মন দুলছে পেন্ডুলামের মতো!

:: মোহাম্মদ আবু নোমান ::
প্রকাশ: ১ বছর আগে

পৃথিবীর মানচিত্রে ছোট্ট একটি দেশ ‘বাংলাদেশ’। বিশ্বাস না হলে, সম্মানিত পূজনীয় পাঠকমহল ‘ম্যাগনিফাই গ্লাস’ ধরে বিশ্বমানচিত্র নিবিড়ভাবে খুঁটে দেখুন। এ ক্ষুদ্রায়তনের একটি দেশে কত মত! কত পথ! কত প্যারা! কত ধারা! কত গতি! কত মতি! এখানে যারাই ক্ষমতায় এসেছেন তারাই ক্ষমতার এত বেশী অপব্যবহার করেছেন যে, এরা কোনভাবেই চাইবে না, আজ হোক বা কাল তাদের ক্ষমতায় কেউ ভাগ বসাক। এরপর বাকিটা বুঝে নিন! বাংলাদেশে কেউ কারো কথা শোনার নেই। ‘আমরা সবাই রাজা’, ‘আমাদেরই রাজ্য ও রাজত্ব’। আশির দশক থেকে এসব দেখে আসছি। বাংলাদেশের জন্য একটি ভয়ংকর বিষয় হচ্ছে, ‘বুদ্ধিজীবি-সুশীলদের নৈতিক অধঃপতন’। এখাকে কেউ দলবাজ, কেউ দলদাস, কেউ তেলবাজ কেউ সুবিধাভোগী দালাল! অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদ বলেছিলেন, ‘একজন মানুষের সর্বাঙ্গে পচন ধরলেই কেবল রাজনীতি করতে পারে’। রাজনীতি এখন স্পষ্টই নীতিহীন ড্রেসে সজ্জিত! যারা আওয়ামী লীগ সমর্থক, আওয়ামী লীগ সরকার যা করে (ভাল/মন্দ) সব কিছুতে বাহবা ও সমর্থন দেয়। তেমনি যারা বিএনপি সমর্থক, বিএনপি যা করে (ভাল/মন্দ) সব কিছুতে বাহবা, সমর্থন দেয়।
একটি বিষবৃক্ষ যত বড়ই বা হƒষ্টপুষ্ট হোক না কেন, তাতে কী তার জৈব ও জিন প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যের কোনো পরিবর্তন হয়ে যাবে? দেশের রাজনীতি এখন ক্যান্সারে আক্রান্ত। বরং ক্যান্সারের চেয়েও ভয়াবহ। মরণব্যাধি ক্যান্সারে আক্রান্ত হলে যার হয় সে মরে; কিন্তু বাংলাদেশের রাজনীতি এমন রোগে এ্যাফেক্টেড বা প্রভাবিত যা একটি জাতি বা দেশকে ধ্বংস করতে যথেষ্ট! বাংলাদেশের কোনো রাজনৈতিক দলই আমাদের কাছে অপরিক্ষিত নয়। জাতীয় পার্টি, বিএনপি, আওয়ামী লীগ, কেউই একটি শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন গঠন করেননি। আজ যারা ক্ষমতার বাইরে তারা বুঝছেন ঠেলা কাহাকে বলে! দু মেয়াদে পাওয়ারে ছিলেন বেগম খালেদা জিয়া। ‘হাওয়া ভবন’ ছিল এক সময় এক বিকল্প প্রশাসন। এ ভবনকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠেছিলো দেশের অর্থনীতি বিধ্বংসী দুর্নীতির এক ভয়াবহ বলয়। বাংলাদেশে কোনো দলই অহিংস নয়। সবাই হিংসাÍক রাজনীতি করে। আমরা রাজনৈতিক দল থেকে বন্দুক চালানো দেখেছি, রগকাটা দেখেছি, আবার গ্রেনেড মারাও দেখেছি। জনগণের জন্য নয় বরং গদির জন্য রাজনীতি! এরা ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য সংসদে বিভিন্ন নিয়ম পাশ করে। এরপর বলে সাংবিধানিকভাবে সব হবে। বিএনপিও ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন ও কেয়ারটেকার নিয়ে বহু টালবাহানা করেছিল। তারা পারেনি, আওয়ামী লীগে পেরেছে হরতাল অবরোধের মতো ফাইটফুল মুভমেন্টে।
মানুষ হত্যা হলে বিচার হয়, বা ভুক্তভুগি বিচার পায়। এখন কেউ যদি বলে, এই হত্যার বিচার করা যাবেনা এবং এর জন্য একটা আইন করা হয়, যেন কেউ কোনদিন এই হত্যার বিচার বাংলাদেশের কোন আদালতে উঠাতে না পারে। বাংলাদেশের কিছু অন্ধজ্ঞানী, বুদ্ধীজীবি মানুষও এই আইনকে সমর্থন করেছিল। সেই আইনটি হলো ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ, যেটা পরে পার্লামেন্টে পাশ করে আইন হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। শেখ হাসিনা নির্বাচনী ম্যান্ডেটে তার পিতার হত্যার বিচার করবেন বলে জানিয়েছিলেন। ক্ষমতায় এসে আদালতের মাধ্যমে বিচার করেছেন, অনেকেরই ফাঁসি হয়েছে। এখন আওয়ামী লীগ আশঙ্কা করছে ক্ষমতা হারালে তাদের ওপর প্রতিশোধ নেওয়া হবে। সুতরাং বর্তমান অবস্থায় শেখ হাসিনার কিছুই করার নেই। সঙ্গতভাবেই আওয়ামী লীগকে পিঠ বাঁচাতে আবারো ক্ষমতায় থাকা ছাড়া কোনো পথ নেই।
