বাংলাদেশের বৈশ্বিক ভাবমূর্তি: প্রসঙ্গ রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন

:: Rayhan Hossain
প্রকাশ: ২ years ago

ব্রি. জে. (অব.) হাসান মো. শামসুদ্দীন: 
রোহিঙ্গা সংকট বাংলাদেশের একটা চলমান গুরুত্ব পূর্ণ সমস্যা। গত ২৫ আগস্ট রোহিঙ্গা সংকট পাঁচ বছর পূর্ণ হয়ে ছয় বছরে পড়েছে কিন্তু এখন পর্যন্ত প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু হয়নি। ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট মিয়ানমারের রাখাইন স্টেট থেকে নির্যাতন, নিপীড়নের শিকার হয়ে প্রাণভয়ে পালিয়ে আসা নিরাশ্রয় রোহিঙ্গাদের জন্য বাংলাদেশ এখন এক নিরাপদ আবাস। বর্তমানে কক্সবাজার ও ভাসান চর মিলিয়ে প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অবস্থান করছে। মানবতাবাদী মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিপন্ন রোহিঙ্গাদেরকে আশ্রয় দিয়ে তাঁর মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির জন্য ‘মাদার অব হিউমিনিটি’ উপাধিতে ভূষিত হয়েছেন। সেই সাথে রোহিঙ্গাদের ন্যায্য দাবি নিয়ে সোচ্চার কণ্ঠে নিজের মতামত ব্যক্ত করে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বলিষ্ঠ ভুমিকা রেখেছেন এবং রেখে যাচ্ছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, ২০১৭ সাল থেকে জাতিসংঘ এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক ফোরামের মাধ্যমে বিশ্ব সম্প্রদায়ের কাছে রোহিঙ্গা সংকটের গুরুত্ব বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন। ১২ সেপ্টেম্বর তিনি কক্সবাজারের উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্প পরিদর্শন করে বলেছিলেন, ‘আমরা ১৬ কোটি মানুষের দেশ। সবার খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারছি। সেখানে আরও ৭ লাখ মানুষকেও খেতে দিতে পারবো’। এর পরদিন ১৩ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূতরা ক্যাম্প পরিদর্শনে সেখানে গিয়েছিলেন। সে সময় শেখ হাসিনা মিয়ানমারকে ওই হত্যাযজ্ঞ বন্ধ ও তাদের নাগরিকদের ফিরিয়ে নিতে চাপ দেওয়ার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে তখন এই সংবাদ দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছিল।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী রোহিঙ্গা সংকটের স্থায়ী সমাধানে ২০১৭ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭২তম অধিবেশনে রাখাইন রাজ্যে নৃশংসতা বন্ধে স্ব-উদ্যোগী হওয়ায় জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ ও মহাসচিবকে ধন্যবাদ জানান। রোহিঙ্গা সংকটের সমাধানের লক্ষ্যে তিনি তখন পাঁচটি পদক্ষেপ নেয়ার প্রস্তাব করেছিলেন। পরবর্তীতে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭৪তম অধিবেশনে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী চার দফা প্রস্তাব রাখেন। তাঁর এই প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়িত হলে রোহিঙ্গা সমস্যার দ্রুত সমাধান হতো।

২০১৭ সালের ১১ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে চলা মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর অভিযানকে “জাতিগত নির্মূল কর্মকাণ্ডের ‘টেক্সটবুক’ উদাহরণ” বলে আখ্যায়িত করে। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাক্রোঁ এক ধাপ এগিয়ে একে ‘গণহত্যা’ বলে মন্তব্য করেছিলেন৷ মিয়ানমারে জাতিসংঘের উদ্যোগে সুরক্ষা বলয় গড়ে তুলতে চাইলে নিরাপত্তা পরিষদের অনুমোদন প্রয়োজন হবে৷ কিন্তু সেখানে মিয়ানমারের সমর্থক চীনের ভেটো ক্ষমতা থাকায় তা বাস্তবায়িত হয়নি।মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সুযোগ্য নেতৃত্বের কারণে ২০১৭ সাল থেকেই রোহিঙ্গাদের নির্যাতন-নিপীড়নের সমস্যা সারা বিশ্বব্যাপী সুশীল সমাজের মনে আলোড়ন সৃষ্টি করে। তখন থেকে জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের জন্য কাজ করে যাচ্ছে। জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনান রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের জন্য সুপারিশ মালা পেশ করেছিলেন যা কফি আনান কমিশন রিপোর্ট হিসেবে পরিচিত। এই সুপারিশ বাস্তবায়িত হলে রাখাইন প্রদেশের আর্থ সামাজিক পরিস্থিতির উন্নতি হত এবং রাখাইন প্রদেশে রোহিঙ্গাদের গ্রহণ যোগ্যতা বাড়াতে ভুমিকা রাখতে পারত।

