লঙ্কাকান্ড থেকে মূল্যস্ফীতির ব্যবচ্ছেদ

:: ড. আশরাফুল আলম চৌধুরী ::
প্রকাশ: ১ বছর আগে

বছর ঘুরে আসে বাংলাদেশের মুসলমানদের সর্ববৃহৎ উৎসব ঈদ। ঈদ এলেই বাজারে স্বাভাবিক নিয়মে বাড়ে নিত্য-প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির দাম। ঈদ যেতে না যেতেই দাম কিছুটা সমন্বয় করা হয়। তবে এবারের ঈদে কাঁচা মরিচের দাম বেশ চড়া। মাত্র ৩ দিনের মধ্যে প্রতি কেজি কাঁচা মরিচের দাম বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১,০০০ টাকায়, যা স্বাভাবিকের চেয়ে ১০ গুণ বেশি। অর্থাৎ কাঁচামরিচের মুল্যস্ফীতি হয়েছে ১০০০%। এটি কেবল উদ্বেগজনক বা অস্বাভাবিক নয়, বিশ্লেষণ করার জন্য একটি খুব আকর্ষণীয় তথ্যও। ভোগ্যপণ্যের বাজারে এই অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি কোনো নজিরবিহীন ঘটনা নয়। বাংলাদেশে পেঁয়াজ ও লবণের এমন অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির ঘটনা খুব বেশি পুরনো নয়। সুতরাং, মূল্যস্ফীতি এ ঘটনার জন্য কতটা দায়ী তা বিশ্লেষণ করা সময়ের দাবি।

মূল্যস্ফীতি হল সময়ের সাথে সাথে মূল্য বৃদ্ধি যার ফলে মুদ্রার ক্রয় ক্ষমতা হ্রাস পায়। নিঃসন্দেহে, সমগ্র বিশ্বই এখন মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে অত্যন্ত সংকটময় সময় পার করছে। এক বছর ধরে বাংলাদেশ ক্রমাগত লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। গত মাসে, দেশে ৯.৯৪% রেকর্ড মূল্যস্ফীতি হয়েছে, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অনেক বেশি ছিল। যদিও বাংলাদেশের এই পরিস্থিতির জন্য বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতিকে দায়ী করা হয়েছে, তবুও এর পেছনে যে বেশকিছু অভ্যন্তরীণ কারণও রয়েছে তা অস্বীকার করার উপায় নেই।

মূল্যস্ফীতি সাধারণত উন্নয়নশীল দেশগুলিতে দৃশ্যমান হয় মূলত তাদের অর্থনীতির দুর্বল কাঠামোর কারণে। তাছাড়া, চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যকার ভারসাম্যহীনতার কারণে মূল্যস্ফীতি দেখা দেয়। এই মূল্যস্ফীতিকে ‘বটলনেক ইনফ্লেশন’ বলা হয়।

বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংক মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য কাজ করে। সম্প্রতি ঘোষিত সংকোচনমূলক মুদ্রানীতিতে বাংলাদেশ ব্যাংক তার প্রধান লক্ষ্য হিসেবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে চিহ্নিত করেছে এবং এটাও স্বীকার করেছে যে এই লক্ষ্য অর্জন চ্যালেঞ্জিং। এটি ঋণ গ্রহণকে নিরুৎসাহিত করার জন্য পলিসি রেট এবং সুদের হার বৃদ্ধি করেছে, কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য কৃষি খাতে প্রণোদনা প্রদান করেছে এবং একক বৈদেশিক মুদ্রার হারের দিকে যাচ্ছে। এটা সত্য যে এই উদ্যোগগুলি বাজার নিয়ন্ত্রণে কতটুকু ভূমিকা রাখতে পারবে তা অস্পষ্ট।

মূলত বাংলাদেশ এই পরিবর্তিত নীতির মাধ্যমে শুধুমাত্র কাঠামোগত মূল্যস্ফীতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। বাংলাদেশ ব্যাংক ইতোমধ্যে মূল্যস্ফীতি ২০ বেসিস পয়েন্ট নামিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু বর্তমানে নিত্য-প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির যে মূল্যস্ফীতি তা বাজার নিয়ন্ত্রণের সাথে জড়িত। ফলে বাজারে চলমান মূল্যস্ফীতির কারণ হতে পারে বটলনেক অথবা সাইকোলজিক্যাল।

