চলমান সংকটে রেমিট্যান্স বৃদ্ধি ও শিল্প কারখানাকে পূর্ণ উৎপাদনে রাখা জরুরি

:: Rayhan Hossain
প্রকাশ: ২ years ago

আতিক আজিজ: 
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ৭ নভেম্বর সোমবার একই সঙ্গে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের ১০০ সেতু উদ্বোধন করেছেন। দেশের ২৫ জেলায় ৮৭৯ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত ওই সেতুগুলোর কারণে সংশ্লিষ্ট এলাকার যাতায়াত ব্যবস্থা সহজতর হবে। যে কোনো দুর্যোগে মানুষকে সাহায্য করা সহজ হবে, পণ্য পরিবহন ও বিপণন দ্রুত করা যাবে। সেতুগুলো রাজধানীর সঙ্গে সরাসরি সড়ক যোগাযোগ স্থাপন করেছে, কারণ এগুলো ৩৩টি রুট ফেরি পরিষেবা থেকে মুক্তি দিয়ে সড়ক যোগাযোগকে অবাধ, দ্রুত, সহজ ও নিরাপদ করবে।

উদ্বোধনকালে গণভবনের সঙ্গে ভার্চুয়ালি সুনামগঞ্জ, বরিশাল, খাগড়াছড়ি ও চট্টগ্রাম জেলা প্রান্ত যুক্ত ছিল। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ক্ষমতায় থাকা এ ১৪ বছরে বিভিন্ন মহাসড়কে ১ লাখ ১৩ হাজার ৩০৩ মিটার সেতু পুনর্নির্মাণ ও ২১ হাজার ২৬৭ মিটার কালভার্ট তৈরি করা হয়েছে। মহাসড়কগুলো আরও উন্নত করা হচ্ছে যাতে যোগাযোগব্যবস্থা সহজ হয়। আশ্চর্যের বিষয়, একই সঙ্গে ১০০ সেতু নির্মাণ ও সেগুলোর উদ্বোধন করা সম্ভব হয়েছে। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে সমগ্র বাংলাদেশে সরকার শতভাগ সফল হয়েছে, এজন্য তিনি সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রীসহ মন্ত্রণালয়ের সবাইকে ধন্যবাদ জানান। শত সেতু উদ্বোধন উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। আজকের যুগ যোগাযোগের। অবকাঠামোগত উন্নয়ন একটা জাতিকে যেমন উন্নয়নের পথে এগিয়ে নিতে পারে, তেমনি অবকাঠামোগত পশ্চাৎপদতা একটি জাতির সম্ভাবনা পিছিয়ে দেয়। দারিদ্র্য বিমোচনেও যোগাযোগ ব্যবস্থা বা অবকাঠামোগত উন্নয়নের বিকল্প নেই। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল একসময় ছিল মঙ্গাক্রান্ত। যমুনা নদীর ওপর বঙ্গবন্ধু সেতু নির্মাণের পর মঙ্গা নামের সাংবার্ষিক যিনি দুর্ভিক্ষের অবসান শুধু নয়, উত্তরাঞ্চল জাতীয় অগ্রগতির অংশীদারে পরিণত হয়েছে। পদ্মা সেতু দেশের দক্ষিণ- পশ্চিমাঞ্চলের পশ্চাৎপদতার অবসানে ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা হচ্ছে। উদ্বোধন করা শত সেতু সংশ্লিষ্ট এলাকার জনজীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটালে তা হবে আমাদের এক বড় অর্জন।

বর্তমান অর্থনৈতিক সংকটের প্রেক্ষাপটে আয়েশি বিলাসী প্রকল্প নেওয়া থেকে বিরত থাকতে নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এসময় তিনি অপচয় কমানোর পাশাপাশি মিতব্যয়ী হওয়ারও পরামর্শ দেন।

