বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচনে কেউ বাধা দিলে তার বিরুদ্ধে ভিসা নিষেধাজ্ঞার যে হুমকি দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র সেটি নিয়ে এখন আলোচনা তুঙ্গে। নির্বাচনের আট মাস আগেই আমেরিকা কেন এ ধরণের হুঁশিয়ারি দিল?
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিতে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এসেছে স্নায়ুযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে। বৈদেশিক নীতির লক্ষ্য পূরণে একসময় ‘সামরিক হস্তক্ষেপ নীতি’ অনুসরণ করত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ঠান্ডাযুদ্ধের যুগে দেশটির সামরিক হস্তক্ষেপের বহু উদাহরণ আছে। কিন্তু ভূরাজনীতি ও ভূ-অর্থনীতির ক্রমবর্ধমান গুরুত্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ধীরে ধীরে সামরিক নীতি থেকে সরে আসে মার্কিন প্রশাসন। বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে স্বার্থ হাসিলে নতুন হাতিয়ার বেছে নেয় যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন প্রেসিডেন্টদের অস্ত্র হয়ে ওঠে ‘নিষেধাজ্ঞা’। নিশানায় থাকা দেশগুলোকে চাপে রাখতে ‘স্যাংশন’ হয়ে ওঠে প্রধানতম কৌশল।
পাবলিক রিঅ্যাকশনের সর্বশেষ খবর পেতে Google News অনুসরণ করুন
বর্তমান সময়ে চাপ প্রয়োগের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্ন ধরনের আদেশ-নিষেধের ফরমান জারি করে যদিও, কিন্তু দেশটির আসল অস্ত্র হলো ‘অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা’। আমেরিকার বৈদেশিক নীতির দিকে দৃষ্টি দিলে আমরা দেখতে পাব, আমেরিকার পররাষ্ট্রনীতিতে ক্রমবর্ধমানভাবে জায়গা করে নিচ্ছে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা। লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য পূরণে যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক নীতির তালিকায় যুক্ত হয়েছে অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা, বৈদেশিক সহায়তা হ্রাস, কাট-অফ (বিচ্ছিন্ন করা), রপ্তানি ও আমদানিতে সীমাবদ্ধতা আরোপ, সম্পদ ফ্রিজ (আটকে দেওয়া), শুল্ক বৃদ্ধি ও সর্বাধিক অপছন্দের দেশের (এমএফএন) বাণিজ্যিক মর্যাদা প্রত্যাহারের মতো বিষয়গুলো। এমনও ঘটে, যুক্তরাষ্ট্রের তরফ থেকে নেতিবাচক মন্তব্য করা হয় কিংবা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিপক্ষে ভোট বা ভেটো দেওয়া হয়। কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রত্যাহার, ভিসা অস্বীকৃতি, বিমান সংযোগ বাতিল এবং ঋণ, অর্থায়ন ও বিনিয়োগের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ—এজাতীয় বিষয়গুলো তো আছেই।
সাম্প্রতিক দশকে দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব বেড়েছে। এরূপ প্রেক্ষাপটে এই এলাকায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিতে পরিবর্তন আসবে—এটা সবার জানাই ছিল। বাস্তবে ঘটেছেও তাই। বিশেষ করে ভারত ও বাংলাদেশ মার্কিন নীতির পরিবর্তিত রূপের সাক্ষী। উদাহরণস্বরূপ, মানবাধিকার লঙ্ঘন ও অপহরণের অভিযোগে গত বছরের ১০ ডিসেম্বর বাংলাদেশের অভিজাত আধাসামরিক বাহিনী র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) এবং সংস্থাটির চলতি ও সাবেক সাত জন কর্মকর্তার ওপর কোনো ধরনের পূর্ব তথ্য বা ব্যাখ্যা ছাড়াই নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। নিষেধাজ্ঞায় বলা হয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সম্পত্তির মালিক হতে পারবে না র্যাব। কোনো মার্কিন সংস্থা বা কর্মীর সঙ্গে কোনো ধরনের আর্থিক লেনদেনও করতে পারবে না সংস্থাটি। এসব নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে বাংলাদেশ পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (নিষেধাজ্ঞার সময় মহাপরিদর্শকের চলতি দায়িত্বে ছিলেন) বেনজীর আহমেদসহ র্যাবের চলতি ও সাবেক সাত কর্মকর্তার যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে রেড অ্যালার্ট জারি করা হয়।