মূল্যস্ফীতির জন্য বটলনেক ইনফ্লেশন দায়ী হলে কাঁচামরিচের সরবরাহে ঘাটতি থাকতো। কিন্তু স্থানীয় বাজার পরিদর্শন শেষে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর জানায়, সারাদেশে মরিচের সরবরাহ স্বাভাবিক রয়েছে। যদি কাঠামোগত মূল্যস্ফীতি এবং সরবরাহে উল্লেখযোগ্য ঘাটতি না থাকে তাহলে মরিচের দাম ১০ গুণ বেড়ে গেল কেন? উত্তর হল ‘সাইকোলজিক্যাল ইনফ্লেশন’।

বাজার সংশ্লিষ্টদের সাইকোলজি বা আচরণ বাজারে দামের ওঠানামায় বড় ভূমিকা পালন করে। যখন সবাই ধরে নেয়, অদূর ভবিষ্যতে একটি নির্দিষ্ট পণ্যের দাম বাড়তে পারে, তারা তাদের প্রয়োজনের চেয়ে বেশি ক্রয় শুরু করে এবং মজুদ করতে থাকে। এতে চাহিদারেখা হঠাৎ করে উপরে উঠে যায় এবং দাম বৃদ্ধি পায়। আবার যখন তারা ধরে নেয় দাম শীঘ্রই কমতে পারে, তখন তারা কেনা কমিয়ে দেয়। এতে পণ্যের দাম প্রকৃতপক্ষেই কমে যায়। একইভাবে, বাজার সংশ্লিষ্টদের একটি বড় অংশ যখন মূল্যস্ফীতিকে ন্যায্য মনে করে দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয় তখন তাদের সিদ্ধান্ত থেকেও ‘সাইকোলজিক্যাল ইনফ্লেশন’-এর উৎপত্তি হয়।

অতীতে, সিন্ডিকেটগুলি পণ্য মজুদের মাধ্যমে বাজারে সরবরাহের কৃত্রিম ঘাটতি তৈরি করতো। এই কৃত্রিম ঘাটতিকে কাজে লাগিয়ে পরবর্তীতে বাজারে উচ্চমূল্যে তাদের পণ্য বিক্রি করে পকেট ভারি করতো। কিন্তু এখন শুধু সাইকোলজি ও লাভের অসৎ প্ররোচনাকে কাজে লাগিয়ে বাজারে খুব সহজেই দামের হেরফের করা সম্ভব হচ্ছে।

মরিচ-এর মত কোনো নির্দিষ্ট পণ্যের এই ধরনের আকস্মিক মূল্যবৃদ্ধির জন্য মুলত ব্যবসায়ীদের সাইকোলজি দায়ী। ১০% মূল্যস্ফীতিকে দায়বদ্ধ করে, তারা কোনো দ্বিধা ছাড়াই স্বাভাবিক মূল্যের ৩-৪ গুণ মূল্য বৃদ্ধি করে। তারা তাদের ধারনা ১০০ টাকা বিনিয়োগ করে ৯০০ টাকা লাভ করতে পারাই ব্যবসা। আর ব্যবসায়ীদের এই সাইকোলজি শুধু যে দেশীয় মূল্যস্ফীতির জন্য দায়ী , তাই নয়। এই সাইকোলজির কারনেই বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতি কমলেও, আমদানিকৃত পন্যের বাজারে তার প্রভাব কমে না। এর সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক উদাহরণ হল জ্বালানির বাজার। বিশ্বব্যাপী তেল, গ্যাস বা অন্যান্য জ্বালানির দাম বাড়লে বাংলাদেশে সেই পন্যের দাম বৃদ্ধি করা হয়। কিন্তু বিশ্বব্যাপী যখন জ্বালানির দাম আবার হ্রাস পায়, বাংলাদেশে সেই হ্রাসের কোনো প্রভাব পড়েনা, পড়লেও তা আনুপাতিক হারে খুবই কম। তবে, বর্তমানে এলএনজি ও অন্যান্য জ্বালানির দাম নিয়ন্ত্রনে কতৃপক্ষকে বেশ স্বতস্ফূর্ত কাজ করতে দেখা যাচ্ছে।

