জাতিসংঘের ম্যান্ডেটের অধীনে ২০১৩ সালে মালিতে শান্তিরক্ষা মিশনের কার্যক্রম শুরু হয়। সে বছরেই বিচ্ছিন্নতাবাদী বিদ্রোহীরা ও জঙ্গিবাদী গোষ্ঠীগুলো একত্র হয়ে একটি আলাদা দেশ গঠন করার জন্য মালির উত্তরাঞ্চলের প্রায় সাড়ে ১২ লাখ বর্গকিলোমিটার আয়তনবিশিষ্ট এলাকায় তাদের নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্ঠা করে। মালি অনেক বছর ধরে বিচ্ছিন্নতাবাদী ও জঙ্গিদের হুমকির শিকার এবং তাদের হত্যা ও নির্যাতনের কারণে লাখো মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়। ক্রমবর্ধমান জিহাদীদের উত্থানের কারনে সেসময় চলমান বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিতে দেশটিতে শান্তি ও স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে জাতিসংঘ এই শান্তিরক্ষা মিশন শুরু করে।মালি একসময় ফরাসী উপনিবেশ ছিল এবং সেদেশের বিভিন্ন গোষ্ঠীর অভ্যুত্থান নিয়ন্ত্রণে ফ্রান্সও মালিতে পাঁচ হাজার সৈন্য পাঠিয়েছিল। শান্তিরক্ষী ও ফরাসি সেনাদের উপস্থিতি সত্ত্বেও মালিতে সন্ত্রাসী হামলার সংখ্যা বাড়তে থাকে, পাশাপাশি জঙ্গি গোষ্ঠীগুলো নিজেদের পক্ষে দেশটির নাগরিকদের সমর্থন বাড়াতে তাদের তৎপরতা চালিয়ে যায়। শান্তিরক্ষা মিশন চলাকালীন মালিতে জঙ্গিদের হামলায় তিন শতাধিক শান্তিরক্ষী প্রাণ হারায় যার কারনে এই মিশন সবচেয়ে বেশি শান্তিরক্ষী প্রাণঘাতী মিশন হিসেবে পরিচিতি পায়।
মালিতে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী এবং পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা মিশনের শুরু থেকেই শান্তিরক্ষার দায়িত্ব পালন করে আসছে। মালিতে সৈন্য পাঠানোর শীর্ষ পাঁচটি দেশ হলো চাদ, বাংলাদেশ, মিশর, সেনেগাল ও নাইজার।পুলিশ পাঠানোর শীর্ষ রয়েছে সেনেগাল, টোগো, বাংলাদেশ, বুরকিনা ফ্রাসো ও মিশর। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, মালি শান্তিরক্ষা মিশনে বেসামরিক কর্মী ও শান্তিরক্ষীসহ সব মিলিয়ে ১৬ হাজার ৭৯ জন মোতায়েন আছে। বর্তমানে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও পুলিশ বাহিনীর প্রায় ১৭০০ শান্তিরক্ষী মালি মিশনে দায়িত্বে নিয়োজিত রয়েছে।
বেশ কয়েক বছর ধরে শান্তিরক্ষা মিশন নিয়ে জাতিসংঘের সাথে মালির সামরিক সরকারের টানাপোড়েন চলছিল। ২০২০ সালে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সামরিক জান্তার ক্ষমতা গ্রহণের পরে শান্তিরক্ষা মিশন ও ক্ষমতাসীনদের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটে। মালির জান্তা সরকার জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা বাহিনী এক দশক ধরে মিশন পরিচালনা করেও দেশটিতে চলমান জঙ্গি সহিংসতার বন্ধে ব্যর্থ হয়েছে বলে অভিযোগ করে। ২০২১ সালে মালি রাশিয়ার ভাড়াটে সেনাদল ওয়াগনারের সঙ্গে মিত্রতা করার পর থেকেই জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশন কার্যক্রম চাপের মুখে পড়ে। একই সাথে ফ্রান্সের সঙ্গেও মালির প্রতিরক্ষা বিষয়ক পারস্পারিক সহযোগিতার অবনতি ঘটে। ফলশ্রুতিতে ফ্রান্স মালি থেকে তাদের সৈন্য প্রত্যাহার করে নেয়। ২০২২ সালের আগস্টে মালির কর্তৃপক্ষ মিশনের মুখপাত্র অলিভিয়ার সালগাদোকে বহিষ্কার করে এবং মিশনের গ্রুপ রোটেশন সাময়িকভাবে স্থগিত করার আদেশ দেয়।
