শামছুল আলমের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে

::
প্রকাশ: ১ বছর আগে
ইনসেটে মরহুম আবুল হায়াত মুহাম্মদ শামছুল আলম।

তৎকালীন নোয়াখালী জেলার মহকুমা লক্ষ্মীপুর। লক্ষ্মীপুর মহকুমার অন্যতম থানা রায়পুর। সুজলা-সুফলা শস্য শ্যামলা বাংলার চৌষট্টি হাজার গ্রামের মধ্যে ছোট্ট একটি গ্রাম রায়পুরের দক্ষিণ দেনায়েতপুর। এই গ্রামে ১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন আবুল হায়াত মুহাম্মদ শামছুল আলম। মারা যান ২০০১ খ্রিষ্টাব্দের ২ এপ্রিল।

জগৎ সংসারে কিছু লোক আছেন, যাঁদের জীবনের ব্রুত হচ্ছে পরোপকার করা। তেমনি একজন শিক্ষানুরাগী শামছুল আলম চেয়ারম্যান। শৈশবকাল থেকেই শান্ত স্বভাবের সুদর্শন শামছুল আলম ছিলেন পরোপকারী। স্বপ্ন দেখতেন বড় হয়ে রায়পুরের মানুষের কল্যাণে কিছু করা। পিতা মৌলভী আজিজুর রহমান ও মাতা জয়নব বানুর দুই ছেলে সাত মেয়ের মধ্যে তিনি ছিলেন পঞ্চম। ভাই-বোন সবাই ছিলেন সুশিক্ষায় শিক্ষিত। ছোট ভাই খোরশেদ আলম ছিলেন জগন্নাথ কলেজের (বর্তমানে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়) রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক। শিক্ষানুরাগী শামছুল আলম রায়পুরে শিক্ষার আলো ছড়াতে একাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান (স্কুল-মাদ্রাসা), মসজিদ প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। রায়পুরের উন্নয়নে জনগণের বিপুল ভোটে নির্বাচিত রায়পুর ইউনিয়ন চেয়ারম্যান ছিলেন। তিনি শুধু শিক্ষানুরাগী ও জনপ্রিয় চেয়ারম্যান-ই ছিলেন না, ছিলেন ক্রীড়া ও সংস্কৃতিমনা সুকুমার মনোবৃত্তির একজন মানুষ। শুধু তাই নয় সৎ, সজ্জন, নির্লোভ, নিষ্ঠাবান, ত্যাগী এবং বিনয়ী ব্যক্তি হিসেবে সকল শ্রেণি-পেশার মানুষের কাছে ছিলেন সর্বজন শ্রদ্ধেয়।

রায়পুরের আলো-বাতাস এবং মাটিতে শৈশব ও বাল্যকাল কাটে শামছুল আলমের। বাড়ির কাছেই দেনায়েতপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় (আব্দুল্যা মৌলভী বাড়ি) থেকে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করেন। রায়পুর এল এম পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়াকালীন তিনি পিতার কর্মস্থল মাদারীপুর ইসলামিয়া হাই স্কুলে গিয়ে ভর্তি হন। এই স্কুল থেকেই ১৯৪৯ খ্রিষ্টাব্দে এনট্রান্স (মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট) পরীক্ষায় এবং ১৯৫১ খ্রিষ্টাব্দে নাজিমউদ্দিন কলেজ, মাদারীপুর থেকে ইন্টারমিডিয়েট (উচ্চ মাধ্যমিক সার্টিফিকেট) পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। প্রাচ্যের অক্সফোর্ড নামে খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন ১৯৫৩ খ্রিষ্টাব্দে ব্যাচেলর অব আর্টস (পাস কোর্স) বিভাগ থেকে প্রথম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হন।

গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে তিনি ফিরে আসেন নিজ এলাকায়। সরকারি-বেসরকারি কোনো প্রতিষ্ঠানে চাকরির চেষ্টা করেন নাই। ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজন শত বোঝানোর পরেও তিনি থেকে যান রায়পুরে। তৎকালীন রায়পুরে নারী শিক্ষার দুরাবস্থা তাঁকে ভাবিয়ে তোলে। এলাকার কিছু গুণী লোকের সহায়তায় ১৯৬৩ খ্রিষ্টাব্দে রায়পুর বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন একমাত্র রায়পুর পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় তিনি প্রধান ভূমিকা পালন করেন। সেই সাথে ওই স্কুলে অল্প কিছুদিন শিক্ষকতাও করেন। নিষ্ঠার সাথে জ্ঞান দান করেন প্রিয় ছাত্রীদের।

