলকে গালি দেওয়া ও তাঁদের সঙ্গে উপহাস করা মূলত তাদের কষ্ট দেওয়া। এ সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘নিশ্চয়ই যারা আল্লাহ ও তার রাসুলকে কষ্ট দেয়, আল্লাহ তাদের দুনিয়া ও আখিরাতে অভিশাপ করেন এবং তিনি তাদের জন্য প্রস্তুত রেখেছেন অপমানজনক শাস্তি। ’ (সুরা আহজাব, আয়াত : ৫৭)
২. ঈমানদারদের গালি দেওয়া ফাসেকি: যৌক্তিক বা অযৌক্তিক কোনো ভাবেই কাউকে গালি দেওয়ার অনুমতি ইসলামে নেই।
এমনকি হাসি-কৌতুক ও ঠাট্টাচ্ছলেও অন্যকে গালি দেওয়া ইসলামের দৃষ্টিতে অশোভনীয় ও নিন্দনীয়। আবদুল্লাহ বিন মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘মুসলিমকে গালি দেওয়া ফাসেকি [আল্লাহর অবাধ্যাচরণ] এবং তার সঙ্গে লড়াই ঝগড়া করা কুফরি। ’ (বুখারি, হাদিস : ৬০৪৪)
৩. সময়কে গালি দেওয়া যাবে না: আরব মুশরিকরা কোনো বিপদ বা পরীক্ষায় পতিত হলে সময়কে গালি দিত। এটি বড় অন্যায়।
কারণ সময়ের ভালো ও মন্দ পরিবর্তন করেন স্বয়ং মহান আল্লাহ। তাই সময়কে গালি দিলে সেটি আল্লাহকে গালি দেওয়ার নামান্তর। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (সা.) বলেন, ‘আল্লাহ তাআলা বলেছেন, মানুষ সময়কে গালি দিয়ে আমাকে কষ্ট দেয়। অথচ আমিই সময় (সময়ের স্রষ্টা), সব কিছুর নিয়ন্ত্রণ আমার হাতে, আমি রাত-দিনের পরিবর্তন করি। ’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৭৪৯১)
৪. অন্য ধর্মের উপাস্যকে গালি দেওয়া যাবে না: কোনো ধর্মের উপাস্য বা দেব-দেবীদের গালি দেওয়া যাবে না।
কটূক্তি বা সম্মানহানীকর কোন কথা বলা যাবে না। পবিত্র কোরআনে স্পষ্ট করে এ ব্যাপারে নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহকে ছেড়ে তারা যাদের আরাধনা করে, তোমরা তাদেরকে মন্দ বলো না। তাহলে তারা ধৃষ্টতা দেখাতে গিয়ে অজ্ঞতাবশত আল্লাহকে গাল-মন্দ করবে। এমনিভাবে আমি প্রত্যেক সম্প্রদায়ের দৃষ্টিতে তাদের কাজ-কর্মকে সুশোভিত করে দিয়েছি। অতপর স্বীয় পালনকর্তার কাছে তাদের প্রত্যাবর্তন করতে হবে। তখন তিনি তাদের বলে দেবেন যা কিছু তারা করত। ’ (সুরা আনআম : আয়াত ১০৮)
৫. মা-বাবা তুলে গালি দেওয়া যাবে না: সাধারণত প্রত্যেকেই নিজের মা-বাবাকে ইজ্জত-সম্মান করে থাকে। কিন্তু অনেক সময় অন্যকে মা-বাবা তুলে গালি দেওয়ার কারণে সেও তার মা-বাবা তুলে গালি দেয়। এতে নিজের মা-বাবাকে সরাসরি গালি না দিলেও নিজের কারণে অন্যের গালি দেওয়ার পথ তৈরি হয়। এটিও করা যাবে না। আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘কবিরা গুনাহগুলোর একটি হলো নিজের বাবা-মাকে অভিশাপ করা। ’ জিজ্ঞেস করা হলো, হে আল্লাহর রাসুল! মানুষ নিজের বাবা-মাকে কীভাবে অভিশাপ করে?’ তিনি বললেন, ‘যখন কোন লোক অন্য লোকের বাবাকে গালি দেয়, তখন সেও তার বাবাকেও গালি দেয়, মাকে গালি দেয়। ’ (বুখারি, হাদিস : ৫৯৭৩)