মালিতে শান্তিরক্ষীদের অবস্থানের মেয়াদ ২০২৩ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত ছিল। তবে পরিস্থিতি বিবেচনায় জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস আরও এক বছরের জন্য মিশনের মেয়াদ বাড়িয়ে শান্তিরক্ষীদের সেখানে অবস্থানের জন্য সুপারিশ করেছিল। মালির সরকার জানায় যে, জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশন মালির সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে গুরুতর সব অভিযোগ করেছে যা শান্তি, ঐক্য ও দেশের পুনর্গঠনের জন্য বাধা। জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনী অভিযোগ করে, মালি সরকার তাদের অভিযানে প্রায়ই হস্তক্ষেপ করে।এসব অভিযোগ ও পাল্টা অভিযোগের প্রেক্ষাপটে মালিতে নিরাপত্তার চ্যালেঞ্জ কার্যকরভাবে মোকাবিলায় জাতিসংঘের বাহিনী ব্যর্থ হয়েছে জানিয়ে গত জুনে মালির অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাতিসংঘ শান্তিরক্ষীদের মালি ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্য জানায়। জাতিসংঘ মহাসচিব এবং নিরাপত্তা পরিষদের সভাপতির দায়িত্বে থাকা সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রতিনিধি, স্বাগতিক দেশের সম্মতি ছাড়া শান্তিরক্ষীদের নিরাপত্তা ও শান্তিরক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা অসম্ভব বলে তাদের মত ব্যক্ত করেন। ৩০ জুন জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে মালিতে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনের ম্যান্ডেট বাতিল ও মালি মিশন থেকে সব শান্তিরক্ষী প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় ও সর্বসম্মতভাবে এ বিষয়ে রেজ্যুলেশন পাস হয়। মালিতে এক দশক ধরে চালানো শান্তিরক্ষা মিশন শেষ করতে সর্বসম্মতিক্রমে ভোট দেয় জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ। এ প্রেক্ষিতে, আগামী ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে জাতিসংঘ মালিতে নিযুক্ত শান্তিরক্ষীদেরকে প্রত্যাহারের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়। গৃহীত রেজ্যুলেশন অনুযায়ী মালি মিশনে দায়িত্বরত সব শান্তিরক্ষীদের প্রত্যাহার করা হবে।বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয় মালি সরকারের অসম্মতির কারনে মালিতে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশন বন্ধ হচ্ছে বলে জানায়।
জাতিসংঘের যে কোন মিশন শেষ হওয়া একটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। স্বাগতিক দেশ ও জাতিসংঘের মধ্যে সমঝোতার মাধ্যমে মিশন তাদের কাজ চালিয়ে যায়। শান্তিরক্ষা বাহিনী যে দেশে কাজ করে, সেই দেশের সরকারের সম্মতি ও অনুমোদন নেওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে জাতিসংঘের নীতিমালায়। অর্থ সহায়তা বন্ধ, নিরাপত্তা পরিস্থিতি্র অবনতি, যুদ্ধবস্থা, স্বাগতিক দেশ ও বিদ্রোহী গুষ্টিগুলোর সাথে সমঝোতা ইত্যাদি নানা কারনে শান্তিরক্ষা মিশন শেষ হতে পারে। এ পর্যন্ত চলা বহু শান্তিরক্ষী মিশন সফল ভাবে শেষ হয়েছে এবং বেশ কিছু মিশন জরুরী অবস্থার প্রেক্ষিতে তাদের কার্যক্রম বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছে। কম্বোডিয়া, সিয়েরা লিওন, নামিবিয়া, মোজাম্বিক, আইভরিকোস্ট ও অন্যান্য অনেক মিশন সেদেশগুলোতে শান্তি প্রতিষ্ঠায় অবদান রেখেছে। রুয়ান্ডার মিশন জরুরী ভিত্তিতে স্থগিত করে সেখান থেকে জরুরি ভিত্তিতে শান্তিরক্ষীদেরকে প্রত্যাহার করা হয়েছিল। ম্যান্ডেট শেষ হওয়ার পর অনেক মিশনের সমাপ্তি টানা হয়েছিল। ১৯৯৬-৯৭ সালে কুর্দিস্থানের মিশন পরবর্তীতে ইরাক যুদ্ধের কারনে শেষ হয়ে যায়। ২০১৩-১৪ সালে আইভরিকোস্টে জাতিসংঘ মিশনের আকার ছোট হতে হতে শেষ হয়ে যায়। সাউথ সুদানে প্রথম দিকে মিশনের আকার বড় থাকলেও আস্তে আস্তে তা কমে আসে। এই মিশনগুলোতে অংশগ্রহণ করে বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীদের দক্ষতা ও সুনামের অংশীদার হতে পেরে গর্বিত।
