মুসলিম উম্মাহর দরজায় কড়া নাড়ছে পবিত্র রমজান মাস। বেশি দিন বাকি নেই; আর মাত্র কয়দিন পরেই মহান রাব্বুল আলামিন আল্লাহ তাআলার- রহমত, বরকত, মাগফেরাত ও নাজাতসহ অনেক কল্যাণের মাস রমজানুল মোবরক শুরু হবে।
রমজানের অবিরত বরকত ও কল্যাণ পেতে হলে আগে থেকেই যথাযথ প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে। কেননা যেকোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজের ভালো প্রস্তুতি মানেই ওই কাজটির অর্ধেক পূর্ণতা ও সফলতা অর্জিত হয়ে যায়।
আর এ জন্য বরকত ও কল্যাণের গুরুত্বপূর্ণ মাস রমজানের বেশকিছু আগাম প্রস্তুতি রয়েছে। মুমিন মুসলমানের জন্য যে প্রস্তুতি পুরো রমজানজুড়ে রহমত বরকত মাগফেরাত নাজাত ও যাবতীয় কল্যাণের দরজা উন্মুক্ত রাখবে।
পাবলিক রিঅ্যাকশনের সর্বশেষ খবর পেতে Google News অনুসরণ করুন
তবে সাধারণত মানুষের প্রস্তুতি দেখলে মনে হয়- রমজান শুধু ভোগের মাস। ভালো খাওয়ার মাস। পণ্য মজুদের মাস। আনন্দ-উৎসবের মাস। ব্যবসা-বাণিজ্যের মাস। না আসলেই তা নয়, বরং রমজান হলো ত্যাগের মাস। রমজান ইবাদত-বন্দেগির মাস। আল্লাহর রহমত বরকত মাগফেরাত নাজাত ও যাবতীয় কল্যাণ লাভের মাস।
পারে। তাই রমজানের আগে শাবান মাসের এ সময়ে কাজ রোজা আদায় করে নেয়া। এতে দুইটি ভালো আমল বাস্তবায়িত হবে-
প্রথমটি : বিগত জীবনের কাজা রোজা আদায় হবে। রমজানের রোজা পালনের প্রতি আগ্রহ বাড়বে।
দ্বিতীয়টি : সুন্নাতের অনুসরণ হবে। রমজানের আগের মাস শাবানে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বেশি বেশি নফল রোজা রাখতেন। রমজানের প্রস্তুতি গ্রহণ করতে। কাজা রোজা আদায় করার মাধ্যমে সুন্নাতের অনুসরণও হয়ে যাবে।
সাধারণ ক্ষমা পাওয়ার চেষ্টা করা: আল্লাহ তাআলা রমজান মাসে অনেক মানুষকে জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্তি দিয়ে থাকেন। তবে এ সাধারণ ক্ষমা সবার ভাগ্যে জুটে না। কেননা এ ক্ষমা পেতে হলে দুইটি কাজ থেকে বিরত থাকতে হবে। ক্ষমা প্রার্থনা করে তা থেকে ফিরে আসতে হবে। তা হলো-
(১) শিরক থেকে মুক্ত থাকা। আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শিরক না করা। কেউ ইচ্ছা কিংবা অনিচ্ছায়, ছোট বা বড় শিরক করে থাকলে রমজান আসার আগেই তা থেকে তাওবাহ-ইসতেগফারের মাধ্যমে ফিরে আসা।
(২) হিংসা থেকে মুক্ত থাকা। কারো প্রতি কোনো বিষয়ে হিংসা না করা। কারণ হিংসা মানুষের সব নেক আমলকে সেভাবে জ্বালিয়ে দেয়; যেভাবে আগুন কাঠকে জ্বালিয়ে দেয়। তাই হিংসা পরিহার করে মনকে ক্ষমা লাভে স্বচ্ছ রাখা।
ইবাদতের জন্য সময়কে বরাদ্দ করা:-
রমজানে সময়কে গুরুত্ব দেওয়া একজন মু’মিন ব্যক্তির পরিচয়। অন্যান্য ১১ মাস সময়কে অবহেলায় কাটিয়ে দিলে ও রমজানকে যথাযথ গুরুত্ব দিতে হবে। তাহাজ্জুদ নামাজের অভ্যাস গড়তে হবে, কুরআনের বেশি বেশি তেলোয়াত করতে হবে, ফরযের পাশাপাশি সুন্নাত ও নফল ইবাদাতের প্রতি মনোনিবেশ করতে হবে।
ফরজ রোজার নিয়মকানুন জেনে নেয়া: রমজান মাস আসার আগে রোজা পালনের মাসআলা-মাসায়েল তথা নিয়ম-কানুনগুলো ভালোভাবে জেনে নেয়া জরুরি। আর তাতে রমজানের রোজা নষ্ট হওয়া থেকে বা মাকরুহ হওয়া থাকে বা অন্যান্য বিষয়গুলো জেনে নেয়ার সর্বাত্মক চেষ্টা করা।
বিগত রমজানের অসমাপ্ত কাজ চিহ্নিত করা: রমজান মাস আসার আগে বিগত রমজানের নেক আমলগুলো করতে না পারার কারণগুলো খুঁজে বের করার চেষ্টা করা। যেমন-
> কেন নিয়মিত কোরআন অধ্যয়ন করা হয়নি?