২৩ অক্টোবর, ২০১৭, বাংলাদেশ এবং মিয়ানমার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিষয়ে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করে। ১৫ নভেম্বর, ২০১৮ প্রথম রোহিঙ্গা শরণার্থী প্রত্যাবাসন প্রচেষ্টা স্থগিত হয় পরবর্তীতে ২২ আগস্ট, ২০১৯, রোহিঙ্গা শরণার্থী প্রত্যাবাসনের দ্বিতীয় প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়।

মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে সুরক্ষা, নিরাপত্তা ও চলাফেরার স্বাধীনতা এবং সামগ্রিকভাবে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি না হওয়ায় এখন পর্যন্ত একজন রোহিঙ্গাও মিয়ানমারে ফিরে যায়নি। ২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থানের পর সেখানকার সার্বিক নিরাপত্তা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। জান্তাবিরোধী তুমুল বিক্ষোভ, প্রতিবাদ ও রক্তপাত মিয়ানমারকে সংঘাতের দিকে ঠেলে দিয়ে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে অনিশ্চয়তার সৃষ্টি করেছে। গত পাঁচ বছর ধরে মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের স্বেচ্ছায়, নিরাপদ ও টেকসই প্রত্যাবর্তনের উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হওয়াতে রোহিঙ্গাদের হতাশা ক্রমে তীব্র হচ্ছে এর ফলে নানা ধরনের নিরাপত্তাজনিত উদ্বেগ ও অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে। রোহিঙ্গা সংকট ধীরে ধীরে বাংলাদেশসহ এ অঞ্চলের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে হুমকি হয়ে উঠছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জানান, এই সমস্যা এখন আর বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের ক্যাম্পের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকছে না। এটা এখন আঞ্চলিক নিরাপত্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। পাশাপাশি এই এলাকার পরিবেশ, স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তাও ঝুঁকির সম্মুখীন হচ্ছে।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ২০২১ সালে প্যারিস পিস ফোরামে তার বক্তব্যে রোহিঙ্গারা যাতে মিয়ানমারে দ্রুত ফিরে যেতে পারে সে ব্যাপারে পদক্ষেপ নেয়ার জন্য বিশ্ব সম্প্রদায়কে আহ্বান জানান। বিশ্বনেতৃত্ব মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে নানাভাবে সম্মাননা জানিয়েছে। রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রশংসা করেছেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এর্দোয়ান৷ এ ছাড়া ও যুক্তরাজ্য , যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, কোরিয়া, স্পেন, ফ্রান্সসহ বিশ্বের বহু দেশের রাষ্ট্রপ্রধানরা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর মানবিক এই উদ্যোগের প্রশংসা করেছেন। ইউএনএইচসিআর-এর বিশেষ দূত ও অ্যাঞ্জেলিনা জোলি রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলার ক্ষেত্রে বলিষ্ঠ ও সহৃদয় নেতৃত্বদানের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রশংসা করেছেন।

মালেশিয়ান হাইকমিশনার মাদাম নূর আশিকিন বিন্তী মো. তায়িব বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অনেক বড় হৃদয়ের মানুষ। তিনি বিপুলসংখ্যক বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছেন। মানবতার দৃষ্টান্ত দেখিয়ে লাখ লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দেয়ায় সংবাদ সংস্থা ইন্টার প্রেস সার্ভিস থেকে ইন্টারন্যাশনাল অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মানবতার দৃষ্টান্ত দেখিয়ে লাখো রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দেয়া এবং রোহিঙ্গা ইস্যুতে দূরদর্শী ও বিচক্ষণ নেতৃত্বের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বের বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সম্মানেও ভূষিত হয়েছেন।

তিন বছর বন্ধ থাকার পর রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন নিয়ে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে ১৪ জুন ২০২২ পঞ্চম জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। বৈঠকে বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের দ্রুত প্রত্যাবাসন শুরুর প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি তুলে ধরে দ্রুত সময়ের মধ্যে রোহিঙ্গাদের যাচাই-বাছাই সম্পন্ন করা, তাদের নিরাপত্তা, জীবিকা ও কল্যাণ নিশ্চিত করার আহ্বান জানায়। ১৯ জুন বাংলাদেশের বিভিন্ন ক্যাম্পে অবস্থানকারী রোহিঙ্গারা বিশ্ব সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য ‘বাড়ি চলো’ কর্মসূচির আয়োজন করে। এর মাধ্যমে তাঁরা তাঁদের সাত দফা দাবী তুলে ধরে ও মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করে। ২০২১ সালের ২৯ সেপ্টেম্বরে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের পক্ষে সোচ্চার রোহিঙ্গা নেতা মাস্টার মুহিবুল্লাহকে গুলি করে হত্যার ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে জড়িত ব্যক্তিদের শাস্তির আওতায় আনার দাবি জানায় তাঁরা।