মুল্যস্ফীতিকে হাতিয়ার বানিয়ে, লাভবান হওয়ার এই সাইকোলজি শুধু ব্যবসায়ী বা সিন্ডিকেটদের জন্যই প্রযোজ্য , এমন নয়। সেবা প্রদানকারীরাও এই সাইকোলজি অনুসরণ করছেন। একজন সাধারণ রিকশাচালকের আচরণ বিশ্লেষণ করলে বিষয়টি উপলব্ধি করা যায়।, উদাহরণস্বরূপ, একটি নির্দিষ্ট দূরত্বের জন্য যদি রিকশাচালক আগে ২০ টাকা চার্জ করে থাকে, তবে এখন তিনি ৩০ বা ৪০ টাকা ভাড়া দাবি করছেন। সুতরাং, তার সাইকোলজিতে মূল্যস্ফীতির হার ৫০% থেকে ১০০%। যখন একজন ব্যবসায়ী সেই রিকশায় চড়েন, তখন তিনি উপলব্ধি করেন অর্থনীতির আয়ের স্তর বেড়েছে যা তাকে তার পণ্যের দাম আরও বাড়ানোর সুযোগ দেয়। এভাবেই, পাল্লা দিয়ে বাজারে মূল্যস্ফীতি লাগামহীনভাবে বাড়তে থাকে।

যদি কোনো সুনির্দিষ্ট কারনে, মরিচের দাম বৃদ্ধি পেয়ে থাকত, তাহলে ভারত থেকে বৃহৎ পরিসরে পণ্য আমদানির ঘোষণায় দাম আচমকা কমে যেত না। অবশ্য, দাম নিয়ন্ত্রনে কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে খুব দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। গত ২৫ জুন, সরকার বেশ কিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে মরিচ আমদানির জন্য অনুমোদন দিয়েছে। ৫ জুলাই, জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর ৪১ জেলায় অভিযান পরিচালনা করে । অভিযান পরিচালনা শেষে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর মূল্য তালিকা প্রদর্শন না করা এবং গ্রাহকদের অতিরিক্ত চার্জ নেওয়ার জন্য প্রায় ৬.২১ লাখ টাকা জরিমানা করে। এর আগের দিন ১৪৮ ব্যবসায়ীকে প্রায় ৩ লাখ ৩৯ হাজার টাকা জরিমানা করে অধিদপ্তর।

এসব পদক্ষেপ সাময়িকভাবে সফল হলেও, কোনো স্থায়ী সমাধান দিতে পারছে না। তার একটি কারণ হতে পারে, ভোক্তা  অধিদপ্তরের নিয়মিত ও কঠোর নজরদারির অভাব। মুল্যস্ফীতির একদম সূচনালগ্নেই যদি অসৎ এই দাম বৃদ্ধির প্রতিযোগিতাকে দমন করা যেত, তবে সাধারন জনগণ অস্বস্তির স্বীকার হতনা। অন্য কারনটি হতে পারে, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের বিচক্ষণতার অভাব। বছরের কোন মৌসুমে, কোন পন্যের ঘাটতি হতে পারে, বৃষ্টির সময় যেসব পন্যের দাম বেড়ে যায়, সে সকল পন্য উঁচু কোনো অঞ্চল থেকে এনে সরবরাহ ঠিক রেখে দাম নিয়ন্ত্রন কিভাবে করা যায়, ইত্যাদি বিষয় নিয়ে কাজ করা আবশ্যকীয়।  তবে, চাহিদা-যোগানে পর্যাপ্ত ভারসাম্য থাকার পরও অস্বাভাবিক এবং অযৌক্তিক এই ‘সাইকোলজিক্যাল ইনফ্লেশন’ এর একটি উপযুক্ত সমাধান খুঁজে বের করার জন্য অত্যন্ত সমালোচনামূলক দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টি বিশ্লেষন করা প্রয়োজন।

 

লেখক: ড. আশরাফুল আলম চৌধুরী; গবেষক ও কলামিস্ট। পিএইচডি, ইমোরি ইউনিভার্সিটি, জর্জিয়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এমএসএস (ইকোনমিক্স), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।