দুই মহিলার দুটি সন্তান ছিল। একজন বয়োজ্যেষ্ঠ অন্যজন কনিষ্ঠ। একদিন নেকড়ে এসে একটি বাচ্চা নিয়ে যায়। তখন প্রত্যেকেই বলল, তোমার বাচ্চা নিয়ে গেছে, যেটি আছে ওটি আমার বাচ্চা। বিষয়টি ফয়সালার জন্য ওই দুই মহিলা দাউদ (আ.)-এর কাছে এলো। উভয়ের কথা শুনে সুলাইমান (আ.) একটি ছুরি আনতে বলেন এবং বাচ্চাটাকে দুই টুকরা করে দুই মহিলাকে দিতে চাইলেন। তখন কনিষ্ঠ মহিলা বলল, আল্লাহ আপনাকে অনুগ্রহ করুন, বাচ্চাটি ওই মহিলার। তখন সুলাইমান কনিষ্ঠ মহিলার পক্ষে রায় দিলেন। এই হলো সত্যিকারের ‘মা’। যিনি সন্তানের জীবনের জন্য সন্তানকেও উৎসর্গ করতে পারেন।
শৈশবে আমরা পড়েছি-
মা কথাটি ছোট্ট অতি
কিন্তু জেনো ভাই
ইহার চেয়ে নাম যে মধুর
ত্রিভূবনে নাই।
মা। ছোট্ট একটি শব্দ। কিন্তু এর ব্যঞ্জনা, দ্যোতনা, প্রেরণা এতই গভীর যে, এ শব্দটি ধারণ করে হাসিমুখে প্রাণ দিতে এতটুকু দ্বিধা থাকে না প্রাণে। পৃথিবীতে এসে শিশু অবাক চোখে তাকিয়ে দেখে যে মানুষটি তাকে পরম মমতায় কাছে টেনে নেয় তিনিই হচ্ছেন মা। পৃথিবীর বহুল উচ্চারিত শব্দ মা। এ উচ্চারণের আবেদন বিশাল, বিরাট ও ব্যাপক। তাই আমরা দ্বিধাহীন বলতে পারি, ‘মা তোর বদন খানি মলিন হলে আমি নয়ন জলে ভাসি’। মা-সরলতার প্রতীক, বিশালতার দৃষ্টান্ত, ত্যাগের তীর্থভূমি, আস্থার মিনার। আবেগ, অনুভব, অনুভূতি ও অনুপ্রেরণার উৎসভূমি-মা।
পাবলিক রিঅ্যাকশনের সর্বশেষ খবর পেতে Google News অনুসরণ করুন
পৃথিবীর সবাই যখন দূরে সরে যায়, তখন মা দরদ মাখা কন্ঠে বলে-এই তো পাশে রয়েছি আমি’। পার্থিব উপন্যাসে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় বলেছেন, ‘মানুষ যখন ভয় পায়, যখন বিপদে পড়ে, যখন মনে হয় একা তখন ভয়ার্ত শিশুর মতো মাকেই আঁকড়ে ধরে।’ সন্তানের সাথে মায়ের যোগাযোগ টেলিপ্যাথিক –তাই জনপ্রিয় কথা সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ, মায়ের গায়ে একটা গন্ধ থাকে, ঘামে ভেজা হোক কিংবা কোনো সুগন্ধির হোক, সুনির্দিষ্ট একটা ঘ্রাণ। শুধু সন্তানরাই সে গন্ধ পায়।
মায়ের প্রতি ভালোবাসা চিরন্তন। অবিরাম। বহন নদীর মত। প্রাণের গভীর থেকে উৎসারিত হয়। কবি কালীদাসের মাতৃভক্তি কবিতায়-
বায়েজিদ বোস্তামী
শৈশব হতে জননীর সেবা করিতেন
দিবাযামী।
দুপুর রাত্রে জননী জাগিয়া
ডাকিলেন,’বাছাধন,
বড়ই পিয়াস পানি দাও’ বলি মুদিলেন
দু’নয়ন।
দেখিল বালক ঘরের কোণের কলসিতে
নেই পানি,
বহুদূর পথ ঝরনা হইতে কলসি ভরিয়া
আনি।
ইসলাম মাকে সর্বোচ্চ সম্মান দিয়েছে। তার মর্যাদাকে মহিমান্বিত করেছে। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেন, ‘আমি সঙ্গে (সদাচরণের) নির্দেশ দিয়েছি। তার মা কষ্টের পর কষ্ট ভোগ করে তাকে গর্ভধারণ করে। তার দুধ ছাড়ানো হয় দুই বছরে। সুতরাং আমার শোকরিয়া ও তোমার মা-বাবার শোকরিয়া আদায় করো।’ (সুরা লোকমান, আয়াত : ১৪)
আমাদের গ্রামীণ আটপৌরে জীবনের কেন্দ্রে থেকে আমাদের বৃ্ত্তের মাঝে বন্দী করে সন্ধি করেন, সখ্য গড়েন-মা। এ যেন অনবদ্য পদ্যের অনুপম কবিতা। তাই কবি আল মাহমুদের কন্ঠে শুনি-
কবিতাতো কৈশরের স্মৃতি। সে তো ভেসে ওঠা ম্লান
আমার মায়ের মুখ। নিম ডালে বসে থাকা হলুদ পাখিটি
পাতার আগুন ঘিরে রাতজাগা ছোট ভাই-বোন,
আব্বার ফিরে আসা, সাইকেলের ঘন্টাধ্বনি-রাবেয়া রাবেয়া-
আমার মায়ের নামে খুলে যাওয়া দক্ষিণের ভেজানো কপাট।