৬. পশু-পাখিকে গালি দেওয়া যাবে না: পশু-পাখি ও বৃক্ষ-তরুলতা সবই মহান আল্লাহর অপূর্ব সৃষ্টি। তারা প্রতিনিয়ত মানুষকে সেবা দিয়ে চলেছে। মানুষের খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এগুলো দ্বারাই পূরণ হয়। কাজেই এ সবের প্রতি যত্নশীল হতে হবে। গালিও দেওয়া যাবে না। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তোমরা মোরগকে গালি দিয়ো না। কারণ, সে নামাযের জন্য জাগিয়ে থাকে। (আবু দাউদ, হাদিস : ৫১০৩)
৭. মৃতদের গালি দেওয়া যাবে না: মৃত মানুষরা তাদের জীবনের অধ্যায় শেষ করে তাদের কৃতকর্মের প্রাপ্তিস্থানে পৌঁছে গিয়েছে। তাদের কাছ থেকে প্রতিশোধ নেওয়া বা প্রাপ্তির কিছু নেই। কাজেই তাদের ক্ষমা করা তাদের জন্য দোয়া করা উচিত। গালি দেওয়ার কিছু নেই। আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, তোমরা মৃতদের গালি দিয়ো না। যেহেতু তারা নিজেদের কৃতকর্মের পরিণতি পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। ’ (বুখারি, হাদিস : ১৩৯৩)
৮. রোগ-ব্যাধিকে গালি দেওয়া যাবে না: রোগ-ব্যাধিকে গালি দেওয়ার কোনো অবকাশ নেই। জাবের (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) একবার উম্মে সায়েব কিংবা উম্মে মুসাইয়িবের কাছে প্রবেশ করে বলেন, হে উম্মে সায়েব কিংবা উম্মে মুসাইয়িব! তোমার কি হয়েছে যে থরথর করে কাঁপছ? সে বলল, জ্বর হয়েছে; আল্লাহ তাতে বরকত না দেন। ’ (এ কথা শুনে) তিনি বলেন, জ্বরকে গালি দিয়ো না। জ্বর তো আদম সন্তানের পাপ মোচন করে; যেমন হাপর (ও ভাটি) লোহার ময়লা দূর করে। ’ (মুসলিম, হাদিস : ৬৭৩৫)
৯. বাতাসকেও গালি দেওয়া যাবে না: আল্লাহই বান্দার সুখ, শান্তি, সফলতা এবং কল্যাণ প্রদান করেন। অতি বৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, বন্যা, জলচ্ছ্বাস, ঝড়, টর্নেডো, মহামারি ইত্যাদিকে গালি দিয়ে লাভ নেই। আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে বলতে শুনেছি। বাতাস আল্লাহর এক হুকুম, তা কখনো রহমত নিয়ে আসে, আবার কখনো আজাব নিয়ে আসে। তুমি যখন বাতাসকে দেখবে, তখন তাকে গালি দেবে না, বরং আল্লাহর কাছে এর থেকে কল্যাণ কামনা করবে এবং এর অকল্যাণ থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাইবে। ’ (আবু দাউদ, হাদিস : ৫০৯৭)
১০. শয়তানকেও গালি দেওয়া যাবে না: কোনো মানুষ, প্রাণি বা কোন কিছুকেই গালি দেওয়া যাবে না। এমনকি শয়তানকেও গালি দেওয়া যাবে না। এর অর্থ এই নয় যে শয়তান তাওবা করে ভালো হয়েছে। বরং শয়তান অভিশপ্ত ও খারাপ হয়েই আছে। তাকে গালি দিলেও সে সংশোধন হবে না। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, তোমরা শয়তানকে গালি দিয়ো না। বরং তার অনিষ্ট থেকে আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করো। ’ (সহিহুল জামি, হাদিস : ৭৩১৮)
পরিশেষে বলা যায়, সবসময় গালমন্দ ও অশ্লীল বাক-বিনিময় থেকে বেঁচে থাকতে হবে এবং মার্জিত ও শ্রতিতিমধুর শব্দ ব্যবহারের চেষ্টা করতে হবে।
লেখক: ড. আবু সালেহ মুহাম্মদ তোহা, সহযোগী অধ্যাপক, আরবি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।