দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বিদেশি কূটনীতিকদের নাক গলানো ভিয়েনা কনভেনশনের মধ্যে পড়ে না। সরকারের পক্ষ থেকে বারবার এ বিষয়ে উষ্মা প্রকাশ করা হলেও বিদেশি দূতদের কথা বলা থামছে না। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কথা বলায় যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপীয় ইউনিয়নের ১৩ দেশের রাষ্ট্রদূত ও মিশন প্রধানকে ডেকে সতর্ক করল সরকার। ঢাকা-১৭ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী আশরাফুল আলমকে কেন্দ্র করে একটি যৌথ বিবৃতির ঘটনায় দেশগুলোর রাষ্ট্রদূতদের ডেকে সরকারের অসন্তুষ্টির কথা জানানো হয়েছে। আসন্ন সংসদ নির্বাচন নিয়ে বিদেশি কূটনীতিকরা দিন দিন তৎপর হয়ে উঠছেন। নির্বাচন দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়। বিদেশি দূতদের আমাদের দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ দুঃখজনক।
বুধবার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপীয় ইউনিয়নের ১৩টি দেশের কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠক করে সরকারের অসন্তুষ্টির কথা জানিয়ে দেন। তিনি বলছেন, তাদের দেয়া যৌথ বিবৃতিটি খুব দ্রুততার সঙ্গে তৈরি করা হয়েছে। এতে সরকারের নেয়া পদক্ষেপের বিষয়টি উল্লেখ করা হয়নি। তাই এটির উদ্দেশ্য ও বস্তুনিষ্ঠতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। সভায় উপস্থিত কূটনীতিকদের জেনেভা কনভেনশন অনুসরণ করার এবং কূটনৈতিক শিষ্টাচারবহির্ভূত আচরণ থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানানো হয়। অনাকাক্সিক্ষত ঘটনাটি জানার সঙ্গে সঙ্গেই নির্বাচন কমিশন এবং সরকার দ্রুত আইনানুগ ব্যবস্থা নিয়েছে। গত ১৯ জুলাই কূটনীতিকদের বিবৃতি দেয়ার অনেক আগেই কিন্তু দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। ১৮ জুলাই তারিখে তা গণমাধ্যমেও প্রকাশ করা হয়েছে। অথচ আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়ার পরও এই কূটনীতিকরা আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছেন, যা অযাচিত। আমরাও সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ ভোটের পক্ষে। ইতোমধ্যে একটি নতুন স্বাধীন ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়েছে। সেই নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশনের প্রতি সবার আস্থা থাকা প্রয়োজন। আগ বাড়িয়ে বিদেশি দূতদের মন্তব্য করা, মাথা ঘামানোর সুযোগ নেই। বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিদেশি হস্তক্ষেপ পুরনো ঘটনা, বিশেষ করে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর থেকে এ দেশের রাজনীতিতে যখন সামরিক বাহিনীর অংশগ্রহণ শুরু করে তখন থেকেই বাংলাদেশ কী করবে, কীভাবে করবে- সব নির্দেশনাই আসতে থাকে বিদেশ থেকে। পাকিস্তান ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে তখন রাজনীতির জন্য অর্থের জোগান হলেও রাজনীতি নিয়ন্ত্রিত হতো মূলত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার গোয়েন্দা তৎপরতার ভিত্তিতে। এমন হস্তক্ষেপের চিত্র কিছুটা পরিবর্তন হলেও কমছে বলা যাবে না। দেখা যাচ্ছে, আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে নির্বাচনী ব্যবস্থাপনা, নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষতা নিয়ে বিদেশি রাষ্ট্রদূতরা মন্তব্য করে যাচ্ছেন। রাজনীতিক বিশ্লেষকরদের মতে, এমন অবস্থার জন্য আমরা দায়ী। বিদেশিদের কথা বলার সুযোগ আমরা করে দিচ্ছি। এ দেশের রাজনীতিবিদরা যখনই সরকারের বাইরে থাকেন তখনই ‘নালিশ’ নিয়ে গিয়ে হাজির হন বিদেশিদের কাছে। এটা এখানকার রাজনৈতিক বাস্তবতা। রাষ্ট্রদূতদের দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ শিষ্টাচারবহির্ভূত