মেরুদণ্ড সোজা না থাকলে যা হয়!

:: মোহাম্মদ আবু নোমান ::
প্রকাশ: ১ বছর আগে

মীরজাফর এবং তার দোসররাও একসময় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি আর রবার্ট ক্লাইভের হস্তক্ষেপ চেয়েছিলো। ফলাফল? দুইশত বছরের ব্রিটিশ গোলামী আর দাসত্ব। ঠিক আমাদের বাঙালির চরিত্রটাও এমন। শুধু বিদেশী মোড়লদের হস্তক্ষেপ চাওয়া। বাংলাদেশে নির্বাচন এগিয়ে আসছে, দেশের ভেতরে রাজনৈতিক পরিস্থিতি ঘোলাটে হয়ে উঠছে, সহিংসতার লক্ষণ জেগে উঠছে। দেশের কোনো বিষয়ে, জাতীয় সংসদে, এমনকি জাতীয় কোনো ইস্যুতেও জাতীয় পার্টি, আওয়ামী লীগ ও বিএনপির একমত হওয়ার নজির নেই। এর কারণ, রাজনৈতিক দলগুলোর পারস্পরিক অবিশ্বাস। রাজনৈতিক দলের কারণে আমাদের প্রিয় দেশের মর্যাদা, সুনাম নষ্ট হচ্ছে। মোটকথা, রাজনীতিবিদরাই দেশের মর্যাদা নষ্টের অন্যতম কারণ। আমাদের দেশের অভ্যন্তরে বসে বিদেশি অনুঘটকরা যখন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সম্পর্কে বিভিন্ন ধরনের বক্তব্য উপস্থাপন করে, যাতে দেশের সরকার ও জনগণকেই মূলত খাটো করা হয়।
বাংলাদেশের নির্বাচনকেন্দ্রিক সমস্যা একদিনের নয়। যুগের পর যুগ ধরে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সহিষ্ণুতার অভাবের কারণে আজকের এ অবস্থা তৈরি হয়েছে। আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি কেউ আমাদের কাছে নতুন ও অপরিক্ষীত নয়। ক্ষমতায় থেকে কোনো দলই একটি শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন গঠন করেনি।
ভোট এলেই বিদেশি কূটনীতিকদের তৎপরতা আমাদের রাজনীতির দুর্বলতা। আমাদের নেতারা সব সময় তাদের দিকেই তাকিয়ে থাকেন। নালিশ জানানোর কারণে তারা আরও উৎসাহী হয়ে ওঠে। ইতিপূর্বে আমরা দেখেছি বিদেশী কূটনীতিকদের চায়ের দাওয়াত, ডিনার। আজ এক রাষ্ট্রদূতের বাসায় তো কাল এক নেতার বাসায়। এর সাথে মিডিয়ার ছুটোছুটি। কূটনীতিকরা যখন বিভিন্ন দেশে কাজ করেন, তারা নীরবে কাজ করেন। তারা (কূটনীতিক) যখন বিভিন্ন দেশে কোনো রাজনৈতিক নেতার সঙ্গে দেখা করেন, তখন তা প্রচারই করা হয় না। কারণ এটা তাদের রুটিন ওয়ার্ক। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ নিজেদের স্বার্থে তাদের প্রচারে নিয়ে আসেন।
বাংলাদেশের নির্বাচন ব্যবস্থা, অভ্যন্তরিন রাজনীতি কেমন হবে সেটা আমাদের জনগণই ঠিক করবে। দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর রেষারেষিতে বিদেশীরা মোড়লগীরি করার সুযোগ পায়। মেরুদণ্ড সোজা না হলে এমনই হয়। আমাদের দেশের রাজনীতিতে যতদিন পর্যন্ত সুস্থ ধারায় ফিরে না আসবে, ততদিন বিদেশি অনুঘটকদের অযাচিত মন্তব্য, অযথা নাক গলানোর প্রবণতাও দূর হবে না। এটা আমাদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির বড় দুর্বলতা।
দেশের রাজনৈতিক দল ও রাজনীতিবিদদের কেউ কেউ যেভাবে বিদেশি দূতাবাসে দৌড়ঝাপ করেন, তা লজ্জাজনক। অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের জন্য যারা বিদেশি রাষ্ট্রদূতদের আমন্ত্রণ জানান, তাদেরও মনে রাখতে হবে- রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান পারস্পরিক আলোচনা ও নিয়মতান্ত্রিক পন্থায়ই করতে হবে। অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বিদেশিদের কাছে অভিযোগ দেশের জন্য অসম্মানের। মূলত তাদের অভিযোগের কারণেই বিদেশিরা দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের সুযোগ পাচ্ছে।
