গায়ে হাত বুলানো বিচার না হয়

:: মোহাম্মদ আবু নোমান ::
প্রকাশ: ২ years ago

বর্তমান ছাত্র রাজনীতি শিক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংস করে ফেলেছে। ছাত্রদের সন্ত্রাসীতে পরিণত করছে, প্রশাসন ও শিক্ষকদের দুর্নীতিগ্রস্ত করেছে। পৃথিবীর সব দেশে বিশ্ববিদ্যালয় জ্ঞান চর্চার ক্ষেত্র, বাংলাদেশে টর্চার ক্ষেত্র। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ফুলপরী যে ধরনের নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, সে খবর শোনার পর শুভ প্রত্যাশী কোনো মা-বাবাই কি সুস্থ থাকতে পারেন? অর্থনৈতিক টানাপোড়েন ও সামাজিক সংগ্রামের মাধ্যমে একটি সন্তানকে লালন করে জীবনে এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্নে দেশের সর্বোচ্চ কোনো বিদ্যাপীঠে পাঠানোর পর পিতা-মাতা মোটেই নিশ্চিন্তে থাকতে পারেন না।
সন্তান সে ছেলেই হোক আর মেয়েই হোক, বাড়ির বাইরে পড়তে গেলে বাবা-মায়ের মনে একটা বাড়তি উদ্বেগ থাকে। নানা বিষয় নিয়ে এই উদ্বেগ। সে ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করছে কি না, শরীরের যত্ন নিচ্ছে কি না, পড়ালেখা কেমন করছে, অসৎ সঙ্গে মিশে উচ্ছন্নে যাচ্ছে কি না, নেশা করছে কি না, কোনো অপরাধ চক্রের সঙ্গে মিশে রাষ্ট্রদ্রোহ কাজে জড়িয়ে পড়ছে কি না ইত্যাদি নানান চিন্তা।
মধ্যবিত্ত বা নিু-মধ্যবিত্ত পরিবারের প্রত্যেক পিতা-মাতা বিশেষ একটি বিষয়ের ওপর বেশি চিন্তিত থাকেন- আর তা হলো বিশ্ববিদ্যালয় পড়–য়া সন্তানের সুস্থতা ও ভবিষ্যৎ। বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্যাতন, টর্চার ও দাঙ্গা-হাঙ্গামার কারণে চিন্তার অন্ত থাকে না বাবা-মায়ের। সন্তান যেনে বিশ্ববিদ্যালয়ে যুদ্ধক্ষেত্রের ক্রীড়নক! নিন্মবিত্ত বা মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ যেন স্বপ্ন জয়ের বিষয়। কিন্তু স্বপ্নজয়ী বাবা-মায়ের মনে জন্মাতে থাকে সন্তানের নিরাপত্তার ভয়। মা-বাবার মধ্যে বিরাজ করে এক অজানা আতঙ্ক, কখন আবার তাদের সন্তান হামলার শিকার হতে হয়! যারা একদিন সন্তানদের ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর স্বপ্ন দেখছেন তারাই এখন ভয়ে কুঁকড়ে থাকেন। সন্তানের ভবিষ্যত নয়, সন্তানের নিরাপত্তার ভয়! যারা মানসিক চাপ সহ্য করতে পারেন না তাদের অবস্থা কেন থাকে, যা লিখে ব্যক্ত করা সম্ভব নয়।