জুন মাসে রুয়ান্ডার কিগালিতে কমনওয়েলথের অনুষ্ঠান চলাকালীন সময় বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী এলিজাবেথ ট্রাসকে ১ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীকে যুক্তরাজ্যে পুনর্বাসনের জন্য প্রস্তাব দেয়া হয়। ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী যুক্তরাজ্য, আসিয়ান ও জি৭ জোটের মিত্রদেশগুলোর সঙ্গে মিলে মিয়ানমারের ওপর চাপ প্রয়োগ করবে বলে জানায়। ৪৮তম ইসলামী সহযোগী সংস্থার (ওআইসি) পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সম্মেলনে বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদেরকে রাখাইন রাজ্যে ফেরত পাঠানোর দাবি জানিয়েছে। এশিয়ার ভবিষ্যত বিষয়ক ২৭তম আন্তর্জাতিক নিক্কেই সম্মেলনে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রোহিঙ্গাদের নিরাপদ প্রত্যাবাসনে এশিয়ার দেশগুলোকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান ও এই সংকটের একটি গ্রহণযোগ্য মীমাংসা খুঁজে পেতে অবদান রাখতে এবং বাংলাদেশকে সাহায্য করার জন্য এশিয়ার দেশগুলোর নেতাদের অনুরোধ করেন।

রোহিঙ্গা সংকটের শান্তিপূর্ণ সমাধানের জন্য মিয়ানমারকে রাজি করাতে দক্ষিণ কোরিয়ার সহায়তা কামনা করেছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আসিয়ানের সভাপতিত্ব গ্রহণ এবং মিয়ানমারে আসিয়ান চেয়ারের বিশেষ দূত হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পর কম্বোডিয়ার উপ-প্রধানমন্ত্রী প্রাক সোখোন, রোহিঙ্গা ইস্যুর টেকসই সমাধানে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানোর বিষয়ে বাংলাদেশকে আশ্বাস দিয়েছে। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে মিয়ানমার বিষয়ক মহাসচিবের বিশেষ দূত ড. নোলিন হাইজারকে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া দ্রুত বাস্তবায়নের লক্ষ্যে রাখাইনে কর্মসূচি বাড়াতে অনুরোধ জানি‌য়ে‌ছেন জাতিসংঘে নিযুক্ত বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ১৯ জুন, ২০২২ নবনিযুক্ত কানাডিয়ান হাইকমিশনার লিলি নিকোলসকে জানান যে, রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে সামাজিক সমস্যা তৈরি করছে, তাদের অনেকেই মাদক ও নারী পাচারে জড়িত এবং দিন দিন তা বেড়েই চলেছে। কানাডার হাইকমিশনার বলেন, কানাডা সব সময় বাংলাদেশকে সহায়তা দেবে। কানাডা রোহিঙ্গাদের জন্য দাতব্যের মাধ্যমে একটি অতিরিক্ত তহবিল তৈরি করছে।

বাংলাদেশ চীনের সঙ্গেও আলোচনা অব্যাহত রেখেছে এবং ত্রিপক্ষীয়ভাবে কাজ করে যাচ্ছে তবে এখন পর্যন্ত ইতিবাচক কোনো ফল পাওয়া যায়নি। ৬ আগস্ট ২০২২, বাংলাদেশ সফরের সময় রোহিঙ্গা সঙ্কটের সমাধান খুঁজতে আন্তরিকভাবে কাজ করছে বলে জানিয়েছেন চীনের স্টেট কাউন্সিলর ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই। বাংলাদেশ রোহিঙ্গা সংকটে চীনের আরও জোরালো ভূমিকা ও প্রত্যাবাসন নিশ্চিতে রাজনৈতিক সমাধানের জন্য চীনের সহযোগিতা চায়।