> কেন তারাবিহ পড়া হয়নি?
> কেন দান-সহযোগিতা করা হয়নি?
> কেন ইতেকাফ করা হয়নি?
> কেন রোজাদারকে ইফতার করানো হয়নি?
> কেন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ জামাতের সঙে আদায় করা সম্ভব হয়নি?
> কেন কোরআন-সুন্নার আলোচনায় বসা হয়নি?
> কেন রমজানের পরিবারের লোকদের হক আদায় করা হয়নি?
> কেন রমজানের পরিবারের লোকদের হক আদায় করা হয়নি?
> কেন রমজানের পাড়া-প্রতিবেশী বা আত্মীয়দের হক আদায় করা হয়নি?
উক্ত বিষয়গুলো চিহ্নিত করে নেয়া। এ বছর রমজান আসার আগে আগে চিহ্নিত কারণগুলো থেকে নিজেকে বিরত রেখে কিংবা প্রস্তুতি গ্রহণ করে কল্যাণকর সব নেক আমলগুলো করার প্রস্তুতি গ্রহণ করা।
শাবান মাসজুড়ে রমজানের মহড়া চালু রাখা: রমজান মাসের বেশি বেশি ইবাদত করতে এবং রোজা রাখার জন্য শাবান মাসে বেশি বেশি নফল রোজা রাখা। বেশি বেশি কোরআন অধ্যয়ন করা। নফল নামাজ পড়া। তাওবাহ-ইসতেগফার করা। ত্যাগের মানসিকতা তৈরি করা। দান-সাদকাহ শুরু করা। যাতে এ মহড়ার বাস্তবায়ন পুরো রমজানজুড়ে সুন্দরভাবে চালানো যায়।
রমজানের ২৪ ঘণ্টার রুটিন করা: রমজান মাসজুড়ে যে যেই কাজেই থাকুক না কেন, পুরো সময়টি কোন কোন কাজে কীভাবে ব্যয় হবে তার একটি সম্ভাব্য রুটিন তৈরি করে নেয়া। আগাম রুটিন থাকলে রমজানে চরম ব্যস্ততার মাঝেও নেক আমলসহ অন্যান্য কাজগুলোও ইবাদতের মধ্যেই কেটে যাবে। এক কথায় সব কাজের তালিকা করে নেয়া।
রমজানের চাঁদের অনুসন্ধান করা: শাবান মাসের ২৯ তারিখ সন্ধ্যায় চাঁদের অনুসন্ধান করা সুন্নাত। মুছে যাওয়ার পথে থাকা এ সুন্নাতটিকে আবারও জীবিত করার পূর্ব পরিকল্পনা গ্রহণ করা।
বর্তমান সময়ে চাঁদ দেখা (হেলাল) কমিটির দিকে তাকিয়ে থাকা রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। আবার অনেকে মোবাইল বা রেডিও টিভির সংবাদের অপেক্ষা করেন। এতে চাঁদ দেখা এবং দোয়া পড়ার সুন্নাতটি থেকে বঞ্চিত হয় মুমিন মুসলমান। তা থেকে বেরিয়ে এসে চাঁদ অনুসন্ধান করার সুন্নাতটি জীবিত করার সর্বাত্মক পূর্ব প্রস্তুতি রাখা।
> যারা রহমতের মাস রমজানের নতুন চাঁদ দেখবে তারা বিশ্বনবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পড়া সেই দোয়াটিও পড়বে। যেখানে শান্তি ও নিরাপত্তার প্রার্থনা রয়েছে। হাদিসে এসেছে-
হজরত তালহা ইবনু ওবায়দুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন নতুন চাঁদ দেখতেন তখন বলতেন-
اَللهُ اَكْبَرُ اَللَّهُمَّ أَهِلَّهُ عَلَيْنَا بِالْأَمْنِ وَ الْاِيْمَانِ وَالسَّلَامَةِ وَ الْاِسْلَامِ وَ التَّوْفِيْقِ لِمَا تُحِبُّ وَ تَرْضَى رَبُّنَا وَ رَبُّكَ الله
উচ্চারণ : আল্লাহু আকবার, আল্লাহুম্মা আহিল্লাহু আলাইনা বিল আমনি ওয়াল ঈমানী ওয়াস্সালামাতি ওয়াল ইসলামি ওয়াত্তাওফিকি লিমা তুহিব্বু ওয়া তারদা রাব্বুনা ওয়া রাব্বুকাল্লাহ।