গত ৮ নভেম্বর মঙ্গলবার জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদ- একনেক’র বৈঠকে একথা বলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে এনইসি সম্মেলন কক্ষে তাঁর সভাপতিত্বে এ বৈঠক হয়। বৈঠকে তিন হাজার ৯৮১ কোটি ১০ লাখ টাকার সাতটি প্রকল্প অনুমোদন হয়। সভায় সরকারপ্রধান বলেন, আয়েশি-বিলাসী প্রকল্প নেওয়া যাবে না। তবে ছোট গ্রামীণ প্রকল্প বা কল্যাণমুখী প্রকল্পের বিষয়ে আপস নয়। বড় বড় প্রকল্প নেওয়া যাবে না। বড় প্রকল্প গ্রহণে ফিসিজিবিলিটি স্টাডি গভীরভাবে দেখতে হবে। যে কৌশলে কমিশন এক বছর ধরে কাজ করছে এটা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। ইউক্রেন- রাশিয়ার যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে বিশ্বে জ্বালানি ও অর্থনৈতিক সংকটের প্রসঙ্গ তুলে তিনি বলেন, শুধু আমাদের দেশে নয়, দুনিয়াব্যাপী মন্দা চলছে। অপচয় কমানোর পাশাপাশি মিতব্যয়ী হতে হবে। সভা শেষে সাংবাদিকদের কাছে এসব তথ্য তুলে ধরেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান। প্রধানমন্ত্রীর অনুশাসন তুলে ধরে পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, আমাদের উৎপাদন বাড়াতে হবে। সারা দেশে এক ইঞ্চি জমিও ফেলে রাখা যাবে না। জমিতে নানা ধরনের চাষাবাদ করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী কেবিনেট সচিবকে নির্দেশ দিয়েছেন। একনেক সভায় ৩ হাজার ৯৮১ কোটি ৯০ লাখ টাকা ব্যয় সম্বলিত সাতটি প্রকল্প অনুমোদন দেয় জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক)। এর মধ্যে সরকারি অর্থায়নে ৩ হাজার ৩৯২ কোটি ৩৩ লাখ টাকা, বৈদেশিক অর্থায়নে ৩২২ কোটি ২১ লাখ টাকা এবং সংস্থার নিজস্ব অর্থায়ন ২৬৭ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। পরিকল্পনা মন্ত্রী জানান, সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আরও বলেন, বড় বড় প্রকল্প নেওয়া যাবে না। বড় প্রকল্প গ্রহণে ফিজিবিলিটি স্টাডি গভীরভাবে দেখতে হবে। দুনিয়াব্যাপী মন্দা চলছে, অপচয় কমানোর পাশাপাশি মিতব্যয়ী থেকে হবে। তিনি বলেন, দেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা অনাবাদি জমি খুঁজে বের করতে হবে। অনাবাদি জমি আবাদযোগ্য করার জন্য তিনি ডিসিদের নির্দেশ দেন। সভায় অনুমোদিত প্রকল্পগুলোর মধ্যে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের ‘চট্টগ্রামের মিরসরাই ও সন্দ্বীপ, কক্সবাজারের সোনাদিয়া দ্বীপ ও টেকনাফ সাবরাং ও জালিয়ার দ্বীপ) অংশের জেটিসহ আনুষঙ্গিক স্থাপনাদি নির্মাণ’ প্রকল্প; স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের ‘ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন এলাকায় অঞ্চল-২ ও অঞ্চল- ৪ এর ক্ষতিগ্রস্ত সড়ক অবকাঠামোসহ অঞ্চল-২ ও অঞ্চল-৪ এর সার্ভিস প্যাসেজসমূহের উন্নয়ন’ প্রকল্প এবং গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের ‘বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ ভবন এলাকার বৈদ্যুতিক যান্ত্রিক ও নিরাপত্তা ব্যবস্থাসহ অন্যান্য উন্নয়ন কাজ প্রকল্প। সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের দুটি প্রকল্প পাস হয়েছে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের “দিনাজপুর অঞ্চলে টেকসই কৃষি উন্নয়ন’ প্রকল্প এবং বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের ‘চট্টগ্রাম অঞ্চলের বিদ্যুৎ সঞ্চালন ব্যবস্থার সম্প্রসারণ ও শক্তিশালীকরণ (১ম সংশোধিত)’ প্রকল্প অনুমোদন পেয়েছে।

