কুরুচিপূর্ণ ও অন্যায় আবদার পূরণ না করায় শিশুসন্তানের আঙুল হারাতে হয়েছে— এক চিকিৎসকের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগে সংবাদ সম্মেলন করেছেন ভুক্তভোগী নুসরাত আরা ময়না। তার দাবি, মেয়ের চিকিৎসার সুযোগে বিভিন্ন বাহানায় ওই চিকিৎসক তাকে ‘একান্তে’ পেতে চাইতেন। এমনকি, মধ্যরাতে মুঠোফোনে ক্ষুদেবার্তাও পাঠাতেন, যেখানে লেখা থাকতো ‘ঘুম?’ ‘রাগ?’ ‘কথা বলা যাবে?’ ইত্যাদি।
বুধবার (১ মার্চ) দুপুরে খুলনা প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে পুরো ঘটনা সবার সামনে তুলে ধরেন শিশুটির মা নুসরাত আরা ময়না। এসময় ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।
নুসরাত আরা ময়না বলেন, একদিন রাত ১২টা ৩২ মিনিটে ‘ঘুম?’ ১২টা ৩৪ মিনিটে ‘রাগ?’ ১২টা ৩৮ মিনিটে ‘কথা বলা যাবে?’ ইত্যাদি ম্যাসেজ মোবাইলে আসে। দেখতে পাই, এসব ক্ষুদেবার্তার প্রেরক শিশুকন্যা অথৈ’র চিকিৎসক ডা. নিশাত আব্দুল্লাহ। মেয়ের চিকিৎসার সুযোগ নিয়ে বিভিন্ন সময় এ ধরনের আরও ক্ষুদেবার্তা পাঠিয়ে, এমনকি নিজ চেম্বারে একা দেখা করার আহ্বানও জানাতেন ডা. নিশাত। এই চিকিৎসকের কুরুচিপূর্ণ ও অন্যায় আবদার পূরণ না করায় শিশুটি হাতের একটি আঙুল হারিয়েছে। ভুল চিকিৎসার অভিযোগ তোলায় মামলার আসামি হয়েছে আমার স্বামী এএসআই নাঈমুজ্জামান শেখ। এখন গ্রেপ্তারের হাত থেকে বাঁচতে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন তিনি। আর অথৈ’র চিকিৎসার অভাবে ছুটে বেড়াচ্ছে পুরো পরিবার।
পাবলিক রিঅ্যাকশনের সর্বশেষ খবর পেতে Google News অনুসরণ করুন
সাংবাদিকদের তিনি জানান, মাত্র এক বছর বয়সেই তাদের একমাত্র সন্তান অথৈ’র হাত আগুনে পুড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ওই সময় চিকিৎসকরা ‘একটু বড় হলে’ অস্ত্রোপচারের পরামর্শ দেন। কিন্তু আর্থিক সংকটসহ নানা কারণে এটা করা যায়নি। ২০২২ সালের ২১ আগস্ট খুলনার সরকারি শেখ আবু নাসের হাসপাতালের প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগে গেলে সহযোগী অধ্যাপক ডা. নিশাত আবদুল্লাহ দ্রুত অপারেশন করাতে বলেন। আবু নাসের হাসপাতালে অপারেশন করাতে চাইলে ডা. নিশাত সেখানে না করে হক নার্সিং হোম নামের একটি বেসরকারি ক্লিনিকে করানোর পরামর্শ দেন।
নুসরাত বলেন, চলতি বছরের ১৮ জানুয়ারি অথৈ’র হাতের আঙুলে অপারেশন হয়। এরপর প্রতিদিন ড্রেসিং লাগে। অপারেশনের পর হাতের অবস্থার অবনতি হলে চিকিৎসক ২ ঘণ্টা পর পর হাতের ছবি তার হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে পাঠাতে বলেন। নির্দেশনা অনুযায়ী নিয়মিত ছবি পাঠাতে থাকি। এই সুযোগে ওই চিকিৎসক হোয়াটসঅ্যাপে তাকে কুরুচিপূর্ণ এবং ইঙ্গিতপূর্ণ বার্তা পাঠাতে থাকেন। একপর্যায়ে একা দেখা করার চাপ দিতে থাকেন। তার কথায় রাজি না হওয়ায় তিনি অথৈ’র চিকিৎসায় ‘গাফিলতি’ করেন।