আমাদের রাজনীতিতে পাল্টাপাল্টি বক্তব্য, মারমুখী অবস্থান যেনো নিত্যদিনের ইভেন্ট। আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে অবস্থিত বিদেশি বিভিন্ন দূতাবাসের কূটনীতিকদের বিভিন্ন ধরনের বক্তব্য বেশ কয়েক মাস ধরে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন দেশের দূতাবাস থেকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি সম্পর্কে মতামত প্রকাশের মাধ্যমে অনধিকার চর্চা করা হয়েছে। সরকারের তরফ থেকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে সরকারের তরফ থেকে প্রতিবাদ জানানোর পরও কূটনীতিকরা তাদের বক্তব্য থেকে সরে আসেননি। কূটনৈতিক শিষ্টাচার যেকোনো দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বের পরিপক্বতার প্রমাণ। শিষ্টাচারবহির্ভূত বক্তব্য উপস্থাপন বন্ধ না হওয়া দেশের রাজনীতির জন্য সুখকর নয়।
বাংলাদেশকে নিয়ে একদিকে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্ব গণতন্ত্র এবং নির্বাচন নিয়ে তাদের প্রত্যাশার কথা জানাচ্ছে, অন্যদিকে রাশিয়া আর চীন পশ্চিমা প্রত্যাশার বিরোধিতা করে ইদানীং প্রকাশ্যে নিজেদের অবস্থান তুলে ধরছে। বাংলাদেশেরকে ঘিরে ভূরাজনীতির যে গুরুত্ব তা নতুন কিছু নয়। বৈশ্বিক পরিস্থিতির পরিবর্তন হলেও ভূরাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বঙ্গোপসাগর ও মুসলিমপ্রধান বাংলাদেশের গুরুত্ব কখনোই কমেনি। এখন ভারত মহাসাগরীয় কৌশলের প্রেক্ষাপটে এবং বাংলাদেশের অবস্থানগত কারণে আমাদের নিয়ে পশ্চিমাদের মনোযোগ আগের থেকে বেড়ে গেছে।
মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি বেশ জটিল। মানবাধিকার প্রশ্নে ওয়াশিংটন যেভাবে মুখে ফেনা তুলে ফেলে, তাতে দেশটির হিপোক্রেসি বা কপটতা দিনের মতো ফর্সা। পশ্চিমাদের নৈতিকতা বা মুল্যবোধ চিরকালই স্বার্থের সাথে সম্পর্কিত। এখানে সততা বা মুল্যবোধের কোন ভূমিকা নেই। আমেরিকা কি জিনিস তা টের পেয়েছে, ইরাক, লিবিয়া, ফিলিস্তিন, ভিয়েতনামে, আফগানিস্তান, গুয়ান্তনামোর বন্দীরা, সম্প্রতি পাকিস্তানের ইমরান খান। পশ্চিমারা এক সময় উপনিবেশ স্থাপন করেছিল, লুণ্ঠন করেছিল। শ্বেতাঙ্গ ইউরোপীয়দের আফ্রিকা লুট করার কাহিনী কারো অজানা নয়।
ফিলিস্তিনিদের ওপর যুগ যুগ ধরে চলা ইসরায়েলি বর্বরতা ও পৈশাচিকতা, যেখানে মানবতা চরমভাবে ভূলুণ্ঠিত। এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও তার দোসরদের পাশবিকতার বিষয়টি কারো অজানা নয়। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ থামানোর বিষয়ে অগ্রগতির খবর কি? পশ্চিমাদের প্রচ্ছন্ন মদতে ইসরায়েল রাষ্ট্রটি চরমভাবে অগণতান্ত্রিক নিপীড়ন চালিয়ে যাচ্ছে। সিরিয়া বা ইয়েমেনে যুদ্ধ থাকার কথা নয়, এ যুদ্ধ কারা দীর্ঘস্থায়ী করছে? মিসরে নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করার জন্য তারা সেনা পরিচালিত সরকারকে সমর্থন দিয়েছিল। এমনকি অনেক আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান যখন দাবি জানিয়ে আসছে যে, প্যালেস্টাইনে গণহত্যার মতো মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেই যাচ্ছে, তখনো পশ্চিমাদের ইসরায়েলের প্রতি সমর্থন অব্যাহত থাকছে। পশ্চিমা দেশগুলো যদি এতই গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকত, তাহলে ইসরায়েলের প্রতি তাদের এই সমর্থন অব্যাহত থাকছে কীভাবে? সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে কারা যুক্ত তা কারো অজানা নয়।