মিয়ানমার ও বাংলাদেশ উভয়েরই অভিন্ন প্রতিবেশী ভারত। তাই রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে ফিরে যাওয়ার বিষয়ে অতীতেও বাংলাদেশ ভারতকে অনুরোধ করেছে এবং ভবিষ্যতেও এক্ষেত্রে দেশটিকে আরও সক্রিয় ভূমিকা পালনের জন্য বাংলাদেশ অনুরোধ অব্যাহত রাখবে। বাংলাদেশে লাখো রোহিঙ্গার উপস্থিতি বাংলাদেশের জন্য চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে বলে উল্লেখ করেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। ভারত এই সমস্যা সমাধানে গুরুত্ব পূর্ণ ভুমিকা রাখবে বলে তিনি আশা করেন। সাবেক ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিব হর্ষবর্ধন শ্রিংলার কাছে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছিল। এছাড়া সম্প্রতি ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের সঙ্গেও বিষয়টি আলোচনা করা হয়েছে।

১১ নভেম্বর ২০১৯ সালে আই সি জে তে গাম্বিয়ার করা মামলার প্রেক্ষিতে ২১ ফেব্রুয়ারী ২০২২ থেকে শুনানি শুরু হয়েছিল এবং ২৮ ফেব্রুয়ারী শুনানি শেষ হয়। ২২ জুলাই, মামলার এখতিয়ার নিয়ে মিয়ানমারের আপত্তি খারিজ করার পাশাপাশি আইসিজে অভিযোগের বিষয়ে মিয়ানমারকে ২০২৩ সালের ২৪ এপ্রিলের মধ্যে জবাব দেওয়ার নির্দেশ দেয়। এর ফলে এই মামলার বিচারপ্রক্রিয়া আবারও শুরু হলো।

আইসিজে তে করা মামলার বিচারকার্যের ওপর থেকে আপত্তি তুলে নিয়েছে মিয়ানমারের জাতীয় ঐক্যের সরকার (এন ইউ জি)। এন ইউ জি এই ইস্যুতে আন্তর্জাতিক বিচারব্যবস্থাকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করবে বলে জানায়। ‘রোহিঙ্গা’ হিসেবে তাঁদের পরিচয়ের স্বীকৃতি দিয়ে এন ইউ জি ‘পলিসি পজিশন অন দ্য রোহিঙ্গা ইন রাখাইন স্টেট’ নামে একটি অবস্থানপত্র প্রকাশ করেছে। মিয়ানমারের রাজনীতিকদের ২০১৭ সালের রোহিঙ্গা সংকট শুরু হওয়ার পর রোহিঙ্গাদের অধিকারের পক্ষে এভাবে কথা বলতে দেখা যায়নি। রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের জন্য এই গ্রহণযোগ্যতা রোহিঙ্গাদের প্রতি তাঁদের মনোভাব পরিবর্তনের একটা ইতিবাচক অগ্রগতি। মিয়ানমারের রাজনৈতিক মহলে এবং আরাকানের স্থানীয় রাজনীতিতে রোহিঙ্গাদের গ্রহণযোগ্যতা নিশ্চিত হলে সংকট সমাধান দ্রুত হবে।

এন ইউ জি’র পররাষ্ট্রমন্ত্রী জি মা অং, রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে মিয়ানমারের বেশ কিছু আইন বাতিল করে সংবিধানে পরিবর্তন আনতে হবে বলে মত প্রকাশ করেন। এন ইউ জি রোহিঙ্গাদের নিরাপদ প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করার জন্য রাখাইন অঞ্চলের স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা চালাচ্ছে। রাখাইনে রোহিঙ্গা ও রাখাইনদের মধ্যে পারস্পরিক অবিশ্বাসের জায়গা স্পষ্ট। দুই জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে বিশ্বাস স্থাপনের জন্য পারস্পরিক যোগাযোগ বাড়াতে উভয় সম্প্রদায়ের নেতাদের এ বিষয়ে ভূমিকা রাখতে হবে। এই যোগাযোগের পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারলে পারস্পরিক বিশ্বাসের জায়গা তৈরি হবে। দীর্ঘদিন ধরে মিয়ানমারে সাধারণ জনগণের মধ্যে প্রচারনার মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের প্রতি বিদ্বেষ ও ঘৃণা ছড়ানোর মাধ্যমে তাদেরকে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীতে পরিনত করা হয়েছিল।