একটি মাত্র স্কুল প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা পালন করে তিনি ক্ষান্ত হননি। রায়পুরে শিক্ষার আলো ছড়াতে এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে এলাকার বিত্তবানদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে ভূমিকা রেখেছেন। তিনি ইংরেজি শিক্ষক ছিলেন। এল এম পাইলট মডেল উচ্চ বিদ্যালয়, রায়পুর মার্চ্চেন্টস একাডেমি, সায়েস্তানগর জনকল্যাণ বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন।

শামছুল আলম একজন শিক্ষানুরাগী ছিলেন শুধু তাই নয়, ছিলেন ধর্মভীরু মানুষ। কিন্তু ধর্মীয় কোনো গোড়ামি ও কুসংস্কার তাঁর মধ্যে ছিল না। ধর্মীয় অনুশাসন মেনে মানুষকে জীবনযাপনে উদ্বুদ্ধ করতেন ও পরামর্শ দিতেন। সকল ধর্মের মানুষকে তিনি ভালোবাসতেন। ধর্মীয় শিক্ষায় জ্ঞান প্রসারে তিনি ঢাকা-রায়পুর মহাসড়ক সংলগ্ন টি অ্যান্ড টি রোডে দেনায়েতপুর হাফেজিয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠায় অবদান রাখেন। ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের নামাজ আদায়ে ১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দে রায়পুর বাসস্ট্যান্ড জামে মসজিদ তাঁর হাতেই প্রতিষ্ঠা হয়। রায়পুরের ঐতিহ্যবাহী মসজিদে জামে আব্দুল্লাহ কমপ্লেক্সসহ বহু মসজিদ, মাদ্রাসা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সংস্কার ও পুনঃগঠন করেন।

তিনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়তে অগ্রণী ভূমিকা রাখার পাশাপাশি বহু প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা ও ম্যানেজিং কমিটির নেতৃত্বে ছিলেন। একজন আদর্শ শিক্ষক ও মানুষ গড়ার কারিগর হিসেবে সর্বত্র তাঁর সুনাম ছিল। শিক্ষকতাকে মহান পেশা হিসেবে বেছে নিলেও স্কুল থেকে কখনো বেতন নেননি। সম্পূর্ণ স্বেচ্ছাশ্রম হিসেবে ছাত্রছাত্রীদের মাঝে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিয়েছেন। এখনো সারা দেশে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আছেন তাঁর শত শত ছাত্রছাত্রী।

রায়পুরের ক্রীড়াঙ্গন ও সাংস্কৃতিতে তাঁর যথেষ্ট অবদান রয়েছে। একজন ক্রীড়া সংগঠক হিসেবে তৎকালীন সময়ে তরুণদের নিয়ে ক্লাব গঠন ও বিভিন্ন ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেছিলেন। ঈশা খাঁ এবং নবাব সিরাজউদ্দৌলা নাটকে প্রধান চরিত্রে তাঁর অসাধারণ অভিনয় প্রবীণদের মুখে এখনো শোনা যায়।

রায়পুর বাজারে একজন স্বনামধন্য ও আদর্শ ব্যবসায়ী হিসেবে ব্যাপক পরিচিতি ছিল। বাজারে তাঁর চাল, ডাল, আটা ও লবণের আড়ৎ ছিল। পরবর্তিতে তিনি কাপড়ের ব্যবসা করেন।

১৯৬৫ খ্রিষ্টাব্দে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে তৎকালীন রায়পুরে সাতটি ইউনিয়নের মধ্যে পাঁচটিতেই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের প্রার্থী বিজয়ী হয়ে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। তাঁরা হলেন ৩নং চরমোহনা ইউনিয়নে আমিন উল্লাহ বিএসসি, ৪নং সোনাপুর ইউনিয়নে তৌহিদ উদ্দিন চৌধুরী, পরবর্তিতে তিনি জেলা পরিষদের মেম্বার হন, ৫নং রায়পুর ইউনিয়নে শামছুল আলম, ৬ নং কেরোয়া ইউনিয়নে ইস্কান্দার আলী চৌধুরী এবং ৭ নং বামনী ইউনিয়নে আবদুল লতিফ।

