রক্তের বাঁধন

::
প্রকাশ: ২ years ago
তিন ভাইয়ের ছবি। লেখক মাঝে।

প্রবাদ বাক্য আছে ‘ভাই বড় ধন রক্তের বাঁধন, যদিও পৃথক হয় নারীর কারণ’। যদি প্রবাদ বাক্যটি আবার এভাবে ঘুরিয়ে বলা হয় তবে কেমন হয়, ‘বোন বড় ধন রক্তের বাঁধন, যদিও পৃথক হয় স্বামীর কারণ’। ভাই-বোনের শত ঝগড়ার পরেও কখনও ভালোবাসা কমে না, আবার দূরে গেলে মিস করা কাছে থাকলেই ঝগড়া।

আমার দুই ভাই দুই বোন। আমিসহ মোট পাঁচজন। ভাই-বোনদের মধ্যে আমি সেজ। আমাদের সম্পর্কটা এমন, দূরে গেলে মিস করি কাছে থাকলেই ঝগড়া। ছোটবেলাতে আমরা ভাই-বোনেরা খুব ঝগড়া করতাম। তাই বলে আমরা ঝগড়াটে ছিলাম না। যা আমাদের ভাই-বোনদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকত। প্রতিবেশীদের কাছে আমরা ছিলাম সুবোধ বালক-বালিকা। বাহির থেকে কখনো বাবা-মায়ের কাছে নালিশ আসত না।

আমার বড় ভাই মঞ্জুর আক্তার। সহপাঠী ও বন্ধুরা মঞ্জুর নামে ডাকে। পরিবারের সবাই ও আত্মীয়-স্বজন প্রতিবেশীরা বাবু বলে ডাকে। বড় বোন শাহীনা আক্তার বেবী। ছোট ভাই খোরশেদ আলম, সবার ছোট বোন নওরীন আফরোজ রানু। ছোট বোন বয়সে আমার চেয়ে ২০ বছরের ছোট। সবার ছোট তাই খুব আদরের। বড় ভাই, বড় বোন ও আমার গায়ের রঙ মায়ের মতো। তবে বড় ভাই একটু কালো, তবে মিচমিচে নয়। ছোট ভাই ও বোন বাবার রঙ পেয়েছে। একবারে দুধে আলতা। তবে বয়স বাড়ার সাথে সাথে ওদেরও গায়ের রঙে আগের চেয়ে একটু লাবণ্যতা কমেছে।

বড় ভাই ও বোন দু’জনেই মেধাবী স্টুডেন্ট ছিলেন। স্কুল জীবনে সব সময় রোল এক থেকে পাঁচ এর মধ্যে ছিল। দু’জনেই বিজ্ঞান বিভাগে পড়েছেন। বি.এসসি-তে ফিজিক্স, কেমেস্ট্রি ও গণিত ছিল। মাস্টার্সে গণিত নিয়ে পড়েছেন। আমিও মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকে বিজ্ঞানের ছাত্র ছিলাম। স্নাতকে প্রথমে বি.এসসি-তে ভর্তি হলেও পরে আর্টসে ভর্তি হই। সেটা আরেক ইতিহাস। সবশেষ মাস্টার্সে ইসলামের ইতিহাস নিয়ে পড়ি। আমদের কলেজে আমার ভর্তি হওয়ার আগে মাস্টার্স ছিল না। আমিই প্রথম ব্যাচ।

মাস্টার্সে ভর্তি হতে গেলাম। বিভাগীয় প্রধান আমিসহ আরও কয়েজন ছাত্রের ভর্তি নিবেন না। শুরু করে দিলাম গ্যাঞ্জাম, হৈ-হল্লোড়। স্যারকে বললাম, আমরা এই কলেজের ছাত্র, আন্দোলন করে কলেজে আমরা মাস্টার্স চালু করেছি। আগে আমাদের অধিকার, তারপর অন্য ছাত্রদের। সবার ভর্তি স্থগিত হয়ে গেল। পরে অন্যদের ভর্তি নিলেও আমাকে নিল না। কারণ আমি গেনজাম ও হৈহল্লোর করেছি, বেঞ্চ ভেঙেছি ইত্যাদি ইত্যাদি। এখন উপায়! বড় ভাই। ভাইকে বললাম এই ব্যাপার, কি করা যায়। বড় ভাইও এই কলেজের ছাত্র ছিলেন। উনার বন্ধু সার্কেল বেশ বড়। ভাইয়ের এক সিনিয়র ভাই (বিসিএস ক্যাডার পুলিশ) উনারই বন্ধু ইসলামের ইতিহাস ডিপার্টমেন্টের শিক্ষক। ভাই তাঁর সিনিয়র ভাইকে বললেন ছোট ভাইকে ভর্তি করাতে হবে। উনি তাঁর বন্ধুকে বলে ভর্তি করিয়ে দিলেন। বড় ভাই ছিল বলেই সেদিন ভর্তি হতে পেরেছিলাম।