যদি সত্যিই তারা গণতন্ত্র কিংবা মানবাধিকারের প্রশ্নে এত সচেতন হতেন, তা হলে আফগানিস্তানে টানা বিশ বছর এমন বেআইনি যুদ্ধ পরিস্থিতি থাকত না। সত্তর বছর ধরে ফিলিস্তিনে যে সমস্যা রয়েছে, তা থাকত না। এমনকি ইরাক ও লিবিয়ায় এমন সঙ্কটময় পরিস্থিতি বিরাজ করত না। পশ্চিমাদের কথা আর কাজ এক নয়। আফগানিস্তানে বা ইরাকে মার্কিন বাহিনী যে নিষ্ঠুর হত্যাকা- চালিয়েছে তার তো কোন তদন্ত হয়নি।
আমাদের দেশে রাজ সিংহাসনে থাকলে বিদেশি কূটনীতিকদের তৎপরতা নিয়ে একরকম এবং ক্ষমতার বাইরে থাকলে তাদেরই ভিন্ন মনোভাব প্রকাশ পায়। ক্ষমতায় থাকা দলের নেতারা কূটনীতিকদের খুব বেশি দৌড়াদৌড়ি পছন্দ করেন না। কিন্তু বিরোধী দলে থাকলে তারা বিদেশি কূটনীতিকদের হস্তক্ষেপে উৎসাহিত করেন। দেশের রাজনৈতিক নেতারাই কূটনীতিকদের তৎপরতা বাড়ানোর সুযোগ করে দেয়। বিদেশীরা অভ্যন্তরীন ব্যাপারে নাক গলাচ্ছে, কারণ ক্ষমতাসীনরা জনগণের বাকস্বাধীনতা, মানবাধিকার খর্ব করছে।
বিদেশি কূটনীতিকরা কীভাবে এবং কেন আন্তর্জাতিকভাবে নির্ধারিত শিষ্টাচার অনুসরণ না করে একটি স্বাধীন, সার্বভৌম দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলাচ্ছেন- এ নিয়ে ভাবার সময় এসেছে বলে মনে করছেন দেশের শান্তিপ্রিয় সর্বসাধারণ। কূটনীতিকদের অবশ্যই জানা উচিত তাদের আচরণ ১৯৬১ সালে প্রণীত ভিয়েনা কনভেনশন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। তারা কী করতে পারে এবং কী করতে পারে না তা স্পষ্টভাবে সেখানে বলা আছে। ঢাকায় অবস্থানরত কিছু দেশের কূটনীতিকরা এ দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিষয়ে সম্প্রতি যে ধরনের মন্তব্য করছেন তা আন্তর্জাতিক শিষ্টাচারের পরিপন্থি। কোনো বিদেশি শক্তির অযাচিত, অনভিপ্রেত শিষ্টাচারবহির্ভূত হস্তক্ষেপ দেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে কখনও সুসংহত করতে পারে না বরং সেটি দেশের অসম্মানের কারণ হয়ে দাঁড়াবে।
একটা দেশ যখনই উন্নতি, অগ্রগতিতে আসবে, গুরুত্বপূর্ণ হতে থাকবে, সে দেশের চ্যালেঞ্জও বাড়তে থাকবে। বাস্তবতার নিরিখে বাংলাদেশকে মোটামুটিভাবে সবার সঙ্গেই থাকতে হবে। বাংলাদেশ নিশ্চয়ই একলা চলে এগিয়ে যেতে পারবে না। এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, বাংলাদেশ কি পশ্চিমা মেরুকরণের পথ বেছে নেবে, না পূর্ব দিকে যাবে? নাকি চীনের দিকে? যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে গিয়ে আমাদের কোন লাভ আছে কীৃ? তাদের সাথে অতি মাখামাখিরও দরকার নেই। যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারি বাংলাদেশীরা এখন মূল্যবান বৈদেশিক মূদ্রার বড় যোগানদাতা। এমন দেশের সাথে রাজনৈতিক দূরত্ব তৈরি আখেরে দেশের ক্ষতি করবে। বাংলাদেশকে সময় ও পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে এক ধরনের ভারসাম্যমূলক অবস্থানে থেকে এগোতে হবে। বিশেষ কোনো একটি দিকে পুরোপুরি ঝুঁকে পড়ার সময় এখনো বাংলাদেশের জন্য আসেনি বলে আমরা মনে করছি। আমাদের রপ্তানির বড় গন্তব্য এবং প্রযুক্তির আমদানি পশ্চিমা দেশগুলো থেকে।
এ ক্ষেত্রে স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে রাজনীতিবিদদের প্রতিক্রিয়া প্রকাশের ক্ষেত্রে অধিকতর সতর্কতা অবলম্বন করার প্রয়োজন রয়েছে। এমন বহু বিষয় রয়েছে যেখানে এখনো আমরা নির্ভরশীল। সুতরাং পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের ভিত্তিতে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে সম্মানজনক সুরাহা একান্তভাবেই কাম্য।