আর এদিকে সম্প্রতি, আশি কোটি টাকার প্রকল্পে পরামর্শক বায় ধরা হয়েছে ৬৪ কোটি টাকা। গ্রামীণ অঞ্চলের যোগাযোগব্যবস্থার উন্নায়ন করতে গুরুত্বপূর্ণ সড়কে সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এর মাধ্যমে পিছিয়ে পড়া ওইসব এলাকায় ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়বে, কমবে দরিদ্রতা। তবে এই প্রকল্পের পরামর্শক বায় নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

পরিকল্পনা কমিশনের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, পরামর্শক খাতের এই ব্যয় অনেক বেশি। অর্থচ একই ধরনের আগের একটি প্রকল্পের মোট ব্যয়ই ছিল ৪৬ কোটি টাকা। সেখানে এই প্রকল্পের পরামর্শক যায় কীভাবে ৬৪ কোটি টাকা হয়। আর এটি একটি জরিপ প্রকার। সেখানে জরিপ খাতে মাত্র ১৪ কোটি টাকা রাখা হয়েছে। এত কম টাকায় জরিপ করা গেলে পরামর্শক বায় এত বেশি হয় কীভাবে? সামনের প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির সভায় এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হবে।

জানা গেছে, পল্লী সড়কে গুরুত্বপূর্ণ সেতু নির্মাণের স দ্বীপ) শীর্ষক প্রকল্পটির বাস্তবায়নকাল ধরা হয়েছে চার বছর। প্রকল্পটি চলতি বছর শুরু হয়ে ২০২৬ সালের জুন মাসে শেষ হবে। স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতর। প্রকল্পটি ২০২২-২৩ অর্থবছরের এডিপিতে অননুমোদিত প্রকল্প তালিকায় অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। দেশের আটটি বিভাগের ৫৮টি জেলার ১৪২টি উপজেলায় ২০০টি সেতু নির্মাণ করা হবে ।

এই বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আ মোহাম্মদ বলেন, ‘পরামর্শক খাতে এত বেশি ব্যয় ধরার কারণ হচ্ছে তাদের কিছু আয় হবে। নামসর্ব একটি ফার্মের মাধ্যমে তারা ফিজিবিলিটি স্টাডি করাবে। এরপর এর ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে সেতু নির্মাণ করা হবে। সেই সেতুর কোনো অংশ যদি ভেঙে পড়ে তাতেও তাদের জবাবদিহি করতে হবে না। একটি প্রকল্পের কাজে জবাবদিহিতা থাকতে হয়, তাহলেই সুষ্ঠুভাবে কাজ সম্পন্ন হয়। একটি প্রকল্পের পরামর্শক ব্যা মোট ব্যয়ের ১০ শতাংশের বেশি হতে পারে না। প্রকল্প পরিচালক এবাদত আলী বলেন, পরামর্শক খাতে যে টাকা ধরেছে তার কোনো ব্যাখ্যা নেই। তারও বেশি লাগে। ব্যয় আরও বেশি ছিল কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। টাকা যদি কম নেওয়া হয় তাহলে কোনো না কোনোভাবে কাজে ডাকি দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। কাজে যেন ফাঁকি না দেয় সে জন্য তাদের ওপর বেশি করে নজরদারি করতে হয়। টেন্ডারের মাধ্যমে প্রতিযোগীরা কাজের আবেদন করে। সেখান থেকে যার রেট কম তাকে দেওয়া হয়।

