বড় ঝামেলা ও বিপদে পড়বেন অসচ্ছল ও নিন্মবিত্ত শ্রেণির মানুষ, যাদের ৪৩টি সেবার কোনো একটি নেওয়ার প্রয়োজনে ন্যূনতম ২০০০ টাকা কর দিতে হবে। অর্থাৎ, অসচ্ছল ও নিন্মবিত্ত শ্রেণির মানুষও সরাসরি করের আওতায় আসছেন। নির্বাচনের বছরে বিভিন্ন সরকারি সেবা পেতে করযোগ্য আয় না থাকলেও ন্যূনতম ২ হাজার টাকা কর দেওয়ার ব্যবস্থা কতটা যৌক্তিক তা আমাদের অনুমেয় নয়। আমরা মনে করি, যে কর দেওয়ার যোগ্য, ক্ষমতা-আয় যার আছে, সে তো কর দেবে, কিন্তু যার নেই তার ওপর আবার বসিয়ে দিলাম। এটা সাংঘর্ষিক ও বৈষম্যমূলক। নৈতিকভাবেও এটা ঠিক নয়।
গত ১ জুন ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতার আগে অর্থমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেছিলেন, আগামী অর্থবছরের বাজেট হবে গরিবদের জন্য। কিন্তু বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রীর কথার প্রতিফলন পাওয়া যায়নি। জাতীয় নির্বাচনের আগে শেষ বাজেট হওয়ায় অনেকে আশায় ছিলেন, গত বছরখানেক থেকে বেড়ে যাওয়া খাদ্য ও খাদ্যবহির্ভূত খরচ কমবে। অর্থমন্ত্রী সাধারণ মানুষের ঘর-গৃহস্থালির জিনিসপত্রেরও দাম বাড়ালেন। প্লাস্টিক পণ্য, অ্যালুমিনিয়ামের পণ্য, স্যানিটারিওয়্যার, কিচেন টাওয়াল, টিস্যুর দাম বাড়ালেন। প্লাস্টিকের দরজা-জানালার দামও বাড়ানো হলো। প্রশ্ন উঠতে পারে সাধারণ মানুষ কী পেল? প্রস্তাবিত বাজেটে রাজস্ব আদায় বাড়াতে গিয়ে সামগ্রিকভাবে জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ানো হয়েছে।
মানুষ যেদিন জš§গ্রহণ করে তারপর থেকে সে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সরকারকে ট্যাক্স দিতে থাকে। প্রথম শুরু হাসপাতালের বিল দিয়ে, যেখানে সরকার ভ্যাটের মাধ্যমে তা আদায় করে। এরপর শিশুর ওষুধ, গুড়ো দুধ, পরিধান সামগ্রী, যেমন- কাপড়, টিস্যু, সাবান, তেল, পাউডার, খেলনা ইত্যাদি জায়গায় সরকার ভ্যাট বসিয়ে তা আদায় করে; এবং একইভাবে ফকিরও ট্যাক্সের আওতার বাইরে নয়। এখন শুধু বাকি বেঁচে থাকতে হলে (স্বাস-নিঃশ্বাসে) কর আদায়!
আওয়ামী লীগ সরকার বলেছিল ঘরে ঘরে চাকরি দেবে। এখন সবার ঘাড়ে ঘাড়ে করের বোঝা! বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বেকারদের ভাতা দেওয়া হয়, অথচ আমাদের দেশে আয় না থাকলেও সেবা নিতে ২০০০ টাকা কর দিতে হবে। এ যেনো ‘মরার উপর খাঁড়ার ঘা।’ সাধারণ মানুষকে আর কত চিপায় ফেলানো হবে, কবে না জানি সাধারণ মানুষ চাপ দেয়!