বড় ভাই বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। কোম্পানি ও কাজকে ভালোবেসে সততা ও নিষ্ঠার সাথে পরিশ্রম করেন। ২৩ সেপ্টেম্বর ২০০৬ খ্রিষ্টাব্দে ফাতেমা সুলতানা মিনুর সাথে ভাইয়ের বিয়ে হয়। প্রথম কন্যা সন্তান স্ত্রীর গর্ভেই মারা যায়। দ্বিতীয় পুত্র সন্তান তালহা তাসনীম ত্ব-হার জন্ম ২৬ জানুয়ারি। এর কয়েক বছর পর ১৪ আগস্ট কন্যা সন্তান মাইশা মঞ্জুর অন্তিক জন্ম গ্রহণ করে। স্ত্রী, পুত্র, কন্যা নিয়ে বড় ভাইয়ের ছোট পরিবার।

আমি তখন ক্লাস ফাইভে। ক্লাস টিচার একটি গল্প সংক্ষিপ্ত করে লিখে পরের দিন সবাইকে আনতে বলেন। আমার বড় বোন তখন ক্লাস নাইনে। বোনকে বিষয়টি বললে তিনি খুব সংক্ষিপ্ত করে লিখে দেন। পরের দিন ক্লাস টিচার দেখে খুব প্রশংসা করেন। যা আজও আমার মনে আছে, থাকবেও চিরকাল। আমার বোন অসুস্থ হয়ে ঢাকা সিএমএইচ-এ অনেক দিন ভর্তি ছিলেন। মাঝে মাঝে বোনকে দেখতে যেতাম। আম্মা বাসা থেকে ভালো ভালো খাবার রান্না করে টিফিন বক্সে দিয়ে দিতেন। বড় বোন সেদিন খুব খুশি হতেন। দুপুরে আমরা একসাথে বসে মায়ের হাতের রান্না খেতাম। চলে আসার সময় বোনের মনটা খারাপ হয়ে যেত। আমরাও অপেক্ষা করতাম বোন কবে সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরবে।

বড় বোনের লক্ষ্য ছিল শিক্ষক হবেন। তাও গ্রামের কোনো স্কুলে। বি.এসসি পরীক্ষার রেজাল্টের পর বিজ্ঞাপন দেখে গ্রামের এক স্কুলে শিক্ষক পদে ইন্টারভিউ দিলেন। জীবনে প্রথম ইন্টারভিউ, মেধা তালিকায় প্রথম হলেন। যোগদানের অফার পেলেন। ১৯৯৫ সালের ১২ অক্টোবর যোগদান করলেন। অল্প কিছু দিনেই কোমলমতি ছাত্রীদের প্রিয় শিক্ষক হয়ে উঠলেন। স্কুলের ছাত্রীদের ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে জীবনে কোথাও চাকরির চেষ্টা করেননি। আমার বড় বোন এতটাই মেধাবী ছিলেন চেষ্টা করলে আরও ভালো কিছু করতে পারতেন। একই স্কুলের শিক্ষক মো. রেজাউল করিমের সাথে বোনের বিয়ে হয়। বোনের প্রথম কন্যা সন্তান সুমাইয়া তাবাসসুম নান্মীর জন্ম ২০ আগস্ট, দ্বিতীয় সন্তান খান মো. রেদওয়ান সুপ্তর জন্ম ৯ ডিসেম্বর। দুই সন্তানদের জননী হলেও ভাই- বোনদের প্রতি ভালোবাসা ও মায়ার টান সেই আগের মতোই আছে।

ছোট ভাই একেবারে সহজ-সরল। কিছুটা ভীতু, সেইসাথে বোকাও বটে। ছোট ছেলে মায়ের খুব আদরের। বারো বছর বিদেশ থেকেও কিছু করতে পারে নাই। ২২ সেপ্টেম্বর ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দে দেশে ফিরে আসে। এখনও বেকার। মা এ নিয়ে সারাদিন চিন্তা করেন। আমার কাছেই থাকে। ঘরেই থাকে, বাইরে তেমন বের হয় না। আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতেও যায় না। এটা ওটা বলে, তা শুনতে ওর ভালো লাগে না। মাঝে মাঝে আমিও বিরক্ত হই। রাগারাগি করি। ছোট ভাই এতে খুব কষ্ট পায়, মায়ের রুমে গিয়ে মন খারাপ করে বসে থাকে। আমি সব বুঝি। আমারও কষ্ট হয়, বুক ফেটে যায়। তবে বুঝতে দেই না। কত মানুষের চাকরি দিয়েছি, অথচ নিজের ভাইকে কোথাও দিতে পারছি না। কয়েক জায়গায় কথাও বলেছি, লাভ হয়নি। মাঝে মাঝে রাগ করি তাই দুঃশ্চিন্তা করে। কিছু হয় নাই, কাল হবে-ইনশাআল্লাহ।