উনিশ শতকের বিশিষ্ট বাঙালি শিক্ষাবিদ, সমাজ সংস্কারক ও গদ্যকার ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর । তাঁর মাতৃভক্তি কিংবদন্তীর পর্যায়ে চলে গেছে- মাতৃভক্ত বিদ্যাসাগর খবর পেলেন মা অসুস্থ। মাকে দেখতে যাবেন। বড়কর্তার কাছে ছুটি চাইলেন। আবেদন নাকচ হলে চাকরি ছেড়ে দিলেন ঈশ্বরচন্দ্র। চাকরি বড় কথা নয়। আকাশ ঘন অন্ধকার। দামোদর নদীর তীরে পৌঁছে দেখলেন এই দুর্যোগের রাতে খেয়া নৌকা বন্ধ হয়ে গেছে। হ্যাঁ। তখন সাঁতরে পার হলেন অন্ধকার, উত্তাল দমোদর নদী।
পঞ্চম শ্রেণিতে বাংলা বইয়ের শুরুতে ছিল ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ সম্পর্কে লেখা। প্রথম পাঠ ছিলো ‘মাতা, মাতৃভাষা আর মাতৃভূমি প্রত্যেক মানুষের জন্য পরম শ্রদ্ধার বস্তু’। পরে অনুধাবন করেছি আসলেই তিনটি এক ও অভিন্ন সত্তা। এর যে কোন একটি আঘাত পেলে অন্যদুটিও অক্ষত থাকতে পারে না। তার তাই কবিগুরুর গানে আমরা পাই-
‘আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে কখন আপনি,
তুমি এই অপরূপ রূপে বাহির হলে জননী
ওগো মা তোমায় দেখে দেখে আঁখি না ফিরে’
অথবা নজরুলের গানে উঠে আসে-
শ্যামলা বরণ বাংলা মায়ের রূপ দেখে যা
আয়রে আয়
গিরি-দরী, বনে-মাঠে প্রান্তরে রূপ ছাপিয়ে যায়।
ম্যাক্সিম গোর্কির ‘মা’ এক অবিস্মরণীয় সৃষ্টি। সাধারণ এক নারী থেকে মা-এর এই অনন্য উত্তরণ বা বিবর্তন সময় ও সমাজের জীবন্ত ও জলন্ত বাস্তবতাকে পাঠকের সামনে উপস্থিত করে। মা-এর বুকভর্তি ভালোবাসার পরিচয় পাঠক ক্ষণে ক্ষণেই উপলদ্ধি করতে পারেন। সেই ভালোবাসাই মাকে রক্ত-মাংসের জীবন্ত চরিত্র রূপে পাঠকের সামনে হাজির করে। সেই ভালোবাসা প্রথমে কেন্দ্রিভূত ছেলে পাভলের প্রতি, তারপরে সেটি পরিব্যাপ্ত হয় পাভেলের সঙ্গী-সহযোদ্ধাদের প্রতি, তারপর তাদের সংগঠনের প্রতি, এবং সবশেষে দেশের প্রতিটি নির্যাতিত মানুষের প্রতি। এমন ভালোবাসাময়ী মায়ের সাথে বাঙালি পাঠকসমাজও পরিচিত বলেই তাদের কাছে এই চরিত্রটি বিশ্বাসযোগ্য বলে সবসময়ই প্রতীয়মান হয়েছে, এবং একই সঙ্গে হয়েছে গ্রহণযোগ্য।
সন্তান ও মায়ের ভালোবাসার নিবিড় যোগসূত্রে অনন্য উপমা, কবি নির্মলেন্দু গুনের ‘হুলিয়া’ কবিতায়।
আমি বাড়ির পেছন থেকে দরোজায় টোকা দিয়ে
ডাকলুম-‘মা’।
বহুদিন যে দরোজা খোলেনি,
বহুদিন যে দরোজায় কোন কন্ঠস্বর ছিল না,
মরচে-পরা সেই দরোজা মুহূর্তেই ক্যাচ্ ক্যাচ শব্দে খুলে গেলো।
বহুদিন চেষ্টা করেও যে গোয়েন্দা-বিভাগ আমাকে ধরতে পারেনি,
চৈত্রের উত্তপ্ত দুপুরে, অফুরন্ত হাওয়ার ভিতরে সেই আমি
কত সহজেই একটি আলিঙ্গনের কাছে বন্দী হয়ে গেলুম;
সেই আমি কত সহজেই মায়ের চোখে চোখ রেখে
একটি অবুঝ সন্তান হয়ে গেলুম।
মা। শব্দটির সৌন্দর্য্য অসাধারণ। অনবদ্য। অনন্য। তাই শুধু একটি নয়, প্রতিটি দিন হোক মায়ের জন্য উৎসর্গীকৃত।
কহিল জননী, ‘নয়নের মণি, সাধারণ শিশু নও,
খোদার দোয়ার বরকতে তুমি জগতপূজ্য হও।
লেখক: মাহবুবুর রহমান তুহিন; সিনিয়র তথ্য অফিসার, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়।
আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে ভার্চুয়াল মতামত ও অন্যান্য ভিডিও পাবেন।
গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে সাথেই থাকুন।
Public Reaction একটি মতামতভিত্তিক সাইট।
মূলধারার সংবাদ এবং মতামত, প্রবন্ধ, গল্প, কবিতাসহ সৃজনশীল লেখা প্রকাশের একটি মুক্তমাধ্যম এটি। লিখুন আপনিও।
ইমেইল: opinion2mail@gmail.com, info@publicreaction.net