পাবলিক রিঅ্যাকশনের সর্বশেষ খবর পেতে Google News অনুসরণ করুন

সম্প্রতি ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে (ইবি) ভর্তির কয়েক দিনের মাথায় ছাত্রলীগের একজন নেত্রী ও তার অনুসারীদের নিষ্ঠুরতার শিকার হন ফুলপরী খাতুন নামের এক সাধারণ শিক্ষার্থী। ছাত্রলীগের নেত্রী সানজিদা চৌধুরী অন্তরা ও তার সঙ্গীসাথিরা ফুলপরীকে বিবস্ত্র করে সেফটিপিন ফুটিয়েছে। শুধু তাই নয়, মোবাইল ফোনে সে দৃশ্য ধারণ করে ভাইরাল করার হুমকিও দেওয়া হয় তাকে। সেদিন অভিযুক্তরা তাকে ঘিরে ধরে বিভিন্নভাবে নির্যাতন করতে থাকেন। গামছা দিয়ে মুখ বেঁধে শরীরের বিভিন্ন স্থানে পিন ফোটানো, সজোরে মুখে চড়-থাপ্পড়, আপত্তিকর অবস্থায় ভিডিও ধারণ, নাম প্রকাশ করলে ভাইরালের হুমকি, প্রভোস্টের নামে কুরুচিপূর্ণ গালাগাল করতে বাধ্য করে ভিডিও ধারণ, ডাইনিংয়ের ময়লা গ্লাস চেটে পরিষ্কার করাতে বাধ্য করানো ছাড়াও অপ্রকাশযোগ্য মানসিক, শারীরিক ও যৌন হয়রানি করার মতো ঘটনা ঘটে ওই রাতে। এমনটি বর্ণনা দিয়েছেন ভুক্তভোগী ছাত্রী।
অদ্ভুত! একজন মেয়ে কীভাবে অন্য আরেকটি মেয়েকে এভাবে নির্যাতন করতে পারে? সানজিদা এ সাহস কোথা থেকে পেল? ছাত্রলীগ থেকে? এই বয়সে যে মেয়ে এতো কুৎসিত, সে ভবিষ্যতে আরও কতো কুৎসিত হবে? এর বাইরে সাম্প্রতিক সময়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, ইডেন মহিলা কলেজ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে অপরাধমূলক নানা কর্মকা-ের কারণে সংবাদমাধ্যমে শিরোনাম হয় ছাত্রলীগ।
এ ধরনের জঘন্য ঘটনা কেবল ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়েই ঘটেনি, অন্যত্রও ঘটেছে। বলা যায়, সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের ত্রাসের শিকার সাধারণ শিক্ষার্থীরা। এমনকি এখন তারা স্বার্থের দ্বন্দ্বে নিজেরা নিজেরা খুনোখুনি করছে।
ইবির ঘটনাটি উচ্চ আদালত পর্যন্ত গড়ায়। হাইকোর্ট ফুলপরী খাতুনকে নির্যাতনের ঘটনায় ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সহসভাপতি সানজিদা চৌধুরীসহ পাঁচ ছাত্রীকে সব ধরনের শিক্ষা কার্যক্রম থেকে সাময়িকভাবে বহিষ্কার করতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিয়েছেন। তাছাড়া প্রক্টরের উদাসীনতা, সহকারী রেজিষ্ট্রার ও হাউজ টিউটরের দায়িত্ব পালনে চরম অবহেলা এবং ব্যাপক গাফিলতি ছিল বলে হাইকোর্টের নির্দেশে গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। হাইকোর্ট নির্যাতনের শিকার ফুলপরীকে নির্ভয়ে স্বাভাবিক শিক্ষাজীবন চালিয়ে নিতে হলে সিট বরাদ্দ দিতে নির্দেশ দিয়েছে।
অতীতে এ রকম বহু নজির আছে, ঘটনাকে ধামাচাপা দেওয়ার জন্য অভিযুক্ত নেতাকর্মীদের বিবৃতি দিয়ে বহিষ্কার করা হয়েছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে এলে বহাল তবিয়তে তাদের প্রত্যাবর্তন ঘটেছে। শাস্তি নয়, যা হয়েছে পদক্ষেপ মাত্র! ফলে অপরাধের বিপরীতে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের বহিষ্কার শেষ পর্যন্ত শাস্তি না হয়ে পুরস্কারই হয়ে উঠেছে। পরিণতিতে ফুলপরীকে নির্যাতনই শেষ নয়! এরকম আরো অনেক রোমহর্ষক ঘটনা বহাল তবিয়তেই চলতে থাকবে, জিরো টলারেন্স নীতিও চলতে থাকবে, দর্শক সারিতে থাকবে পুলিশ, আমরা থাকবো সমালোচক হিসেবে।
আমরা বলতে চাই বিচার যেনো এই না হয়, হলে সিট বাতিল হয়েছে সেটাও ফিরে পাবে। অপরাধীরা দ্রুতই বিশ্ববিদ্যালয় দাপিয়ে বেড়াবে। এর মানে হচ্ছে আপাতত বাইরে কিছু দিন থেকে আস! পরিস্থিতি ঠান্ডা হয়ে গেলে চলে এসো। ভুক্তভুগির কথা চিন্তা করে বিচার করতে হবে। বারবার অপরাধির কথা চিন্তা করে বিচার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয় না বলেই এসব ঘটনার পূনরাবৃত্তি হচ্ছে। আর এটাই যদি চূড়ান্ত বিচার হয়, তাহলে ছাত্রলীগ নামধারী দুর্বৃত্তরা দ্বিগুণ উৎসাহ পাবে। সাধারণ শিক্ষার্থীদের কপালে আরও খারাবি আছে। গায় হাত বুলানো বিচার আমরা দেখতে চাই না।
বিবস্ত্র করে ভিডিও ধারণ, চার ঘন্টা ধরে নির্যাতন ! নির্যাতনের শাস্তি শুধু হল ছাড়ার নির্দেশ! এইটারই যদি এই অবস্থা হয়। সারাদেশের মানুষ বা শিক্ষার্থীরা তাহলে কি বার্তা পেল? বিবস্ত্র করে ছবি তোলার জন্যইতো পর্নোগ্রাফি আইনে তাদের শাস্তি অবধারিত ! এধরণের আসামীদের সাথে সহানুভূতি দেখানো অর্থাৎ জাতির সম্মান আÍমর্যাদাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা!