একটি কাজ। তবে শিষ্টাচারবহির্ভূত কার্যক্রম পরিচালনার জন্য কূটনীতিকরা যেমন একদিকে দায়ী, ঠিক তেমনি বাংলাদেশের বিবদমান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সহাবস্থান না থাকাও সমানভাবে দায়ী। বাংলাদেশ এখন অনেক এগিয়েছে, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে অনেক অগ্রগতি হয়েছে। তাই আমাদের নিজেদের নিজে সম্মান দেয়া দরকার। সমস্যা থাকবেই এবং তা নিজেদের মধ্যেই আলোচনা, প্রতিবাদের মাধ্যমে সমাধান করে নিতে হবে। দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বদনাম করা বা নালিশ করার রাজনৈতিক পদ্ধতি থেকে সব রাজনৈতিক দল ও গোষ্ঠীগুলোর বেরিয়ে আসা দরকার। যাতে বিদেশিরা আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে হস্তক্ষেপ করতে না পারে।
বাংলাদেশস্থ কতিপয় বিদেশি কূটনৈতিক মিশন বারংবার আলোচনার খোরাক জোগাইতেছে। তাহারা রাজনৈতিক বিষয়ে বিস্তর বক্তৃতা-বিবৃতি দিতেছে। বন্ধুপ্রতিম দেশগুলির সহিত বাংলাদেশের সরকার তথা পররাষ্ট্র দপ্তরের নিবিড় যোগাযোগ রহিয়াছে। উন্নয়ন ও বাণিজ্যিক সহযোগীদের বিভিন্ন বিষয় জানিবার কিংবা জানাইবার দরকার থাকিতেই পারে। সেই সকল বার্তা দিবার উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ হইল পররাষ্ট্র দপ্তর। এমন নহে, বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী বন্ধুবৎসল নহেন। কিন্তু সামান্য-অসামান্য সকল বিষয়ে যদি রাষ্ট্রদূতগণ গণমাধ্যম কিংবা জনপরিসরে সমালোচনামুখর হইয়া ওঠেন, তাহা হইলে আর কূটনৈতিক মাধ্যমের কী প্রয়োজন?
গত বৎসরের নভেম্বর মাসে ঢাকায় নিযুক্ত জাপানের রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকি ২০১৮ সালের নির্বাচনে ভোটদানের প্রক্রিয়া লইয়া মন্তব্য করিয়া জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণ এবং সরকার ও সংশ্লিষ্ট মহলের সমালোচনা কুড়ান। এই বৎসর দেখা যাইতেছে, কিছু কূটনৈতিক মিশন সেই ঘটনা হইতে কোনো শিক্ষাই লইতে পারে নাই।
এই ঘটনা আমাদের একটি স্বাধীন-সার্বভৌম দেশে বিদেশি কূটনৈতিক কার্যকলাপের সীমার কথা স্মরণ করাইয়া দেয়। কূটনীতিকগণের বক্তব্য বিষয়ে আলোচনার মূল সুর হইল শিষ্টাচার। বিদেশি হইয়া স্থানীয় দেশকে নসিহত কিংবা ভর্ৎসনা করা যাইতে পারে না। এই ব্যাপারে আমরা তাহাদের ১৯৬১ সালের ভিয়েনা কনভেনশনের নীতিমালার কথা স্মরণ করাইয়া দিতে পারি। ঐ কনভেনশনে রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে কূটনীতির নীতিমালা বিষয়ে চুক্তি হয়। চুক্তির ৪১ নম্বর ধারায় বলা হইয়াছে, যেই সকল ব্যক্তি অপর কোনো দেশে কূটনীতিকের মর্যাদা ও সুবিধা ভোগ করেন, তাহারা ঐ দেশের আইন ও নীতি মানিয়া চলিতে বাধ্য থাকিবেন। ইহার পরেই বলা হইয়াছে, জরুরি নির্দেশনা যে– তাহারা ঐ দেশের অভ্যন্তরীণ কোনো বিষয়ে হস্তক্ষেপ করিতে পারিবেন না। এই যদি হয় কূটনীতির সীমা, তাহা হইলে উক্ত ১৩টি দেশের কূটনীতিক ইতোমধ্যে তাহা অতিক্রম করিয়া ফেলিয়াছেন।
বাংলাদেশ নমনীয় পররাষ্ট্রনীতির দেশ বিধায় এখনও কোনোরূপ অপ্রীতিকর আচরণ করে নাই। পারস্পরিক আস্থা বিবেচনায় কূটনীতিকরা যেন এই সদাচরণের প্রত্যুত্তর সদাচরণ দিয়াই করেন।
যুক্তরাষ্ট্রসহ যেই সকল বিদেশি কর্মকর্তা বাংলাদেশ সফর করিয়াছেন, করিতেছেন এবং করিবেন, তাহারা যাহা বলিবার তাহা সরকারের নিকটই বলিয়াছেন। বক্তৃতা বা বিবৃতি দিয়া সরকারকে বা নিজেদের বিব্রতকর অবস্থায় লইয়া যান নাই।
আলোচিত কূটনীতিকদের প্রতি আহ্বান থাকিবে, তাহারা যেন ভিয়েনা কনভেনশনের চৌহদ্দিটা স্মরণে রাখেন।
জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনী কর্মসূচি পালনে তৎপরতা বাড়ছে। দলগুলো জনসম্পৃক্ততা বাড়াতে পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি দিয়ে যাচ্ছে। একই সঙ্গে নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে, ততই যেন বাড়ছে বিদেশি কূটনীতিকদের তৎপরতাও। তারা নির্বাচন নিয়ে নানা ধরনের মন্তব্য করছেন। শুধু নির্বাচনই নয়, বাংলাদেশে যেকোনো রাজনৈতিক সংকট এলেই তৎপর হতে দেখা যায় বিদেশি কূটনীতিকদের।