শান্তিরক্ষী প্রেরণকারী দেশ হিসেবে বাংলাদেশের ১৯৮৮ সালে শান্তিরক্ষা মিশনে যোগ দেয়। শান্তিরক্ষা মিশনে সেনা ও পুলিশ সদস্য পাঠানো বৃহত্তর দেশ হিসেবে বাংলাদেশ গত ৩৩ বছরে সাহসিকতা, সক্ষমতা, নির্ভরতা, নেতৃত্ব ও পেশাদারত্বের মাধ্যমে অত্যন্ত মর্যাদা অর্জন করেছে। বাংলাদেশ থেকে এ পর্যন্ত ১ লাখ ৭৬ হাজার ৬৬৯ জন শান্তিরক্ষী জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে দায়িত্ব পালন করেছে এবং বর্তমানে মালি, দক্ষিণ সুদান, সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক ও কঙ্গো প্রজাতন্ত্রের মতো কঠিন কিছু জায়গাসহ ১০টি মিশনে বাংলাদেশের ৬ হাজার ৭৪২ জন শান্তিরক্ষী তাদের দায়িত্ব পালন করছে। জাতিসংঘ মহাসচিবের শান্তিরক্ষা এজেন্ডার প্রতি সমর্থন জানিয়ে, নারী শান্তিরক্ষীর সংখ্যা বৃদ্ধির আহ্বানে সাড়া দিয়ে বাংলাদেশ নারী শান্তিরক্ষী পাঠাতে শুরু করেছে এবং এ পর্যন্ত ২ হাজার ৩৪ জন নারী শান্তিরক্ষী শান্তিরক্ষা মিশনে দায়িত্বরত ছিল। বর্তমানে ২৮৪ জন নারী শান্তিরক্ষী বিভিন্ন মিশনে নিয়োজিত রয়েছে। জাতিসংঘের ম্যান্ডেটের অধীন ভবিষ্যতে যে কোনো শান্তিরক্ষা মিশনে অংশগ্রহণ করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রস্তুতি সবসময় রয়েছে।
গত ২৫ থেকে ২৬ জুন জাতিসংঘের আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল জিন পিয়েরে ল্যাক্রোইক্স এর বাংলাদেশ সফর কালে জাতিসংঘ মিশনে নিয়োজিত বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীদের অবদানের প্রশংসা করে বাংলাদেশ থেকে আরো শান্তিরক্ষী নিয়োগের বিষয়ে বিশেষ বিবেচনার আশ্বাস দেয়। দীর্ঘ সময় ধরে সর্বোচ্চ সংখ্যক শান্তিরক্ষী পাঠানোর জন্য বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে ধন্যবাদ জানায় ল্যাক্রোইক্স। ভবিষ্যৎ শান্তিরক্ষা মিশনে গুরুত্বপূর্ণ নিয়োগের জন্য বাংলাদেশি, বিশেষ করে নারী শান্তিরক্ষীদের নিয়োগের বিষয়ে আলোচনা হয়।
গত কয়েক দশক ধরে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশন যে গতিশীল প্রবণতা অর্জন করে বাংলাদেশ অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। গত কয়েক বছর ধরে শান্তিরক্ষী পাঠানোর ক্ষেত্রে বাংলাদেশ শীর্ষ দেশ। মিশন বন্ধ হয়ে গেলে সেখান থেকে শান্তিরক্ষী প্রত্যাহার একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া, এতে ভুল বোঝার বা এসংক্রান্ত বিষয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানোর কোনো কারন নেই। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষায় বাংলাদেশের নেতৃত্বের জন্য আমাদের গর্বিত হওয়া উচিত। মালি মিশন নিয়ে বাংলাদেশের শান্তিরক্ষী সম্পর্কে কিছু গোষ্ঠীর নেতিবাচক প্রচারনার প্রবনতা দেখা যাচ্ছে যা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। অতীতের বিভিন্ন মিশনে বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা সুনাম, কৃতিত্ব অর্জন এবং মানবাধিকার নিশ্চিতে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রশংসিত হয়েছে। বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীদের অর্জন ও ত্যাগ স্বীকারের মধ্য দিয়ে গড়ে তোলা ইতিবাচক ভাবমূর্তি নষ্ট করার প্রবনতা সম্পূর্ণভাবে অগ্রহণযোগ্য। বাংলাদেশের শান্তিরক্ষা মিশনের বিরুদ্ধে অপপ্রচার কখনও সফল হয়নি এবং এই অপপ্রচার মোকাবিলায় মিডিয়া কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। পেশাগতভাবে দক্ষ ও অভিজ্ঞ বাংলাদেশী শান্তিরক্ষীরা আগামী দিনগুলোতে বিশ্বের যে কোন প্রান্তে জাতিসংঘের ম্যান্ডেটের অধীনে শান্তি প্রতিষ্ঠায় তাদের অবদান অব্যাহত রাখবে এটাই প্রত্যাশা।
লেখক: ব্রি. জে. (অব.) হাসান মো. শামসুদ্দীন, এনডিসি, এএফডব্লিউসি, পিএসসি, এম ফিল। মিয়ানমার ও রোহিঙ্গা বিষয়ক গবেষক।