অর্থ : আল্লাহ মহান, হে আল্লাহ! এ নতুন চাঁদকে আমাদের নিরাপত্তা, ঈমান, শান্তি ও ইসলামের সঙ্গে উদয় কর। আর তুমি যা ভালোবাস এবং যাতে তুমি সন্তুষ্ট হও, সেটাই আমাদের তাওফিক দাও। আল্লাহ তোমাদের এবং আমাদের প্রতিপালক।’ (তিরমিজি, মিশকাত)
> রমজানের চাঁদ দেখার খবর শুনেই হৃদয়ের গভীর থেকে আল্লাহর কাছে মুমিনের আকুতিভরা প্রার্থনা হবে এমন-
اللَّهُمَّ سَلِّمْنِي لرمضان، وسلم رمضان لي، وتسلمه مني مُتَقَبَّلاً
উচ্চারণ : ‘আল্লাহুম্মা সাল্লিমনি লিরমাদান, ওয়া সাল্লিম রামাদানা লি, ওয়া তাসলিমাহু মিন্নি মুতাক্বাব্বিলা।’ (তাবারানি)
অর্থ : হে আল্লাহ! আমাকে শান্তিময় রমজান দান করুন। রমজানকে আমার জন্য শান্তিময় করুন। জন্য রমজানকে শান্তিময় করে দিন। রমজানের শান্তিও আমার জন্য কবুল করুন।
বেশি বেশি দোয়া: রমজানের আগে আল্লাহর কাছে এ প্রার্থনা করা। হে আল্লাহ! আমি যতই চেষ্টা করি, তোমার তাওফিক বা ইচ্ছা না থাকলে আমি যেমন রমজান পাবো না। আবার রমজান পেলেও বরকত লাভে সক্ষম হবো না। সুতরাং রমজান ও রমজানের নেক আমল করার তোমার কাছে চাই।
রমজানের স্মরণীয় দিবস গুলোকে যথাযথ মর্যাদায় পালন করা।
রমজানে অনেক গুলো স্মরণীয় দিবস রয়েছে। ইবাদতের নিয়্যাতে সেগুলো পালন করা ঈমানদারের পরিচয় ও বটে।যেমন:-
১ রমজান হুজুর গাউছে পাক শাহেনশাহে বাগদাদ শাহবাজে লামাকানী আব্দুল কাদের জিলানী (র:)’র শুভ বেলাদত শরীফ।
৩ রমজান রাসূলে পাক সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কন্যা মা-ফাতিমাতুজ্জহারা রাদিআল্লাহু তাআ’লা আনহার ওফাত দিবস।
১০ রমজান উম্মুল মু’মিনিন মা-খাদিজাতুল কোবরা রাদিআল্লাহু তাআ’লা আনহার ওফাত দিবস।
১৭ রমজান ইসলামের প্রথম যুদ্ধ তথা বদর দিবস।
২১ রমজান ইসলামের চতুর্থ খলিফা মুশকিল কোশা মওলা আলী রাদিআল্লাহু তাআ’লা আনহুর শাহাদাত দিবস।
হে আল্লাহ! রমজানে যত মানুষ সৌভাগ্যবানদের কাতারে নাম লেখাবে, তাদের কাতারে আমাকেও শামিল করো; হে রাব্বুল আলামিন!
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে রমজানের আগে উল্লিখিত প্রস্তুতিগুলো যথাযথভাবে নিজেদের জীবনে বেশি বেশি করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
লেখক: হাফেজ মাওলানা আবু সায়েম মুহাম্মদ কাইয়ুম ফারুকী, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট।
খতিব, বায়তুন নুর জামে মসজিদ।১৭ নং ওয়ার্ড,পশ্চিম বাকলিয়া,সৈয়দ শাহ রোড, চকবাজার, চট্টগ্রাম।
বি.এ (অনার্স), এম.এ (মাস্টার্স) আরবি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে ভার্চুয়াল মতামত ও অন্যান্য ভিডিও পাবেন।
গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে সাথেই থাকুন।
Public Reaction একটি মতামতভিত্তিক সাইট।
মূলধারার সংবাদ এবং মতামত, প্রবন্ধ, গল্প, কবিতাসহ সৃজনশীল লেখা প্রকাশের একটি মুক্তমাধ্যম এটি। লিখুন আপনিও।
ইমেইল: opinion2mail@gmail.com, info@publicreaction.net