প্রথম বর্ষে ভর্তি হওয়ার পর শিক্ষার্থীদের নতুন জীবনে সমর্থন-সহযোগিতা নিয়ে এগিয়ে আসার কথা অগ্রজদের, তাদের যথাযথ তত্ত্বাবধান ও যতœ নেওয়ার কথা শিক্ষকদের। এর বদলে তাদের যেন ছেড়ে দেওয়া হয় হিংস্র বিকৃতমনা গোষ্ঠীর সামনে, তাদের বিকৃত আনন্দ লাভের উপকরণ হিসেবে।
আওয়ামী লীগের টানা ১৪ বছরের শাসনের সময়টাতে ছাত্রলীগের একের পর এক অপরাধমূলক কর্মকা- খবরের শিরোনাম হয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সংগঠনটি যেসব কারণে আলোচনায় এসেছে, এর মধ্যে রয়েছে ছিনতাই, অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায়, সাধারণ শিক্ষার্থীদের নির্যাতন, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, যৌন হয়রানি। খোদ আওয়ামী লীগের কোনো কোনো নেতা মনে করছেন, ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের অপরাধমূলক কর্মকা- আওয়ামী লীগকেই সংকটে ফেলছে।
অতীতে এমন বহু ঘটনাই ঘটেছে, যেগুলোর স্থান-কাল-পাত্রভেদে মাত্রা-ভিন্নতা থাকলেও পরিণতি একই! কিছুদিনের আন্দোলন-ভাংচুর ছাড়া আর কিছুই দেখা যায়নি। কোনোটিরই শাস্তি বা বিচার হয়নি, প্রশাসন করেনি বা করতে পারেনি। তদন্ত কমিটি গঠন, মামলা দায়ের ইত্যাদির মাধ্যমেই ঘটনাগুলো একদিন হারিয়ে যায় শূন্যে। আমরাও সবাই ভুলে যাই। কোনো দাবি বা প্রতিশ্রুতিই আলোর মুখ দেখে না। বিশ্ববিদ্যারয়ের প্রক্টর হলেন শিক্ষার্থীদের দেখাশোনা বা তদারকির দায়িত্ব পালনকারী। দোষী ছাত্রীদের হাইকোর্ট বহিষ্কার দেয়ার আগেই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের বহিষ্কার করা উচিত ছিল।
ফুলপরীকে নির্যাতনকারী সানজিদা চৌধুরীসহ তার সঙ্গীসাথিদের অভিভাবক ও বিশ্ববিদ্যলয়ের নিয়ন্ত্রকদের অনুরোধ করব, দয়া করে ওদের এসব কর্মকা- থেকে ফেরান, নইলে একদিন আপনার সন্তানও এমনি ঘটনার শিকার হয়ে যেতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনকে আরও অনেক বেশি কর্তব্যপরায়ণ ও দায়িত্বশীল হতে হবে যেন যে কোনো ঘটনা তাদের অগোচরে না থাকে।
২০১৯ সালের ৭ অক্টোবর বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে হত্যার ঘটনা দেশজুড়ে আলোড়ন তুলেছিল। ২০১২ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ছাত্র জুবায়ের আহমেদ অন্তঃকলহের জের ধরে প্রতিপক্ষের হামলায় খুন হন। একই বছর বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮ দলের অবরোধের মধ্যে পুরান ঢাকার বাহাদুর শাহ পার্কের কাছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের একটি মিছিল থেকে কুপিয়ে হত্যা করা হয় দরজি দোকানি বিশ্বজিৎ দাসকে।
কিছুদিন আগে ইডেন গার্লস কলেজে ছাত্রলীগের নেত্রী ও অনুসারীদের হাতে নির্যাতিত হয়ে কয়েকজন ছাত্রী সাংবাদিক সম্মেলন ডাকেন। সেখানে ছাত্রলীগের নেত্রীর বিরুদ্ধে হলের সিট-বাণিজ্যের অংশ হিসেবে শুধু শারীরিক নির্যাতন নয়, সিটপ্রার্থী ছাত্রীদের ‘যৌনদাসী’ হিসেবে ব্যবহারের অভিযোগ ওঠে।
জাতীয় রাজনীতির লেজুড়বৃত্তি বা যে দল যখন ক্ষমতায় থাকে, তাদের লাঠিয়াল হিসেবে ব্যবহƒত হওয়ায় ছাত্ররাজনীতি। সাংগঠনিক স্বকীয়তা ও স্বাধীনতা নেই একেবারেই। ছাত্রলীগ দেশেরতো দুরেরকথা ছাত্রদেরও স্বার্থ রক্ষাকারী সংগঠন নয়। ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনের ধারাবাহিক অপরাধপ্রবণতা খুবই দুঃখজনক ও নিন্দনীয়। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ, সবারই এ বিষয়ে সজাগ ও সাবধান হওয়া উচিত। আমরা মনে করি ছাত্রসংগঠনকে আরও বিকেন্দ্রীকরণ ও জবাবদিহিমূলক নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা যায়, তাহলে নেতিবাচক ঘটনা কমে আসবে।


আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে ভার্চুয়াল মতামত ও অন্যান্য ভিডিও পাবেন।

গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে সাথেই থাকুন।


Public Reaction একটি মতামতভিত্তিক সাইট।
মূলধারার সংবাদ এবং মতামত, প্রবন্ধ, গল্প, কবিতাসহ সৃজনশীল লেখা প্রকাশের একটি মুক্তমাধ্যম এটি। লিখুন আপনিও।
ইমেইল: opinion2mail@gmail.com, info@publicreaction.net