ছোট ভাইয়ের খুব ইচ্ছা ছিল, বিদেশে যাওয়ার। বিদেশে গিয়ে অনেক অর্থ রোজগার করবে। দেশে এসে বাড়ি করবে। সবাই বাড়িতে একসাথে থাকবে। দৌড়াদৌড়ি করে মালয়েশিয়া পাঠালাম। ২০০৭ খ্রিষ্টাব্দের ২৫ সেপ্টেম্বর ফ্লাইট। শাহজালালাল বিমানবন্দরে সাথে করে নিয়ে গেলাম। বড় ভাই তখন ময়মনসিংহ থাকেন। বিমানবন্দরে পৌঁছতে পৌঁছতে ততক্ষণ ছোট ভাই বিমানে উঠে গেছে। দেখা হলো না বড় ভাইয়ের সাথে। বিমান আকাশে উড়ছে দুই ভাইয়ের চোখ দিয়ে ঝরঝর করে পানি ঝরছে। মনে হলো চিরদিনের জন্য হারালাম, কোনো দিন আর দেখা হবে না। বুকটা ফেটে চৌচির হয়ে গেল। বাসায় ফিরে সবার মন খারাপ। ছোট ভাইকে ছাড়া ঈদ। ঘরে সবাই কান্নাকাটি।

সবচেয়ে আদরের ছোট বোন। ফুটফুটে সুন্দর, তুলতুলে গাল। মিষ্টি মুখের হাসি। ছোট ছোট পায়ে সারা ঘরে দৌড়াদৌড়ি। মাতিয়ে রাখে আমাদের সব ভাই-বোনকে। সিঁড়ির সবাই আদর করত। কে কার আগে কোলে তুলে নিবে, এ নিয়ে চলত পাল্লাপাল্লি। দিন দিন বড় হতে লাগলো। অভিমান করা শিখলো, রাগটাও বেড়ে গেল।

ছোট বোন হয়েছে। নাম রাখতে হবে। তিন ভাই ও বোন মিলে সিদ্ধান্ত নিলাম আমরা নাম রাখব। বাবা-মাকে নাম রাখতে দিব না। খাতা-কলম নিয়ে বসলাম। কি নাম রাখা যায়। নাম হতে হবে আধুনিক। আমরা তো কালো, বোন তো ফর্সা। তাই গায়ের রঙের সাথে মিলিয়ে সুন্দর একটি নাম রাখা চাই। বড় বোন ভেবে চিন্তে ঠিক করলেন নাম হবে নওরীন আফরোজ। বোন বললেন এতে আধুনিকতার ছোঁয়া আছে। গায়ের রঙের সাথেও যায়। সিদ্ধান্ত ফাইনাল নাম নওরীন আফরোজ। বাবা বললেন ঠিক আছে ফাইনাল। আমিও একটি রাখতে চাই, তবে ছোট করে। সবাই বললাম কি নাম। তিনি বললেন রানু। এটি হবে ডাক নাম। সেদিন থেকে ছোট বোনের নাম হয়ে গেল নওরীন আফরোজ রানু।

বোন আমার ছোটকাল থেকেই ঘর অগোছালো দেখতে পারে না। ঘর গোছালো থাকলেও বাইরে থেকে ফিরে নিজে আবার গুছিয়ে রাখবে। রাষ্ট্র বিজ্ঞানে মাস্টার্ষ শেষ করার পর ২০১২ খ্রিষ্টাব্দের ২০ জানুয়ারি বিয়ে হয় মো. রফিকুল ইসলাম ইকবালের সাথে। একমাত্র সন্তান রাহিল আবরার রামিন। জন্ম ১৭ মার্চ। ওরা এখন ঢাকা থাকে। সেখান থেকেও প্রায় প্রতিদিন আমাদের ঘর কীভাবে সাজানো আছে, ডাইনিং টেবিলটা কোনদিকে, ওয়েরড্রপ কোথায়, বিছানার চাদর কি কালার ভিডিও কলে মনিটরিং করে। ফোনে প্রায় প্রতিদিন কথা হয়, ভিডিও কলে দেখাও হয়। তাই ঢাকায় বেশি যাওয়া হয় না। বাসায় গেলে তো পাগল হয়ে যায়, কি খাওয়াবে, কি রান্না করবে। অস্থির হয়ে যায়। আমার ডায়কেটিক, বেশি খেতে পারি না। খাওয়ার টেবিলে নানা পদের তরকারি থালা-বাটি সাজিয়ে পাশে বসে জোর করে সব খাওয়াবে। পাগলি বোন আমার। যখন চলে আসি যতদূর দেখা যায় তাকিয়ে দেখে। বোনটি খুবই সরল, মুখে সর্বক্ষণ হাসি লেগেই থাকে।

ভাই-বোনদের ভালোবাসার এ বন্ধন এভাবেই চিরকাল থাকবে অটুট। বংশপরম্পরায় যুগ যুগ ধরে রক্তের এ বাঁধন যাবে না কভু ছিঁড়ে।

লেখক: মো. নবী আলম, সাংবাদিক।