অন্যদিকে, ভারতের মুম্বাইভিত্তিক তিবালাজি পেট্রোকেম প্রাইভেট লিমিটেড মার্কিন নিষেধাজ্ঞার শিকারে পরিণত হয়। ইরানের সঙ্গে জ্বালানি তেলের ব্যবসা থাকার অভিযোগে এই নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। নিষেধাজ্ঞার ব্যাখ্যায় মার্কিন ট্রেজারি ডিপার্টমেন্ট জানায়, কোম্পানিটি ‘চীনে অব্যাহত চালান পাঠানোর’ অংশ হিসেবে লাখো ডলার মূল্যের জ্বালানি তেল কিনেছে। যা হোক, এটি ছিল কোনো ভারতীয় কোম্পানির বিরুদ্ধে প্রথম মার্কিন নিষেধাজ্ঞার ঘটনা। অবশ্য পরবর্তীকালেও রাশিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র কেনার জন্য মার্কিন নিষেধাজ্ঞার হুমকি পেয়েছে ভারত।
এখন প্রশ্ন হলো, সহযোগিতার এই যুগে দাঁড়িয়ে যুক্তরাষ্ট্র কেন এভাবে নিষেধাজ্ঞা আরোপের পথে হাঁটছে? এর সহজ উত্তর হলো, নিজের বৈদেশিক নীতির উদ্দেশ্যসমূহ সমুন্নত ও সামঞ্জস্যপূর্ণ রাখতেই এই পন্থা। আর এরই অংশ হিসেবে দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ দুই দেশের ওপর চাপ সৃষ্টি অব্যাহত রাখতে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা আরোপের অবতারণা। উল্লেখ করার মতো বিষয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দুই দেশের কারো বিরুদ্ধেই ‘কঠোরতম’ ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। এমনকি রাশিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র কেনার অভিযোগে ভারতের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞাও মওকুফ করে মার্কিন প্রশাসন। এর পেছনের কারণটাও অবশ্য স্পষ্ট—ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক স্বার্থ।
মূলত, নিষেধাজ্ঞার মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র একটি বিশেষ বার্তা দিতে চায়। কোনো একটি দেশের নির্দিষ্ট কোনো আচরণে মার্কিন প্রশাসন অসন্তুষ্ট হলে তার জবাবে ‘লাল সংকেত’ হিসেবে ব্যবহার করে ‘নিষেধাজ্ঞা’। আচরণগত আদর্শের হেরফের দেখলেই সেই দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ জুড়ে দেওয়া হয়। যেমন—গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন বা প্রতিষ্ঠার পথে বিঘ্ন সৃষ্টি করলে কোনো রাষ্ট্রকে অনিবার্যভাবে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়তে হয়। সামরিক শক্তি ব্যবহারের পথ থেকে সরে এসে নিষেধাজ্ঞার নীতি গ্রহণ করার আরেকটি বড় কারণ হলো আমেরিকার ধারণা ও বিশ্বাস—সামরিক হস্তক্ষেপ সর্বদাই ‘দৃশ্যমান বিষয়’; অন্যদিকে নিষেধাজ্ঞা আরোপ সুবিধাজনক ও ‘কম ব্যয়বহুল’।
বাস্তবিক অর্থে একবিংশ শতাব্দীর বিশ্বরাজনীতি নানা বৈচিত্র্যতায় পরিপূর্ণ। ‘নতুন মেরু’ আঁকার চেষ্টার মধ্য দিয়ে বিশ্বরাজনীতির গোটা মানচিত্রই নতুন করে আঁকার চেষ্টা চলছে। ঠিক এমন একটি সময়ে দাঁড়িয়ে বৈদেশিক নীতির প্রশ্নে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নতুন নতুন নীতি ও কৌশল গ্রহণ করবে এটাই স্বাভাবিক।
লেখক: সামারা আশরাত, গবেষক; পিএইচডি ফেলো, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, বুখারেস্ট বিশ্ববিদ্যালয়, রোমানিয়া।
আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে ভার্চুয়াল মতামত ও অন্যান্য ভিডিও পাবেন।
গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে সাথেই থাকুন।
Public Reaction একটি মতামতভিত্তিক সাইট।
মূলধারার সংবাদ এবং মতামত, প্রবন্ধ, গল্প, কবিতাসহ সৃজনশীল লেখা প্রকাশের একটি মুক্তমাধ্যম এটি। লিখুন আপনিও।
ইমেইল: opinion2mail@gmail.com, info@publicreaction.net