যুক্তরাষ্ট্র আসিয়ানের সদস্য দেশগুলোর সঙ্গে মিয়ানমারের সংঘাত অবসানের জন্য কাজ করছে। রোহিঙ্গাদের জন্য পরিচালিত ‘যৌথ সাড়াদান পরিকল্পনায়’ ইউএসএআইডি ১৫ কোটি ২০ লাখ ডলার অনুদান দিয়েছে এবং রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর প্রতি অব্যাহত সমর্থন চলমান রেখেছে। যুক্তরাষ্ট্র ২১ মার্চ আনুষ্ঠানিকভাবে মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর দেশটির সেনাবাহিনীর চালানো সহিংসতাকে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। রোহিঙ্গাদের সুরক্ষার বিষয়ে ওআইসি ও ই ইউ উপস্থাপিত ‘মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলিমসহ অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানবাধিকার পরিস্থিতি’ শীর্ষক প্রস্তাবটি ২০২১ সালের ১৮ নভেম্বর, জাতিসংঘে সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হয়েছে। এটা রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃঢ় প্রতিশ্রুতিরই বহিঃপ্রকাশ। প্রস্তাবটিতে অন্যান্য কার্যক্রমের পাশাপাশি কক্সবাজারের আশ্রয়শিবিরগুলো থেকে রোহিঙ্গাদের একটি অংশকে ভাসানচরে স্থানান্তর, সেখানে অবকাঠামোসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা তৈরির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকারের প্রচেষ্টা ও বিনিয়োগের স্বীকৃতি দেওয়া হয়।

মিয়ানমারে মানবাধিকার লঙ্ঘন ও ভয়াবহ পরিস্থিতি অব্যাহত থাকায় দেশটির সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে আবারও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থানের পর চার ধাপে এখন পর্যন্ত ৬৫ জন ব্যক্তি ও ১০টি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করল ই ইউ। ইউরোপীয় কমিশন বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গা এবং স্বাগতিক সম্প্রদায়ের পাশাপাশি মিয়ানমারের রোহিঙ্গা এবং অন্যান্য সংঘাত-আক্রান্ত মানুষের জন্য মানবিক সহায়তায় অতিরিক্ত ২২ মিলিয়ন ইউরো বরাদ্দের ঘোষণা দিয়েছে। রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে চাপ প্রয়োগ করার জন্য ই ইউর কার্যকর সমর্থন প্রত্যাশা করে বাংলাদেশ। যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, স্পেন, জাপান, কোরিয়া, ফ্রান্সের মতো দেশগুলোর মিয়ানমারের সাথে অধিকতর বিনিয়োগ ও বাণিজ্য থাকায় তাদের দিক থেকেও রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে মিয়ানমারের উপর চাপ বজায় রাখা প্রয়োজন।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শী উদ্যোগের প্রেক্ষিতে আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় ভাসানচরে অস্থায়ী ভিত্তিতে প্রায় তিন হাজার ৯৫ কোটি টাকা ব্যয়ে এক লাখের বেশি রোহিঙ্গার জীবন-জীবিকার জন্য তৈরি করা হয়েছে ভাসানচর আশ্রয়ণ-৩। ভাসানচর বসবাসের উপযোগী করার জন্য অবকাঠামো উন্নয়ন, বনায়ন ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ নৌবাহিনীকে দায়িত্ব দেয়া হয় এবং তাঁরা তা সুসম্পন্ন করে। প্রায় ১৩ হাজার বর্গকিলোমিটারের এই দ্বীপের ছয় হাজার ৪২৭ একর ব্যবহারের উপযোগী ভূমির মধ্যে এক হাজার ৭০২ একর ভূমিতে রোহিঙ্গাদের অস্থায়ীভাবে বসানোর জন্য আবাসন প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হয়। সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রন, পরিবেশ বিপর্যয় এবং কক্সবাজারের আশ্রয়শিবিরগুলোর ওপর থেকে চাপ কমাতে বাংলাদেশ সরকার ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের স্থানান্তর কার্যক্রম হাতে নিয়েছে যা একটি দূরদর্শী ও সময়োপযোগী পদক্ষেপ । এ পর্যন্ত প্রায় ৩০ হাজার রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে স্থানান্তর করা হয়েছে। সবমিলিয়ে এক লাখ রোহিঙ্গাকে সেখানে নেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। ৯ অক্টোবর, ২০২১, বাংলাদেশ এবং জাতিসংঘ রোহিঙ্গাদের সহায়তার জন্য ভাসানচরে জাতিসংঘের নিযুক্তির বিষয়ে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করে। জাপান ভাসানচরের রোহিঙ্গাদের সহায়তায় জাতিসংঘ ও বাংলাদেশের মধ্যে সম্পাদিত সমঝোতা স্মারকের আলোকে দুই মিলিয়ন মার্কিন ডলার দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। বাংলাদেশ জাপানের পক্ষ থেকে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে অগ্রনি, সক্রিয় ও অর্থবহ ভুমিকা আশা করে। রোহিঙ্গাদের সুরক্ষায় বাংলাদেশ সরকারের আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে নেয়া উদ্যোগর প্রশংসা করেছে জাপান। জাপান সরকার ডব্লিউএফপি এবং জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) মাধ্যমে অতিরিক্ত আরও ৯ মিলিয়ন ডলার সহায়তা দেবে বাংলাদেশকে। বর্তমানে জাতিসংঘ ও জাপানের পাশাপাশি আমেরিকা ও কানাডা এই প্রকল্পে সহায়তা প্রদানের আশ্বাস দিয়েছে। ভাসানচরে এখনো বিশ্ব খাদ্য সংস্থার (ডব্লিউএফপি) কার্যক্রম শুরু না হওয়ায় সেখানে রোহিঙ্গাদের ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশের ওপর এককভাবে চাপ পড়ছিল। এই নতুন সহযোগিতার নিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে সেটা অনেকংশে কমবে।

এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) রোহিঙ্গাদের জন্য নতুন করে ৭ কোটি মার্কিন ডলার অনুদান দেয়ার কথা জানিয়েছে। বিশ্বব্যাংক টেকনাফ ও উখিয়ায় অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের খাদ্য সহায়তায় অনুদান হিসেবে ২৫৫ কোটি টাকার সমপরিমাণ অর্থ দেবে বলে জানিয়েছে।
জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার হাইকমিশনার ফিলিপ্পো গ্র্যান্ডি রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মানবিক সহায়তা অব্যাহত রাখার ওপর জোর দিয়ে এই সমস্যার মূল সমাধান প্রত্যাবাসনে জন্য আঞ্চলিক দেশগুলোকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন। কোভিড-১৯ মহামারি পরবর্তী ইউক্রেন ও আফগানিস্তান সমস্যার ফলে সৃষ্ট বৈশ্বিক অস্থিতিশীলতার কারণে ‌রোহিঙ্গাদের তহবিল সংকটের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সহযোগিতা না কমানোর অনুরোধ জানানো হয়। প্রতি বছর ক্যাম্পগুলোতে প্রায় ৩৫ হাজার শিশু জন্ম নিচ্ছে, জনসংখ্যার এই বাড়তি চাপ মোকাবেলা ক্রমেই মানবিক সহায়তার উপর চাপ ফেলছে। ইউএনএইচসিআর মিয়ানমারে কাজ করার জন্য মিয়ানমারের সামরিক সরকারের সাথে আগের চুক্তি নবায়ন করেছে। এর ফলে রাখাইনের প্রকল্পগুলোতে তাঁরা কাজ শুরু করতে পারবে।

রোহিঙ্গাদের গ্রহণযোগ্যতা ও তাদের প্রতি সহনীয় মনোভাব ফিরিয়ে আনতে বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্র যেমন কম্বোডিয়া, লাওস, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, শ্রীলংকা মিয়ানমারের বৌদ্ধ সংগঠনগুলোর মনোভাব নমনীয় করে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখতে পারে।
মিয়ানমারের অর্থনীতিতে আঞ্চলিক অনেক দেশের গুরুত্বপূর্ণ অবদান আছে। তাঁদের বিনিয়োগ এবং চলমান বাণিজ্য সহযোগিতা মিয়ানমারকে পশ্চিমা বিশ্বের অবরোধ ও চাপ থেকে রক্ষা করছে এবং এর ফলে রোহিঙ্গা সংকট সমাধান প্রলম্বিত হচ্ছে। মিয়ানমারে বিনিয়োগকারী প্রথম সারির দেশগুলো হল, সিঙ্গাপুর, চীন, থাইল্যান্ড, মার্সাল দ্বীপপুঞ্জ, হংকং, সাউথ কোরিয়া, ইউ কে, মালয়েশিয়া, ব্রুনাই, ভিয়েতনাম এবং ভারত। ক্ষমতা গ্রহনের প্রথম দিকে অর্থনৈতিক অবস্থার কিছুটা অবনতি হলেও বিনিয়োগ অব্যাহত থাকায় সামরিক সরকার পরিস্থিতি সামলে নিয়েছে। এই দেশগুলোর মাধ্যমে মিয়ানমারকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি ও প্রত্যাবাসন ত্বরান্বিত করার জন্য চাপ সৃষ্টি করতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাপান ও থাইল্যান্ডে অবস্থানকারী অভিবাসী রোহিঙ্গাদের এই কাজে এগিয়ে আসতে হবে, ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোকেও এ বিষয়ে সক্রিয় হতে হবে। আঞ্চলিক দেশগুলোর মধ্যে চীন, জাপান, কোরিয়া, সিংগাপুর, থাইল্যান্ড ও ভারত, বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের জন্য আর্থিক ও মানবিক সাহায্য দেয়ার সক্ষমতা রয়েছে। আসিয়ান দেশগুলোর সাথে ব্যবসায়ীক স্বার্থের কারনে মিয়ানমারকে সুসম্পর্ক রাখতেই হবে, তাই এই দেশগুলো রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন এবং চলমান মানবিক সংকট মোকাবেলায় আরও জোরালো ভুমিকা রাখতে পারে।