শিক্ষানুরাগী ব্যক্তিত্ব, একজন আদর্শ শিক্ষক ও স্বনামধন্য ব্যবসায়ী পরিচিতি ছাড়াও সমাজসেবক হিসেবে সকল শ্রেণি-পেশার মানুষের কাছে ছিল শামছুল আলমের গ্রহণযোগ্যতা। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি হয়ে জনগণের সেবা করবেন এমন চিন্তা-ভাবনা কখনোই তাঁর ছিল না। তিনি ছিলেন সাধারণ একজন মানুষ। নিজ কাজে ও গুণাবলিতে সাধারণ মানুষের কাছে হয়ে উঠেছিলেন অসাধারণ এক ব্যক্তিত্ববান মানুষ। ১৯৬৫ খ্রিষ্টাব্দে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে এলাকার সাধারণ মানুষ তাদের উন্নয়নে বেছে নিয়েছিলেন শামছুল আলমকে। তিনি নির্বাচন করতে মোটেও প্রস্তুত ছিলেন না, এমনকি রাজিও হননি। কিন্তু সাধারণ মানুষের ভালোবাসা ও দাবির মুখে বাধ্য হয়েছিলেন নির্বাচন করতে। অসুস্থ হওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি ১৯৬৫-৭২ খ্রিষ্টাব্দ একটানা আটবছর এলাকার উন্নয়নে কাজ করেছেন।

উনিশ শ একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধকালীন ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানদের ইচ্ছায় অনিচ্ছায় পাকিস্তান সরকারের মুক্তিফৌজ বিরোধী শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান হতে হয়েছে। সেই সময় তিনি মুক্তিকামী বাঙালির পক্ষে একাত্মতা প্রকাশ করে বাড়ি থেকে অনত্র চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। খবর পেয়ে তৎকালীন রাজনৈতিক জেলা লক্ষ্মীপুর আওয়ামী লীগ সভাপতি অ্যাডভোকেট আক্তারুজ্জামান এবং রায়পুর আওয়ামী লীগ সভাপতি সাইফুল আলম ইত্তেহাদী গোপনে রাতের আধারে বাড়িতে আসেন। রায়পুরের মানুষকে পাকিস্তানীদের নির্মম অত্যাচার থেকে বাঁচাতে তাঁকে শান্তি কমিটিতে যোগ দিতে অনুরোধ করেন। তাঁদের অনুরোধে তিনি শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান হন এবং ক্যাম্পের সকল খবর গোপনে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে সময়মতো পৌঁছে দেন। রাজাকাররা অনেক মুক্তিযোদ্ধাকে ধরে মিলিটারি ক‍‍্যাম্পে আটকে রাখে, তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে আসেন। তাঁদেরই একজন মুক্তিযোদ্ধা দেওয়ান আবুল কাশেম। পাকিস্তান সরকারকে বৃদ্ধাঙ্গলি দেখিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করেন। এমন খবরে তৎকালীন রায়পুর মুসলিম লীগ ও জামায়াত ইসলামী দলের কতিপয় শীর্ষ নেতা তাঁকে পাকিস্তানী আর্মি ক্যাম্পে প্রবেশ নিষেধ ও সেপ্টেম্বর -অক্টোবরের দিকে শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান পদ থেকে বাদ দিয়ে দেন।

১০ ডিসেম্বর রায়পুর স্বাধীন হয়। পরের দিন ১১ তারিখ শামছুল আলম চেয়ারম্যানের নিরাপত্তায় অ্যাডভোকেট আক্তারুজ্জামান দালাল বাজার থেকে চারজন মুক্তিযোদ্ধা বাড়িতে পাঠান। তাঁদের মধ্যে ছিলেন কমান্ডার হারুন ভাই, রায়পুরের নুরুল ইসলাম আজুব, আব্দুর রব মিয়া, আলী আহমদ। কমান্ডার হারুন ভাই স্টেনগান নিয়ে সার্বক্ষণিক পাহাড়ায় ছিলেন। সকালে বিভিন্ন জায়গা থেকে দল বেঁধে মুক্তিযোদ্ধারা বাড়িতে এসে তাঁকে সালাম করে যান। তাঁদের মধ্যে সুবেদার আলী আকবর পাটোয়ারী ও তাঁর দল, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা তালেব, তৎকালীন ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের মধ্যে চেয়ারম্যান শহীদুল্লাহ বিএসসি, কমান্ডার নবী নেওয়াজ চৌধুরী বকুল, নাসের আরও অনেকে।

রায়পুরে শিক্ষার আলো ছড়াতে যে মানুষটি একাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন, অথচ কোনো একটি প্রতিষ্ঠানে স্মৃতি হিসেবে তাঁর নাম লিপিবদ্ধ নাই। জনপ্রিয় চেয়ারম্যান ছিলেন, তাঁর নামে একটি সড়কের নামকরণ করা হলেও রাস্তায় শুরুতে ও শেষে কোনো স্মৃতিফলক নাই। স্মৃতিফলক ও কাগজের পাতায় না থাকলেও রায়পুরের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে শিক্ষানুরাগী শামছুল আলম চেয়ারম্যানের নাম।

লেখক: মো. নবী আলম, সাংবাদিক।