যাদের ইনকাম হাজার হাজার কোটি টাকা (গরিব ঠকিয়ে/ টাকা পাচারকারী/ সিন্ডিকেট ও ভেজাল কারবারি/ ঘুষখোর) তারা যদি কর ফাঁকি না দিত। এছাড়া, দুর্নীতি বন্ধের ব্যাপারেও সরকার যদি এমন কঠোর হতো, তাহলে ২০০০ টাকা কর ধার্য করার প্রয়োজন হতো না।
করের সীমারেখা ৩ লাখ থেকে সাড়ে ৩ লাখ করা হলো মানুষকে স্বস্তি দেয়ার জন্য, আবার যার করযোগ্য আয় নেই তাকে কর দিতে হবে, এটা সাংঘর্ষিক। এটার কোনো যৌক্তিকতা নেই। একদিকে বলা হচ্ছে বার্ষিক আয় সাড়ে তিন লাখ পর্যন্ত করমুক্ত; অন্যদিকে বলা হচ্ছে রিটার্ন জমার বাধ্যবাধকতা যাদের আছে, তাদের ২ হাজার টাকা কর দিতে হবে। তাহলে করমুক্ত আয়ে ছাড় দিয়ে লাভ হলো কি? কৌশলে অল্প আয়ের মানুষের ওপর ঠিকই করের ভার চাপিয়ে দেওয়া হলো। মানুষকে স্বস্তি দিতে এখানে করমুক্ত আয় বাড়িয়ে আবার যার করযোগ্য আয় নেই তার উপর ২ হাজার টাকার কর আরোপ করা এটা কীভাবে যুক্তিযুক্ত হয় তা আমরা খুঁজে পাই না।
আমরা তো দেখি, যারা উচ্চ আয়ের মানুষ, যারা অতিধনী, তাদের মধ্যেই অনেকে করখেলাপি, ঋণখেলাপি, টাকা পাচারকারী। তারা নানা ধরনের সরকারি সুবিধাপ্রাপ্ত। পাশাপাশি উঁচু ধনীদের মধ্যে যারা করখেলাপি, ঋণখেলাপি, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা শক্তভাবে যদি বলা হতো, তাহলে হয়তো বিষয়টি ন্যায্যতা পেত। সরকারি সুবিধা নাগরিকের ন্যায়সংগত অধিকার। সেখানে এ রকম শর্ত আরোপ করা মোটেই যৌক্তিক হতে পারে না।
যারা দরিদ্র সীমার নীচে বাস করে, তথা বার্ষিক ৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা থেকে আয় কম, তারা কিন্তু প্রতিটি পণ্য ক্রয় করতে মূল্য সংযোজন কর দিয়ে থাকে। এর মাধ্যমে কি গর্বিত হওয়া যায় না? মোবাইলে টাকা রিচার্জ করার সাথে সাথে ১৬ পার্সেন্ট ভ্যাট নিয়ে যায়, এতেও কি আমরা গর্বিত হই না? বাংলাদেশের রাজস্ব আয়ের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ খাত হলো মোবাইল কোম্পানিগুলো থেকে আয়। এ খাতে সমাজের দরিদ্র শ্রেণির মানুষ থেকে বেশি আয় হয়। এনবিআরের চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম বলেছেন, ‘আয়কর হিসেবে দুই হাজার টাকা সরকারি কোষাগারে দিয়ে উন্নয়নে শামিল হওয়া গর্বের ব্যাপার।’ আরো আরো গর্বের বিষয় হলো হলো আয়কর অফিসের অনেকেই (সবাই নয়) সীমাহীন ঘুষ ও দুর্নীতিতে নিমজ্জিত। সরকারি সেবার নামে যখন ‘সেবন’ করা হয়, সে গর্বে তো জনগণের গর্ভপাত হওয়ার অবস্থা। এটা কম গর্বের বিষয়?
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে এ বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত একটি জরিপ চালিয়েছিল। তাতে দেখা গেছে, ১৮ শতাংশ নিু আয়ের পরিবারের কখনো কখনো পুরো দিন না খেয়ে থাকতে হয়েছে, ৭১ শতাংশ পরিবার প্রয়োজনের তুলনায় কম খাবার খেয়েছে। ৩৭ শতাংশ পরিবার মাঝেমধ্যে কোনো এক বেলা খাবার না খেয়ে থেকেছে। এদের এক বড় অংশকেই কোনো কোনো কারণে সরকারি সেবার জন্য যেতে হয় বা হবে। আর সে জন্য আয়কর দেওয়ার নম্বর (টিআইএন) লাগবে এবং এই নম্বরের জন্য তাদের দুই হাজার টাকা কর দিতে হবে?