কূটনীতিকদের নানা মন্তব্যকে সরকারি দল বিভিন্ন সময় পাত্তা না দিলেও বরাবরই তাদের মন্তব্যকে ‘গুরুত্ব’ দিয়ে সমর্থন করে থাকে বিরোধী দলগুলো। এমন অবস্থায় সরকারের পক্ষ থেকে ভিয়েনা কনভেনশনের যে ধারার কথা বলা হয়, সেটি হচ্ছে চুক্তির ৪১ নম্বর ধারা। এ ধারার ১ নম্বর উপধারায় বলা হয়েছে- ‘যেসব ব্যক্তি অন্য কোনো দেশে কূটনীতিকের মর্যাদা ও সুবিধা ভোগ করেন তারা ওই দেশের আইন ও নীতি মেনে চলতে বাধ্য থাকবেন। এ ছাড়া তারা ওই দেশের অভ্যন্তরীণ কোনো বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে পারবেন না।’ তা সত্ত্বেও কূটনীতিকদের দেখা যায় দেশের বিভিন্ন ইস্যুতে তৎপরতা দেখাতে, যা কার্যত ভিয়েনা কনভেনশনের লঙ্ঘন। সর্বশেষ, গত ১৭ জুলাই ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচনের ভোটগ্রহণ চলাকালে রাজধানীর বনানীর একটি কেন্দ্রে গিয়ে হামলার শিকার হন স্বতন্ত্র প্রার্থী আশরাফুল আলম ওরফে হিরো আলম। বিবৃতিতে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিরো আলমের ওপর হামলার পূর্ণ তদন্ত ও দোষীদের জবাবদিহির আহ্বান জানানো হয়েছিল। যৌথ বিবৃতিতে স্বাক্ষর করে কানাডা, ডেনমার্ক, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, নেদারল্যান্ডস, নরওয়ে, স্পেন, সুইডেন, সুইজারল্যান্ড, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) দূতাবাস ও হাইকমিশন।
বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ইস্যুতে কথা বলায় ওই ১৩ দেশের রাষ্ট্রদূত ও মিশনপ্রধানদের ডেকে সতর্ক করেছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। বুধবার (২৬ জুলাই) ফরেন সার্ভিস অ্যাকাডেমিতে রাষ্ট্রদূতদের ব্রিফ করার জন্য ডাকা হয়। পরে এ বিষয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম। তিনি বলেন, ‘গত ১৭ জুলাই ঢাকা-১৭ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী আশরাফুল হোসেন ওরফে হিরো আলমকে কেন্দ্র করে একটি অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে কূটনৈতিক রীতিনীতি ভঙ্গ করে ঢাকার যেসব দূতাবাস গণমাধ্যমে একটি যৌথবিবৃতি দিয়েছিল, বুধবার তাদের ডেকেছিলাম। তাদের কূটনৈতিক শিষ্টাচারবহির্ভূত আচরণে আমরা আমাদের অসন্তোষ প্রকাশ করেছি। আমরা বলেছি, এটি একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা, যা দিয়ে সারা দিনের শান্তিপূর্ণ, সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনকে মূল্যায়ন করা ঠিক হবে না।’
যেকোনো নির্বাচন কেন্দ্র করেই ছোটখাটো দু-একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটতে পারে, ঘটেও থাকে সেটা। এমনকি উন্নয়নশীল দেশেও সেটা ঘটতে দেখা যায়। সেসবের জন্য পুরো নির্বাচনব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায় না। এই তো মাত্র কয়েক দিন আগে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের পৌরসভা নির্বাচনের সময় ব্যাপক সহিংসতা হয়েছে। সেখানে বহু হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। সেসব ঘটনা নিয়ে কাউকে বিবৃতি দিতে দেখা যায়নি। আমরা মনে করি, বাংলাদেশ তার অভ্যন্তরীণ যেকোনো বিষয়ে নিজেরাই যেকোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা রাখে। এখানে বিদেশি কারো হস্তক্ষেপের প্রয়োজন আছে বলেও আমরা মনে করি না। আমরা চাইব, ভবিষ্যতে আর এমন আনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির তৈরি হবে না। তেমনটি না হওয়া সবার জন্যই মঙ্গলজনক।
লেখক: নন্দিতা রায়; মানবাধিকারকর্মী, অস্ট্রেলিয়াপ্রবাসী।