কি হয়নি:

আন্তর্জাতিক সংস্থা, আসিয়ান দেশগুলো সহ আঞ্চলিক দেশগুলো আরাকানে রোহিঙ্গাদের ফেরত নেয়ার মত মনস্তাত্ত্বিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক কোন সেক্টরে ফলপ্রসূ কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি।

কফি আনান কমিশনের সুপারিশ সমূহ বাস্তবায়ন করে আরাকানের অধিবাসীদের জীবনমান ও আর্থসামাজিক অবস্থার কোন উন্নয়ন হয়নি।
আরাকানে চলমান সামরিক অভিযান এখনও বন্ধ হয়নি এবং আরাকানের নিরাপত্তা পরিস্থিতি রোহিঙ্গা পুনর্বাসনের উপযোগী হয়নি।গত ২৮ আগস্ট থেকে বাংলাদেশ মিয়ানমার সীমান্ত অঞ্চলে মিয়ানমার আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে অভিযান চালাচ্ছে। এই আক্রমনের ফলে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে গোলা এসে পড়ছে যা অনভিপ্রেত ও আন্তর্জাতিক আইনের লংঘন। বাংলাদেশ কূটনৈতিক ভাবে এর তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে। আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তার স্বার্থে মিয়ানমারের আভ্যন্তরীণ সংঘাত দ্রুত বন্ধ করার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সক্ষম হয় নাই।
বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী বাংলাদেশের বন্ধু রাষ্ট্রগুলো আরাকানের বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের মাঝে রোহিঙ্গাদের ফেরত নেয়ার ক্ষেত্র প্রস্তুতের বিষয়ে তেমন কোন পদক্ষেপ নেয়নি।

আরাকানের জনগণ এবং রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধান এবং তাঁদের প্রত্যাবাসনের বিষয়ে ফলপ্রসূ আলোচনা কিংবা যোগাযোগ সম্ভব হয়নি।

করণীয়:

রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান না হওয়া পর্যন্ত জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে রোহিঙ্গা পরিস্থিতি এবং এর অগ্রগতি বিশ্ববাসীর কাছে নিয়মিতভাবে তুলে ধরে সবাইকে ওয়াকিবহাল রাখার প্রক্রিয়া চলমান রাখতে হবে।

ইউক্রেন শরণার্থী সমস্যা ও বৈশ্বিক অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে জাতিসংঘ এবং দাতা সংস্থাগুলোর সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রেখে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহায়তায় চলমান মানবিক সহায়তা ও ত্রানের ব্যবস্থা নিশ্চিত করার উদ্যোগ নিতে হবে।
রাখাইন প্রদেশের জনগণ এবং রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে সম্পর্কস্থাপন এবং রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে তাঁদের মনোভাব সহনীয় করার বিষয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, অভিবাসী রোহিঙ্গা নেতৃবৃন্দ এবং রোহিঙ্গা অধিকার নিয়ে সক্রিয় গ্রুপগুলোকে এই সমস্যা সমাধানে কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে হবে।

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও দাতা সংস্থাগুলো ক্যাম্পে থাকা রোহিঙ্গাদেরকে প্রয়োজনীয় শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে ভবিষ্যতে কর্মসংস্থান ও দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে মিয়ানমারের মুল জনস্রোতে মিশে যাওয়ার সক্ষমতা তৈরি করতে হবে।

রাখাইন প্রদেশের অবকাঠামো ও উন্নয়ন নিশ্চিত করে কর্ম সংস্থান ও মৌলিক সমস্যাগুলো উন্নয়নের জন্য কফি আনান কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সক্রিয় ভুমিকা নিতে হবে।

আঞ্চলিক দেশগুলোকে এই সংকট সমাধানে মানবিক, রাজনৈতিক এবং আর্থিক সহযোগিতা বৃদ্ধি করে সংকট সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখতে হবে।

মিয়ানমারের জনগণ বিশেষত রাখাইন প্রদেশের সাধারণ মানুষের মনোভাব পরিবর্তন ও রোহিঙ্গাদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানোর প্রচেষ্টা আন্তর্জাতিক সংস্থা ও সম্প্রদায়, জাতিসংঘ, অভিবাসী রোহিঙ্গা সংগঠন, এন ইউ জি ও আরাকান আর্মির প্রতিনিধির মাধ্যমে তা চলমান রাখতে হবে।