পরিকল্পনা কমিশন বলছে, এলজিইডি এর আগে ‘পল্লী সড়কে গুরুত্বপূর্ণ সেতু নির্মাণের সমীক্ষা (প্রথম সংশোধিত) প্রকল্প বাস্তবায়ন করে। ২০১৭ থেকে ২০২১ নেয়ানে বাস্তবায়িত এই প্রকল্পের ব্যয় ছিল ৪৬ কোটি ৭৬ লাখ টাকা। নতুন প্রকল্পটি গ্রহণের ক্ষেত্রে আগের প্রকল্পের অভিজ্ঞতা কাজে লাগানো যেতে পারে। পরিকল্পনা কমিশন প্রকল্পটি নিয়ে আপত্তি তুলেছে। সামনে প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভায় এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হবে। প্রকল্পটি যে বরাদ্ধ চেয়েছে তাতে অনৈতিক চাহিদা। গ্রামীণ মানুষের সুবিধাদির কথা চিন্তা করে সর যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তা নিঃসন্দেহে একটি সময়োপযোগী উদ্যোগ। তাতে ৮০ কোটি টাকা ব্যয় হবে। অথচ পরামর্শক খাতে শুরুতেই সংশ্লিষ্টরা যে বরাদ্দ চেয়েছে তাতে পরামর্শক ব্যতিরেকে বাকি টাকায় সমীক্ষার কাজ কতটা হবে তা নিয়েও সংশয় দেখা দিয়েছে। তাই শুরুতেই যে বরাদ্দ চেয়েছে তা গ্রহণযোগ্য নয় বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। গোটা বিশ্ব এখন মন্দা ঝুঁকির মুখোমুখি। এ সময় আমাদের দেশেও সবকিছুতে যুদ্ধসাধনের কথা বলা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ বিষয়ে বারবার সতর্ক হতে বলেছেন। গত মঙ্গলবার একনেকের সভায় তিনি নির্দেশনা দিয়েছেন, “আরেশিণবিলাসী প্রকল্প নেওয়া যাবে না।’ এরপরও কোনো প্রকল্পে অপ্রয়োজনীয় ব্যয়ের প্রস্তাব মেনে নেওয়া যায় না। যেহেতু প্রকল্পটি নিয়ে শুরুতেই প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, সেহেতু বিষ্যাটিকে গুরুত্ব সহকারে নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ করে ক্যাশের ব্যাপারে সংশ্লিষ্টরা সচেতনতার পরিচয় দেবেন-সেটাই আমাদের কাম্য।

সরকারি-বেসরকারি খাত মিলিয়ো দেশের এখন বিদেশি ঋণের পরিমাণ ৯৫ দশমিক ৮৫ বিলিয়ন (৯ হাজার ৫৮৫ কোটি) ডলার ছাড়িয়েছে। বর্তমান বিনিময় হার অনুযায়ী বাংলাদেশি মুদ্রায় এ ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ১০ লাখ ছয় হাজার কোটি টাকারও বেশি, যা দেশের মোট জিডিপির প্রায় ২২ শতাংশ। বিপুল অঙ্কের এ ঋণের ৭৩ শতাংশ সরকারের। পাঁচ বছরেই দ্বিগুণ : গত পাঁচ বছরেই বৈদেশিক ঋণ বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বিদেশি। ঋণের পরিমাণ ছিল ৪৫ দশমিক ৮১ বিলিয়ন ডলার অর্থাৎ চার হাজার ৫৮১ কোটি ডলার। গত ২০২১-২২ অর্থবছরের মার্চ শেষে এ গাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯৩ দশমিক ২৩ বিলিয়ন বা ৯ হাজার ৩২৩ কোটি ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় আট লাখ ৭৬ হাজার কোটি টাকার বেশি। এ সংখ্যা মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রায় ২১ শতাংশ। আর এখন বিদেশি ক্ষণের পরিমাণ ৯৫ দশমিক ৮৫ বিলিয়ন ডলারে ঠেকেছে। ১৬৫ বিলিয়ন ডলার ছাড়াবে ২০২৩ সালে এদিকে আগামী বছর শেষে বাংলাদেশের বিদেশি ঋণের পরিমাণ ১৯৫ বিলিয়ন ডলার ছাড়াবে। আর ২০২৪ সাল শেষে বিদেশি ফলের পরিমাণ দাঁড়াবে ১৩০ বিলিয়ন ডলারে। দেশের বৈদেশিক মুদ্রাবাজার নিয়ে করা এক পর্যবেক্ষণে সরকারি- বেসরকারি খাতের বিদেশি ঋণ নিয়ে এ পূর্বাভাস দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ফল শোধ করতে হবে দ্বিগুণ হারে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, ২০২১ সালে সুদসহ দেশের বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের পরিমাণ ছিল ১১ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার। গত বছরের তুলনায় চলতি বছর বাংলাদেশকে দ্বিগুণ বিদেশি ঋণ পরিশোধ করতে হবে। ২০২২ সাল শেষে বিদেশি ঋণ পরিশোধের পরিমাণ ঠেকবে ২৩ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলারে। এর মধ্যে দেশের বেসরকারি খাতকে প্রায় ১৮ বিলিয়ন ডলার পরিশোধ করতে হবে। বাকি পাঁচ বিলিয়ন ডলার পরিশোধ করবে সরকার। তবে আগামী দুই বছর বিদেশি ঋণ পরিশোধের চাপ কিছুটা কমবে বলে মনে করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ সময়েও প্রতিবছর সুদসহ ২০ বিলিয়ন ডলার বিদেশি ঋণ পরিশোধ করতে হবে বাংলাদেশকে।

