পৃথিবীতে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার প্রজাতির মশা রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম ভয়ঙ্কর একটি প্রজাতি হচ্ছে, এডিস ইজিপ্টি মশা। এই মশার কামড়েই মানুষ ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে থাকে। ডেঙ্গু ভাইরাস প্রধানত এডিস ইজিপ্টি প্রজাতির স্ত্রী মশার মাধ্যমে সংক্রামিত হয় এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে অল্প মাত্রায় এডিস অ্যালবোপিকটাস-এর মাধ্যমেও ছড়াতে পারে।
এডিস ইজিপ্টি মশা ডেঙ্গুর পাশাপাশি চিকুনগুনিয়া, ইয়েলো ফিভার এবং জিকা ভাইরাসেরও বাহক।
ডেঙ্গু ভাইরাস হলো ফ্ল্যাভিভাইরাস গণের অন্তর্ভুক্ত একটি এক সূত্রক আরএনএ ভাইরাস। এই ভাইরাসের প্রাথমিক ধারক এডিস মশা, দ্বিতীয় ধারক মানুষ এবং অন্যান্য কিছু প্রাইমেটস।
এডিস ইজিপ্টি প্রজাতির স্ত্রী মশা ডেঙ্গু আক্রান্ত কোনো ব্যক্তির রক্তপান করলে, ভাইরাস ওই মশার শরীরে প্রবেশ করে। এরপর প্রায় ৮-১০ দিন পর ভাইরাসটি মশার দেহের অন্যান্য কোষে ছড়িয়ে পড়ে। বিশেষ করে মশার লালাগ্রন্থি থেকে এর লালায় চলে আসে। তবে এই ভাইরাস মশার উপর কোনো ক্ষতিকারক প্রভাব ফেলে না। এই ভাইরাস বহনকারী মশা সুস্থ মানুষকে আক্রমণ করে, মশার লালার সূত্রে ডেঙ্গু ভাইরাস মানুষের শরীরে ছড়িয়ে পড়ে।
এডিস ইজিপ্টি মশা কেন ডেঙ্গু ভাইরাস প্রতিরোধ করতে পারে না?
অন্যান্য পোকামাকড়ের মতো মশার শরীরেও আরএনএ ইন্টারফেসের মেকানিজমের ওপর ভিত্তি করে অ্যান্টিভাইরাল বা ভাইরাস প্রতিরোধী সুরক্ষাব্যবস্থা রয়েছে। ছোট এই আরএনএ অণুগুলো ভাইরাসের জিনগত উপাদানকে বিশেষভাবে কাবু করতে পারে, যার ফলে জীবের মধ্যে এর সংখ্যাবৃদ্ধি ও বিস্তারকে বাঁধা দেয়। কিন্তু এই সিস্টেম এডিস মশার মধ্যে ডেঙ্গু ভাইরাস প্রতিরোধে কেন অক্ষম, তা উঠে এসেছে এক গবেষণায়।
২০১৮ সালে ফ্রান্সের জাতীয় বৈজ্ঞানিক গবেষণা কেন্দ্র এবং ব্রাজিলের ফেডারেল ইউনিভার্সিটি অব মিনাস গেরাইসের একদল গবেষক এডিস মশার মধ্যে এলওকিউএস২ নামক একটি জিনের অস্তিত্ব আবিষ্কার করেছেন, যা আরএনএ প্রতিবন্ধকতায় সঠিক কার্যকারিতার জন্য অপরিহার্য। কিন্তু এটি এডিস মশার অন্ত্রে কাজ করে না! মশার পেটে এটি নিষ্ক্রিয় থাকায়, রক্ত পানের মাধ্যমে যে ডেঙ্গু ভাইরাস মশার পেটে যায় তা বহুগুণ বেড়ে যায় এবং একসময় মশার লালা গ্রন্থিকে সংক্রামিত করে। পরবর্তীতে রক্তপান করার সময় ডেঙ্গু ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়ে।
আশ্চর্যজনক বিষয় হচ্ছে, এ জাতীয় অন্যান্য মশার জিনোমে গবেষকরা এলওকিউএস২ জিনের উপস্থিতি পাননি। গবেষকদের মতে, এলওকিউএস২ জিনটি এডিস মশার এই স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য বোঝার জন্য একটি চাবিকাঠি হতে পারে।
ডেঙ্গুতে মানুষ কেন বেশি সংক্রমিত হয়?
মানুষ ছাড়াও অন্য প্রাইমেটিদেরদের মধ্যেও ডেঙ্গু সংক্রামিত হয়। কিন্তু মানুষের মধ্যে ডেঙ্গু বেশি ছড়ানোর কারণ হচ্ছে, এডিস এজিপ্ট মশা মানুষের সবচেয়ে কাছে থাকতে এবং অন্যান্য মেরুদন্ডীদের চেয়ে মানুষের রক্ত খেতে বেশি পছন্দ করে, এমনটাই উঠে এসেছে সিডিসির এক প্রতিবেদনে।
ডেঙ্গুতে একবার আক্রান্ত হলে ভাইরাসটি থেকে আজীবন সুরক্ষিত থাকা যায়?
ডেঙ্গু ভাইরাসের চারটি ভাগ রয়েছে। এদেরকে বলা হয় সেরোটাইপ। এগুলোর নাম হলো- DENV-1, DENV-2, DENV-3 এবং DENV-4। যখন কেউ এই ৪টি সেরোটাইপের মধ্যে কোনো একটি সোরোটাইপে সংক্রমিত হয়, তখন সেটির বিরুদ্ধে শরীরে আজীবনের জন্য প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয়। কিন্তু বাকি সেরোটাইপগুলোর ক্ষেত্রে শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা স্বপ্লমেয়াদি হয়ে থাকে।
এ প্রসঙ্গে ন্যাচার ডটকমের প্রতিবেদন বলা হয়েছে, প্রথম ডেঙ্গু সংক্রমণের পর দুই থেকে তিন মাস বাকি তিনটি সেরোটাইপের সংক্রমণ থেকে ব্যক্তিরা সুরক্ষিত থাকে। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে, এটি দীর্ঘমেয়াদি সুরক্ষা নয়। এই স্বল্প সময়ের পরে, একজন ব্যক্তি বাকি তিনটি ডেঙ্গুর সেরোটাইপের যে কোনো একটিতে আক্রান্ত হতে পারেন। চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের মতে, পরবর্তী সংক্রমণ ডেঙ্গু রোগের ক্ষেত্রে বেশি ঝুঁকিতে ফেলতে পারে। অর্থাৎ যাদের একবার ডেঙ্গু হয়ে গেছে, তাদের পুনরায় এই ভাইরাস আক্রমণ করলে, তা ভয়ঙ্কর হয়ে দেখা দেয়।
তথ্যসূত্র: সিএনআরএস, ন্যাচার