আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে নেয়া ঋণ অর্থনীতিতে কতখানি স্বস্তি দেবে তা নিয়ে রীতিমতো সন্দেহ প্রকাশ করেছেন দেশের অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকরা।
তারা বলেছেন, আইএমএফ ঋণ ভোগ করবে সরকার, কিন্তু ঋণের দায় শোধ করবে দেশের জনগণ। এই শোধ করার কাজটি ইতোমধ্যে শুরু করে দেয়া হয়েছে। ভর্তুকি কমানোর জন্য এরই মধ্যে দেশে জ্বালানি তেল, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বৃদ্ধি করা হয়েছে। চলতি বছরে বিদ্যুতের দাম তিন দফা বাড়ানো হয়েছে। আগামীতে আরো বাড়ানো হবে বলা হয়েছে। এর ফলে দেশে মূল্যস্ফীতি বেড়ে গেছে। জিনিসপত্রের দামও অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। সাধারণ মানুষ ভোগান্তিতে পড়েছে।
পাবলিক রিঅ্যাকশনের সর্বশেষ খবর পেতে Google News অনুসরণ করুন
তারা আরো বলেছেন, আইএমএফ বলেছে, চলতি বছরই কর-জিডিপির অনুপাত বৃদ্ধি করতে হবে। এখন দেখতে হবে এই বাড়ানোর কাজটি সাধারণ জনগণের ওপর চাপিয়ে দিয়ে বাড়ানো হচ্ছে কিনা। এই সঙ্কটকালে অর্থমন্ত্রীকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না বলে তারা অভিযোগ করেন।
শনিবার ভার্চুয়াল প্লাটফর্মে আয়োজিত এক ওয়েবিনারে বক্তারা এ কথাগুলো বলেন। ফোরাম ফর বাংলাদেশ স্টাডিজ আয়োজিত ‘আইএমএফ’র ঋণ ভোগ করবে কে, পরিশোধ করবে কে?’-শীর্ষক এই ওয়েবিনারে সঞ্চালক ছিলেন প্রবাসী সাংবাদিক মনির হায়দার।
প্রসঙ্গত, অর্থনৈতিক পরিস্থিতি উন্নয়নের জন্য সরকার আইএমএফের দ্বারস্থ হলে সংস্থাটি গত ফেব্রুয়ারি মাসে সাড়ে চার বিলিয়ন ডলার ঋণ অনুমোদন করে। এই ঋণটি দেয়া হবে তিন বছর ধরে। ঋণের প্রথম কিস্তি ৪ কোটি ৫০ লাখ ডলার ইতোমধ্যে ছাড়ও করা হয়েছে। ঋণের জন্য আইএমএফের পক্ষ থেকে বেশ কয়েকটি শর্ত দেয়া হয়েছে।
আলোচনায় অংশ নিয়ে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ও আইএমএফ ঢাকা অফিসের সাবেক ডিভিশন চিফ আহসান এইচ মনসুর বলেন, দেশে অনেক দিন ধরেই নীতিগত বিষয়গুলো ঠিক করা হয়নি। দেশ থেকে টাকা পাচার হয়েছে কিন্তু তা দেখা হয়নি। সব কিছুই নিয়ন্ত্রণ করছে হাতেগোনা কয়েকটি শিল্পগোষ্ঠী। তারাই সুদের হার হ্রাসের সবচেয়ে বড় সুবিধাভোগী।
মনসুর অভিযোগ করেন, ব্যাংক ঋণের সুদহার বেঁধে রাখার কারণে ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো কাক্সিক্ষত হারে ঋণ পাচ্ছে না। বড়রা সব পেয়ে যাচ্ছে, তাও আবার কম সুদে। সব দিক থেকেই তারা লাভবান হচ্ছে। তেল, চিনি থেকে শুরু করে আমদানি পণ্যের দাম বাড়লেও তারা লাভবান হচ্ছে। এভাবে বড়রা লাভবান হওয়ার কারণে সমাজে যেমন বৈষম্য সৃষ্টি হচ্ছে, তেমনি সামগ্রিকভাবে অর্থনীতির ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। একটি শ্রেণীর হাতে অর্থ-সম্পদ পুঞ্জীভূত হওয়ায় তারা ফুলেফেঁপে উঠলেও সরকারের রাজস্ব বাড়ছে না; বরং প্রতি বছরই তা কমছে। সে কারণে জিডিপির অনুপাতে সরকারি ব্যয় কমে যাচ্ছে, বঞ্চিত হচ্ছে দেশের সাধারণ মানুষ। ব্যক্তি খাতে কয়েকটি পরিবার বড় হচ্ছে, কিন্তু সাধারণ মানুষ চাপে আছে। তিনি বলেন, মুহিত (সাবেক অর্থমন্ত্রী) সাহেবের সময় সরকারের ব্যয় এক বছর বাড়লেও তা আবার কমে গেছে। সরকারের পলিসিগত বিষয়ে সিরিয়াস ভ্যাকুয়াম (মারাত্মক শূন্যতা) রয়েছে। কিন্তু এই সময়ে অর্থমন্ত্রী কোথায়? তাকে তো কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ভারতের শিল্পগোষ্ঠী আদানির সাথে বিদ্যুৎ চুক্তির কড়া সমালোচনা করে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, আদানির সাথে কী চুক্তি হয়েছে তা আমরা জানি না। আমরা জানি এই চুক্তি ক্ষতিকর, কিন্তু কতখানি ক্ষতিকর তা আমরা জানতে পারছি না। কারণ এই চুক্তি নিয়ে কোথায়ও আলোচনাই হয়নি।
অনুষ্ঠানে আরো বক্তব্য দেন অর্থনীতিবিদ আনু মুহাম্মদ, সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার এবং দৈনিক প্রথম আলোর হেড অব অনলাইন শওকত হোসেন।
আনু মুহাম্মদ বলেন, আইএমএফের শর্ত পূরণ হলে দেশের অর্থনীতির ভালো হবে, এটা এক ধরনের উইশফুল থিঙ্কিং। অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি বলেন, বাংলাদেশের আগে ১২ বার আইএমএফের ঋণ নিয়েছে, কিন্তু তারপরও দেশে খেলাপি ঋণ বা কর-জিডিপির অনুপাত বাড়েনি; বরং কমেছে। সে জন্য এ বিষয়ক বোঝাপড়া দরকার। এই ঋণ ভোগ করবে সরকার, কিন্তু দায় শোধ করবে জনগণ।
দেশের জ্বালানি খাত পুরোপুরি আমদানিনির্ভর হয়ে পড়েছে বলে অভিযোগ করেন আনু মুহাম্মদ। সরকারের ভুল নীতির কারণে তা হচ্ছে, কিন্তু আইএমএফ এ বিষয়ে একটি কথাও বলে না। সে জন্য তার অভিযোগ, আইএমএফ আন্তর্জাতিক পরিসরে বড় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোর স্বার্থ রক্ষা করে।
আইএমএফের শর্তের কারণে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি বাড়ে বলে মন্তব্য করেন প্রথম আলোর হেড অব অনলাইন শওকত হোসেন। তার অভিযোগ, পরিস্থিতি যা-ই হোক না কেন, আইএমএফ সবার ওপর একই ধরনের শর্তারোপ করে। সে জন্য তারা বিশ্বের সবচেয়ে অজনপ্রিয় ঋণদাতা প্রতিষ্ঠান।
শওকত হোসেন আরো বলেন, এবার বাংলাদেশ বেশ আগেভাগে আইএমএফের ঋণ চেয়েছে, শ্রীলঙ্কা বা পাকিস্তানের মতো পরিস্থিতি বাংলাদেশে হয়নি। বাংলাদেশ ঋণ চেয়েছে, বেইল আউট নয়। এ ছাড়া বিশেষজ্ঞরা সাধারণত আইএমএফকে ডেকে আনা পছন্দ না করলেও এবার তার ব্যতিক্রম দেখা গেছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
আইএমএফের কাছে ঋণের আবেদন করার কারণ অর্থনৈতিক। এটা রোগের লক্ষণ বলে মনে করেন সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার। তার মতে, রোগটা হলো গণতান্ত্রিক দায়বদ্ধতার অভাব, জনগণের কাছে দায়বদ্ধতার অভাব।
এ সংসদকে ‘তথাকথিত নির্বাচিত সংসদ’ আখ্যা দিয়ে বদিউল আলম মজুমদার বলেন, প্রকৃত নির্বাচন করতে হলে পাঁচ বছর পরপর হলেও জনগণের কাছে যেতে হয়। কিন্তু তা হচ্ছে না সত্ত্বেও সরকারকে ক্ষমতায় থাকতে যারা সাহায্য করছে, সরকার তাদেরই তুষ্ট করছে, অর্থাৎ বড় ব্যবসায়ী গোষ্ঠীগুলো।
অনুষ্ঠানে দেশ ও বিদেশ থেকে বিশ্লেষক ও সাংবাদিকেরা যোগ দেন।
আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে ভার্চুয়াল মতামত ও অন্যান্য ভিডিও পাবেন।
গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে সাথেই থাকুন।
Public Reaction একটি মতামতভিত্তিক সাইট।
মূলধারার সংবাদ এবং মতামত, প্রবন্ধ, গল্প, কবিতাসহ সৃজনশীল লেখা প্রকাশের একটি মুক্তমাধ্যম এটি। লিখুন আপনিও।
ইমেইল: opinion2mail@gmail.com, info@publicreaction.net