গত ২৬ অক্টোবর বাংলাদেশে সফররত আইএমএফের প্রতিনিধি দল বলেছে, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ভালো। এ দেশের অবস্থা কখনোই শ্রীলঙ্কার মতো হবে না। বর্তমানে রিজার্ভের যে অবস্থা তা অনায়াসে তিন মাসের জন্য পণ্য আমদানি করতে পারবে। বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ যে অবস্থানে রয়েছে তা অন্য দেশের তুলনায় অনেক ভালো। ১৫ দিনের সফর শেষে সচিবালয়ে সাংবাদিবদের এক বিচিংয়ে এসব কথা বলেন প্রতিনিধি দলের নেতা রাহুল। তিনি বলেন, কোন ধরনের শর্ত আরোপ করা হয়েছে- এ প্রশ্নের জবাবে রাহুল আনন্দ জানান, শর্ত নয়, কর্মসূচির আওতায় বেশকিছু বিষয় অন্তর্ভুক্ত করার ব্যাপারে সুপারিশ রাখা হয়েছে। আইএমএফ দলনেতা জানান, বাংলাদেশে বেশকিছু সমস্যার মধ্যে দীর্ঘমেয়াদে কিছু গুরুতর কাঠামোগত সমস্যা রনো গেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বিনষ্ট হচ্ছে। সফলভাবে এনডিসি উত্তরণে অতীতের সফলতার ওপর ভর দিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। কাঠামোগত সমস্যাগুলো আমলে নিতে হবে। ঋণের প্রেক্ষাপট নিয়ে রাহুল জানান, দেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা পুনরুদ্ধার ও বিভিন্ন ধরনের বিঘ্ন সৃষ্টিকারী উপাদান ঠেকাতে নতুন এ ঋণ দেওয়ার ব্যাপারে সমঝোতা হয়েছে। এর পাশাপাশি অন্তর্ভুক্তিমূলক ও পরিবেশবান্ধব উন্নয়নে সহায়তা দিতে কাঠামোগত পরিবর্তনেও জোর দেওয়া হয়েছে।

বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বিভিন্ন ইস্যুতে আলাপ হয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বেশকিছু পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না, বাংলাদেশের সঙ্গে আমাদের দীর্ঘদিনের সম্পর্ক। এ সম্পর্ক অত্যন্ত বন্ধুত্বমূলক। এ সম্পর্কের ভিত্তিতে ঋণ দেওয়ার ব্যাপারে সম্মত হয়েছি। তবে হ্যাঁ, ভ্যাট আইন আরও আধুনিকায়ন করতে বলা হয়েছে। যেন কোনো ধরনের হয়রানি ছাড়াই ভ্যাটের যাওতা বাড়িয়ে রাজস্ব বৃদ্ধি করা যায়। সরকারের মধ্যে যেসব বিষয়ে দুর্বলতা রয়েছে তা কাটিয়ে উঠে যুগোপযোগী করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংকটের কারণে দেশের কারখানা গুলোর উৎপাদন অর্ধেকে নেমে এসেছে। কোনো কোনো কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। এজন্য শিল্প মালিকদের কাজ না করে শ্রমিকদের বেতন দিতে হচ্ছে। আর খন্ডকালীন শ্রমিকদের আয় বন্ধ হয়ে গেছে। শুধু তাই নয়, উৎপাদন না করেও তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ ও বিদ্যুৎ বিতরণ কর্তৃপক্ষকে প্রতি মাসে নুন্যতম বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করতে হচ্ছে। এতে রপ্তানির বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। অন্যদিকে অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যেও পণ্যের দাম বাড়ছে।

কাপড় উৎপাদনের জন্য নরসিংদীতে ছোট- বড় মিলিয়ে প্রায় পাঁচ হাজার বস্ত্র কল রয়েছে। এসব কারখানায় উৎপাদিত কাপড় সেকেরচর বাবুর হাটের মাধ্যমে সারা দেশে বিক্রয় হয়। বিদ্যুৎ গ্যাস সংকটের ফলে এখন কারখানা অর্ধদিবস বন্ধ রাখতে হচ্ছে। অন্যদিকে গাজীপুরে অনেক শিল্প প্রতিষ্ঠান রয়েছে। রপ্তানি নির্ভর গার্মেন্টস ও সিরামিকের অধিকাংশ কারখানা এখানে রয়েছে।
গাজীপুরে মোট কারখানার সংখ্যা ২ হাজার ১৬৫টি। এর মধ্যে পোশাক কারখানা আছে ১ হাজার ১৮৭ টি। এ ছাড়া বেশ কিছু লাইসেন্সবিহীন ছোট ছোট কারখানা রয়েছে। এর অধিকাংশই গ্যাস নির্ভর। কিন্তু গ্যাসের চাপ কমে যাওয়ায় গত কয়েক মাস থেকে কারখানা গুলোর উৎপাদন মারাত্মক ভাবে ব্যহত হচ্ছে। চামড়া শিল্প নগরীতে রয়েছে ১৪২ টি ট্যানারি। কিন্তু বিদ্যুৎ সংকটের কারণে উৎপাদন কমে গেছে। রপ্তানি নির্ভর এ শিল্পে বর্তমান ৬/৭ ঘণ্টা লোডশেডিংয়ের কারণে – উৎপাদন বন্ধ থাকছে। অন্যদিকে বন্দর নারী নারায়ণগঞ্জে পোশাক কারখানা সহ শিল্প কারখানা আছে ১ হাজার ৭৮৫টি। কিন্তু প্রতিদিন ৩/৪ বার লোডশেডিংয়ের কারণে ও গ্যাসের নিম্ন চাপের কারণে শুধু উৎপাদন ব্যবহৃত হচ্ছে না, অনেক কারখানা বন্ধও রাখতে হচ্ছে। অন্যদিকে ময়মনসিংহের ভালুকায় ছোট বড় মিলিয়ে প্রায় ৩৫০ কারখানা রয়েছে। এলাকায় দিনে ৮/৯ ঘণ্টা বিদ্যুৎ না থাকায় উৎপাদন ৩০/৪০ শতাংশ কমে গেছে। অনেক কারখানা মালিক উৎপাদন অব্যাহত রাখতে জ্বালানি তেলের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে চেষ্টা করলেও বাড়তি খরচের কারণে পণ্যের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে। যা নিয়মিত ভাবে নির্বাহ করা অনেকের পক্ষেই সম্ভব হচ্ছে না। ফলে সংকট খনি- ভূত হচ্ছে। তবে সিত্রাং ঘূর্ণি ঝড়ের পর বিদ্যুৎ সরবরাহ কিছুটা বাড়লেও চলমান সংকট থেকে বের হওয়া সম্ভব হচ্ছে না। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে সারা বিশ্বেই জ্বালানি তেল ও গ্যাসের দাম বেড়েছে। সাথে ডলারের বিপরীত মূল্যস্ফীতি হওয়ার সংকট আরো বেশি ঘনীভূত হয়েছে। কাজেই চাহিদা অনুসারে বিদ্যুৎ গ্যাস সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে না। ডলার সংকটের এ সময় যদি রপ্তানি বাণিজ্য না বাড়ানো যায় তবে সংকট যে আরো ভয়াবহ রূপ নেবে তা না বললেও খুব সহজেই অনুমেয়।