মিয়ানমারে বিনিয়োগকারী বন্ধু প্রতিম দেশগুলোর মাধ্যমে মিয়ানমার সরকারের ও জনগণের মাঝে রাজনৈতিক সচেতনতা ও সামাজিক আবেদন সৃষ্টির মাধ্যমে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করতে হবে।

বাংলাদেশ মিয়ানমার সম্পর্ক উন্নয়নের প্রচেষ্টা চলমান রাখতে হবে। দুই দেশের মধ্যে বিরাজমান সামাজিক ও রাজনৈতিক দূরত্ব কমিয়ে প্রতিবেশী সুলভ সখ্যতা বাড়াতে হবে।

বন্ধুপ্রতীম বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী দেশগুলোর মাধ্যমে কট্টরপন্থী বৌদ্ধ সংগঠনগুলোর আচরণগত পরিবর্তন আনা ও রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষমূলক প্রচারনা ত্যাগ করে তাঁদের মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধির ব্যবস্থা করার উদ্যোগ নিতে হবে।

মিয়ানমারের আভ্যন্তরীণ সংঘাত বন্ধে আঞ্চলিকদেশগুলো উদ্যোগ নিয়ে রাখাইনে প্রত্যাবাসন উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টি করে প্রত্যাবাসন ত্বরান্বিত করতে হবে। জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক শরণার্থী সংস্থা উদ্যোগ নিয়ে তৃতীয় কোন দেশে রোহিঙ্গাদের স্থানান্তর করতে পারে।

ক্যাম্পের জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে ত্রান ও মানবিক সহায়তার উপর চাপ পড়ছে তাই ক্যাম্পে প্রজনন স্বাস্থ্য , জন্মনিয়ন্ত্রন, বহুবিবাহের বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টির পাশাপাশি এই নতুন প্রজন্মের ভবিষ্যৎ নিয়ে আন্তর্জাতিক সংস্থা ও জাতিসংঘ কার্যকরী ও ফলপ্রসূ ভুমিকা রাখতে হবে।

রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে সহিংসতা দেখে এসেছে, বাংলাদেশে তাঁরা দীর্ঘ পাঁচ বছর ধরে প্রত্যাবাসনের অপেক্ষায় আছে। এখানে তাঁরা ত্রাণের উপর নির্ভরশীল এবং কর্মহীন। হতাশা রোহিঙ্গা যুব সমাজকে গ্রাস করছে এবং এই মানবিক সংকট বর্তমানে নিরাপত্তার ক্ষেত্রে মারাত্মক হুমকি সৃষ্টি করেছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রাজ্ঞ সিদ্ধান্তের কারনে বাংলাদেশ সরকার দক্ষতার সাথে দীর্ঘ দিন ধরে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখায় তা এখন পর্যন্ত আঞ্চলিক নিরাপত্তায় হুমকি হয়ে উঠেনি যা প্রশংসার দাবী রাখে। কর্মহীন রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী সন্ত্রাসী নেটওয়ার্ক দ্বারা প্রভাবিত হয়ে নানা ধরনের অবৈধ ও নাশকতামূলক কার্যক্রমে যুক্ত হচ্ছে এবং এই প্রবনতা দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে সংগঠিত নাশকতামূলক ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড এক সময় নিয়ন্ত্রনের বাইরে চলে গেলে তা আঞ্চলিক নিরাপত্তায় হুমকি হিসেবে দেখা দিতে পারে। রোহিঙ্গা সমস্যা ক্রমাগত একটা দীর্ঘ মেয়াদী সমস্যার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। বর্তমান অস্থিতিশীল বিশ্ব পরিস্থিতিতে এই সংকট স্থিতিশীলতা ও আঞ্চলিক নিরাপত্তার প্রতি হুমকি স্বরূপ। দ্রুত এই সমস্যার সমাধান হোক এটাই এখন কাম্য।

 

লেখক: ব্রি. জেনারেল (অব.) হাসান মো. শামসুদ্দীন, এনডিসি, এএফডব্লিউসি, পিএসসি, এম ফিল, মিয়ানমার ও রোহিঙ্গা বিষয়ক গবেষক।

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা:
প্রত্যাবাসনের শুরুতে মিয়ানমারের ক্যাম্পে থাকা রোহিঙ্গাদের নিজ গ্রামে ফেরা নিশ্চিত করতে হবে