যেসব সেবা নেওয়ার জন্য আয়কর রিটার্ন জমা দিতে হবে সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো, ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানে পাঁচ লাখ টাকা বা তার বেশি অঙ্কের ঋণের আবেদন করলে; সিটি করপোরেশন বা পৌরসভার অধীনে ট্রেড লাইসেন্স লাভ বা নবায়ন, সমবায় সমিতির নিবন্ধন লাভ; নিবন্ধন, স্থানান্তর চুক্তি, বায়নানামা, আমমোক্তারনামা, জমি বিক্রয়, সিটি করপোরেশন, পৌরসভা ও জেলা সদরে অ্যাপার্টমেন্ট নির্মাণ, ক্রেডিট কার্ড নেওয়া বা ধারাবাহিক ব্যবহারের ক্ষেত্রে; চিকিৎসক, ডেন্টিস্ট, আইনজীবী, চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট, কস্ট অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউনট্যান্ট, প্রকৌশলী, স্থপতি, সার্ভেয়ার বা অন্যান্য সমজাতীয় পেশাদারদের পেশাদার সংগঠনের সদস্যপদ লাভে; মুসলিম বিবাহ ও তালাক (নিবন্ধন) আইনের অধীনে লাইসেন্স লাভ ও টিকিয়ে রাখতে; বাণিজ্য ও পেশাদার সংগঠনের সদস্যপদ লাভে; ওষুধ বিক্রির লাইসেন্স পেতে, ফায়ার লাইসেন্স, পরিবেশগত ছাড়পত্র, বিএসটিআই লাইসেন্স ও ক্লিয়ারেন্স পেতে; যেকোনো এলাকায় গ্যাসের বাণিজ্যিক ও শিল্প সংযোগ এবং সিটি করপোরেশন এলাকায় গ্যাসের আবাসিক সংযোগ; ভাড়ায় চালিত লঞ্চ, স্টিমার, ফিশিং ট্রলার, কার্গো, কোস্টার, ডাম্ব বার্জ ইত্যাদিসহ যেকোনো জলযানের জরিপ সার্টিফিকেট লাভে; ইংরেজি মাধ্যম বিদ্যালয়ে সন্তান বা পোষ্যের ভর্তির ক্ষেত্রে; সিটি করপোরেশন বা ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড এলাকায় বিদ্যুৎ সংযোগ পাওয়া; কোম্পানির এজেন্সি বা ডিস্ট্রিবিউটরশিপ পাওয়া ও অব্যাহত রাখা; পাঁচ লাখ টাকার বেশি অঙ্কের পোস্টাল সঞ্চয়ী হিসাব খোলা; উপজেলা, পৌরসভা, জেলা পরিষদ, সিটি করপোরেশন বা জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণে; সিটি করপোরেশন এলাকায় বাড়ি ভাড়া বা লিজ গ্রহণের সময় বাড়ির মালিকের; ট্রাস্ট, তহবিল, ফাউন্ডেশন, এনজিও, ক্ষুদ্রঋণ বিতরণকারী সংস্থা, সোসাইটি ও সমবায় সমিতির ব্যাংক হিসাব খুলতে; স্ট্যাম্প, কোর্ট ফি ও কার্টিজ পেপারে ভেন্ডর বা দলিল লেখক হিসেবে নিবন্ধন, লাইসেন্স বা তালিকাভুক্তি করতে বা বহাল রাখতে, ইত্যাদি।
তাহলে এর বাইরে কোন সেবা বাকি থাকলো? এসব সেবা নিতে গেলে ন্যূনতম ২০০০ টাকা করের বিধানকে সরকারিভাবে আইনি প্রক্রিয়ায় চাঁদাবাজি বলেও কেউ কেউ বর্ণনা করেছেন। ৪৩ সেবা বলে কম মনে হচ্ছে, আসলে তা নয়, প্রকৃতপক্ষে সবার উপরে কর আরোপ করা হয়েছে। উপরোক্ত যেসব সেবার কথা বলা হয়েছে সেগুলো প্রত্যেকেরই কোন না কোনটা অতীব প্রয়োজন। তার মানে সবার থেকে কর আদায় করাটাই সরকারের লক্ষ্য! নাগরিক হিসাবে সেবা পাওয়া জনগণের অধিকার, এখন সেবা পেতে যদি বাধ্যতামূলক কর দেওয়া লাগে তাহলে স্বাধীন দেশে যেনো ‘টাকা দিয়ে ভাড়া থাকা!’
জননেত্রী শেখ হাসিনা অত্যন্ত বিচক্ষণ, তাই তিনি অবশ্যই করের বিষয়টি বিবেচনা করে শেষ পর্যন্ত বাদ দিবেন বলে আমরা আশা করছি।
লেখক: মোহাম্মদ আবু নোমান।