আমরা প্রতি নাসেই এক-দুই বিলিয়ন করে রিজার্ভ হারাচ্ছি। এর মানে আমরা বাজারে ডলার ছাড়ছি। এতে রিজার্ভ কমছে। এখানে আমাদের সমন্বয়ের জন্য রফতানি বাড়াতে হবে এবং আমদানি নির্ভরতা থেকে সরে আসতে হবে। আমাদের দেখতে হবে আমেরিকা থেকে বৈধ পথে বেশি রেমিট্যান্স আসছে, কেন মধ্যপ্রাচ্য থেকে কম আসছে। প্রবাসীদের কাছে যেতে হবে, তাদের কথা শুনতে হবে। মার্কেটগুলোতে আমাদের প্রচার করতে হবে যে, আপনারা (প্রবাসী) শুধু আমাদের ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠান। এটা কেন্দ্রীয় ব্যাংক করতে পারে। শুধু ফরমান মার্কেট না কার্ব মার্কেটগুলোতেও কিছু ডলার দিতে হবে।

এ প্রসঙ্গে বিশ্ব ব্যাংকের সাবেক কর্মকর্তা ও পলিসি এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান মাশরুর রিয়াজ বলেন, ‘আমাদের চার স্থান থেকে রিজার্ভ আসত। এর মধ্য অন্যতম হলো রেমিট্যান্স। এখন রেমিট্যান্স কমেছে এটাকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে হবে। আমদানি-রফতানির ভারসাম্য বজায় রাখার উদ্যোগ নিতে হবে। বাংলাদেশে মোবাইলে আর্থিক সেবায় (এমএফএস) আমরা ভারত-শ্রীলঙ্কার পরে শুরু করলেও আমরা ভালো করছি। ডিজিটাল ফাইন্যান্সের ক্ষেত্রে আমাদের আরও উন্নতি দরকার। দুবাই থেকে রেমিট্যান্স কমেছে কেন সেটা খুঁজে বের করতে হবে। আবার সেই দুবাইয়ে আবাসন যাতে আমাদের বিনিয়োগ বেড়েছে এটাও দেখতে হবে।

সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের রেমিট্যান্স কমে এসেছে। প্রতি মাসেই এক থেকে দুই বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ থেকে বাজারে চলে যাচ্ছে। এতে রিজার্ভের পরিমাণ আরও কমে যাচ্ছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়াতে হলে রেমিট্যান্সকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নিতে হবে। এজন্য দেশের বাইরে প্রবাসীদের দোরগোড়ায় যেতে হবে। তাদের কথা শুনতে হবে, তাদের বোঝাতে হবে। একই সঙ্গে বৈধভাবে দেশীয় ব্যাংকের মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠাতে সহযোগিতা ও উৎসাহ দিতে হবে। এতে রেমিট্যান্স বাড়বে, রিজার্ভের পরিমাণও বেড়ে যাবে। তবেই কেটে যাবে চলমান সংকটের সব সমস্যা আর শঙ্কা। #

লেখক : কবি সাংবাদিক প্রাবন্ধিক মানবাধিকারকর্মী।
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : দৈনিক আজকালের সংবাদ
প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান : জাতীয় পরিবেশ মানবাধিকার সোসাইটি
ব্যবস্থাপনা পরিচালক : ইস্টিশন মিডিয়া লিমিটেড।