সংঘাত-সহিংসতা ছাড়া সামনে কিছু দেখা যাচ্ছে না। বাংলাদেশের রাজনীতি আবারও লড়াই, সংঘর্ষ হরতাল-অবরোধ, জ্বালাও-পোড়াওয়ের মতো সহিংস ফাইটিংয়ের পথেই ফিরে আসছে বলে আশঙ্কা অনেকেরই। কিন্তু এর পরে কী? মিছিল দেখলেই পুলিশ বাড়াবাড়ি রকম শক্তি প্রয়োগ করে যেভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ছে তা মোটেও স্বাভাবিক নয়। বিরোধী দলকে শক্তি প্রয়োগে রুদ্ধ করার অর্থ হচ্ছে তাদের অস্বাভাবিক কোনো ধ্বংসাÍক পথে ঠেলে দেওয়া, যা কখনোই কাম্য হতে পারে না। রাষ্ট্রীয় শক্তির অপব্যবহার করে রাজনৈতিক দলকে দমন করা আখেরে রাজনীতির জন্য শুভকর নয়। গত ২৮ অক্টোবর থেকে ২০ নভেম্বর পর্যন্ত প্রায় ১৫০টি যানবাহনে (ট্রেন ছাড়া) আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। এ গাড়িগুলো কি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার, না আওয়ামী লীগের, না দেশের সম্পদ?
ভোটের দিন গণনা শুরু হয়েছে। হাতে আছে আর মাত্র ৬/৭ সপ্তাহ। সবার মুখে কমন একটা প্রশ্ন কী হবে? সকলেরই মন দুলছে পেন্ডুলামের মতো। একবার এদিকে যায়, আরেকবার ওদিকে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল দেশের ক্ষমতাসীন এবং বিরোধীদের মুখোমুখি অবস্থায় দুই মেরুতে রেখে চরম বিরোধপূর্ণ একটি পরিস্থিতির মধ্যেই গত ১৫ নভেম্বর দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছেন। ফলে বাস্তবতা হচ্ছে সবার প্রত্যাশিত অংশগ্রহণমূলক, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের সম্ভাবনা এতে আরও কঠিন হয়ে উঠলো। তফসিল ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে যে প্রশ্নগুলো ইতিমধ্যে অসংখ্যবার উচ্চারিত হচ্ছে, তা হলো এর পরে কী হবে, দেশের রাজনীতি কোথায় যাচ্ছে? তফসিল অনুযায়ী, আগামী ৭ জানুয়ারি ভোটগ্রহণ। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতা ছাড়াই নির্বাচনের তফশিল ঘোষিত হওয়ায় তা অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের সম্ভাবনাকে কার্যত অসম্ভব করে তুলেছে।
দেশে একটি যুদ্ধ যুদ্ধ খেলার পূর্বাভাস দৃশ্যমান, যাতে মানুষ হতাশ হয়েছেন, দুঃখ পেয়েছেন এবং বিমূঢ় হয়েছেন। এমন পরিস্থিতি কাম্য ছিল না। নির্বাচন নিয়ে বিপর্যয় হোক, কোনো অঘটন ঘটুক দেশের শান্তিপ্রিয় জনগণ তা কিছুতেই চাচ্ছেন না। দ্রব্যমূল্যের উত্তাপে নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যে হাত দেওয়া যাচ্ছে না। রাজনীতি যত সাংঘর্ষিক হবে, জনশৃঙ্খলা ততই হুমকির মধ্যে পড়বে। তার তাপ এসে লাগবে বাজারে। মানুষের আয়রোজগারের পথ সংকুচিত হবে। দুর্দশার সীমা থাকবে না।
আওয়ামী লীগ অনেক দিক দিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে সফল হয়েছে। বিরোধী দলকে মাঠে দাঁড়াতেই দিচ্ছে না। গত তিন মেয়াদে ক্ষমতায় আছে। কাউকে পাত্তা না দিয়ে নিজেদের মতো করেই দুটি নির্বাচন করে ফেলেছে। ২০১৪ সালের নির্বাচনে অর্ধেকের বেশি প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছিলেন। ২০১৮ সালের নির্বাচনে একচেটিয়াভাবে জিতে এসে সরকার গঠন করেছে। দু-দুটি প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন করার পরও আওয়ামী লীগের অবস্থান কেউ টলাতে পারেনি। আওয়ামী লীগ যেখানে ছিল, সেখানেই আছে। ২০২৪ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে হয়তো সরকারি দলের প্রত্যাশা অনুযায়ী সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষা করা যাবে, কিন্তু গ্রহণযোগ্যতা নিশ্চিত করা যাবে কী?
যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে সবার অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন চায় এবং তা নিশ্চিত করতে তারা সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ করে আসছে। আমেরিকার সমঝোতা কী বানরের পিঠা ও কুমিরের শিয়ালের বাচ্চা ভাগ! নাকি সত্যিকারের গণতন্ত্র ও মানবিকতার জন্য। নাহলে গাজায় বর্বোরোচিত ইসরাইলি হামলার পর যারা এদেরকে সাপোর্ট দিয়ে যায়, তারা গণতন্ত্র নয় অন্য কিছুর জন্য লাফালাফি করে। শুধু গণতন্ত্রের প্রতি ভালোবাসা বা বাংলাদেশের মানুষের আকাক্সক্ষা বাস্তবায়নই যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশ্য, এমনটি ভাবা ঠিক হবে কী? আমেরিকা এক সময় এভাবেই ইরাকের, লিভিয়া, আফগানিস্তান, সিরিয়া, মিশরের বন্ধু ছিল। প্রতিটি দেশে চরম অস্থিতিশীল পরিস্থিটি সৃষ্টি করে, পরিশেষে ঘোলা পানিতে ইনটেনশন মোটিভ বাস্তবায়ন করে আমেরিকা। তাদের এ অবস্থানের পেছনে অবশ্যই ধর্ম ও ভূরাজনৈতিক বিবেচনা ক্রিয়াশীল, তাতে কোনো সন্দেহ আছে কী?
রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতায় দেশের রাজনীতিবিদদের আর্থিক বা খাওয়া-পড়া, হাট-বাজার করা নিয়ে কোন ভাবনা-চিন্তার কারণ আছে কী? চাল, ডাল, তেল, পেয়াজের কেজি হাজার টাকা হলেও তাদের অবাধ, স্বচ্ছন্দ, সাবলীল, বিলাসমগ্ন জীবনমানে কোন বাধা, বিঘœ, অন্তরায়, প্রতিবন্ধকতা বা সুখনিদ্রার কোন ব্যাতয় ঘটবে কী? একটু কম খাওয়া বা কৃচ্ছতাসাধনেরও উদ্বেগ, উৎকলিকা বা ন্যূনতম অনুচিন্তার কারণ আছে কী? একজন ইউপি চেয়ারম্যান প্রথমবারের মতো নির্বাচিত হয়ে শত কোটি টাকার মালিক বনে যান। উপজেলা চেয়ারম্যানতো হাজার কোটি। এরপর নেতা, কমিশনার, মেয়র, এমপি, মন্ত্রী, আমলা, উপদেষ্টা এদের তো শত-হাজার কোটিতেও পোষাবে না। তথ্যউপাথ্য পেতে হলে সুইস ব্যাংকের দ্বারস্থ হতে হবে। যখই দেশের রাজনৈতিক অবস্থা অস্থিতিশীলতায় নিপতিত হয় তখন অনাহারে, অর্ধাহারে থাকতে হয় খেটে খাওয়া মানুষেরই। ক্ষতিগ্রস্ত হয় দেশের অর্থনীতি। সাধারণ মানুষ দিনরাত পরিশ্রম করে দেশকে উন্নয়নের পথে রাখে। রাজনীতিতে পরমতসহিষ্ণুতা না থাকা ও গোয়ার্তুমি, একঘুয়েমির কারণে সাধারণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
বর্তমানে দেশে বিভেদ, অনৈক্য, মতভেদের যে শঙ্কা দেখা দিয়েছে, তার কারণ রাজনৈতিক দলগুলোর পরস্পরের প্রতি সন্দেহ-অবিশ্বাস। এই অনাস্থা, অবিশ্বাস অনেক দিন ধরেই চলছে। এত দিনে এর অবসান হওয়া উচিত ছিল; কিন্তু হয়নি। বাংলাদেশে রাজনৈতিক অঙ্গনে সংঘাত ও অস্থিতিশীলতা সর্বদাই অনিবার্য। যার মূল কারণ ছাড় দেওয়ার মানসিকতা কারো নেই। জনগণের সেবার নামে জনগণকে জিম্মি করাই যেন বর্তমান রাজনীতির মূল লক্ষ্য। এই মানসিকতার পরিবর্তন না হলে রাজনীতিতে কখনোই স্থিতিশীলতা আসবে না। দেশ রক্ষা ও দেশের উন্নয়নের স্বার্থে সব রাজনীতিবিদের ছাড় দেওয়ার মানসিকতা থাকতে হবে। সংলাপের টেবিলেই সমাধান খুঁজতে হবে। দিন যতই এগোচ্ছে শঙ্কা ততই বাড়ছে। এ দেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলকে নিয়ে মানুষ শঙ্কিত। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা যখন বিরাজ করে তখন সাধারণ মানুষ উৎকণ্ঠা বোধ করে। রাজনৈতিক দলগুলোকে এটি অনুধাবন করতে হবে।