তিনি বলেন, ডা. নিশাত আবদুল্লাহ আমার মেয়ের চিকিৎসার সুযোগে বিভিন্ন সময় ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করেন। আমার নম্বরে তার ব্যক্তিগত মোবাইল থেকে গত ১১ ফেব্রুয়ারি রাত ১২টা ৩২ মিনিটে ‘ঘুম?’ রাত ১২টা ৩৪ মিনিটে ‘রাগ?’ রাত ১২টা ৩৮ মিনিটে ‘কথা বলা যাবে?’-সহ বিভিন্ন সময় ইঙ্গিতপূর্ণ বার্তা পাঠান। এছাড়া বিভিন্ন সময় ফোনে আমাকে একা দেখা করতে বলেন। মেয়ের সু-চিকিৎসার কথা চিন্তা করে ডাক্তারের ফোনকল ও ম্যাসেজের বিষয়ে কাউকে কিছু জানাইনি।
সংবাদ সম্মেলনে অথৈ’র মা বলেন, গত ৬ ফেব্রুয়ারি ডা. নিশাত আমার মেয়েকে নিয়ে শেখপাড়া হক নার্সিং হোমের চেম্বারে ড্রেসিং করানোর জন্য যেতে বলেন। সন্ধ্যায় সেখানে গেলেও আমাকে প্রায় দেড় ঘণ্টা বসিয়ে রাখেন। রাত সাড়ে ৮টায় আমার মেয়েকে নিয়ে অপারেশন থিয়েটারের ভেতর গেলে নিশাত আবদুল্লাহ আমাকে নানা রকম আপত্তিকর কথাবার্তা বলার একপর্যায়ে হাত ধরে টেনে কাছে নেওয়ার চেষ্টা করেন। বুঝতে পেরে মেয়েকে নিয়ে অপারেশন থিয়েটার থেকে বের হয়ে যাই। বিষয়টি ক্লিনিকমালিককে জানালে তিনি ডা. নিশাতের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টো কাউকে না বলতে চাপ দেন।
‘ওই ঘটনার পর এক জন নার্স অথৈর ড্রেসিং করেন। এরপর নানা সময় বিভিন্ন রকম ওষুধ দেন। দ্রুত অবস্থার অবনতি হতে থাকে। গত ২৫ ফেব্রুয়ারি রাতে হঠাৎ করে অথৈর আঙুল হাত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। দ্রুত হক নার্সিং হোমে ছুটে গেলে ডা. নিশাতসহ অন্যরা কেউ-ই চিকিৎসা করতে রাজি হয়নি। রাত ১২টার পর কোনোরকম ড্রেসিং করে বাড়ি ফিরে আসি। এরপর থেকে অথৈর কোনও চিকিৎসা হচ্ছে না। খুলনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, আবু নাসের হাসপাতাল, হক নার্সিং হোমে গিয়েছি, কেউ অথৈর চিকিৎসা করাতে রাজি হচ্ছে না। এর মধ্যে জানতে পেরেছি, ওর বাবার নামে মামলা হয়েছে।’
মামলা ও যৌন হয়রানির অভিযোগ সম্পর্কে বিএমএ সভাপতি ডা. শেখ বাহারুল আলম বলেন, ‘এক জন চিকিৎসককে অপারেশন থিয়েটারে ঢুকে মারধর করা হয়েছে। এই হামলাকারীদের অবশ্যই আইনের আওতায় আনতে হবে। ওই চিকিৎসকের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ তোলা হয়েছে, তা পুলিশ তদন্ত করে দেখুক। যদি সত্য হয় তাহলে তাকেও আইনের আওতায় আনলে চিকিৎসকদের কোনও আপত্তি থাকবে না।’
এ বিষয়ে কথা বলার জন্য একাধিকবার ফোন করা হলেও ডা. নিশাত আব্দুল্লাহ রিসিভ করেননি। এমনকি হাসপাতালে গিয়েও তাকে পাওয়া যায়নি।
উল্লেখ্য, খুলনায় চিকিৎসকের ওপর হামলা ও রোগীর মায়ের শ্লীলতাহানির ঘটনায় পাল্টাপাল্টি মামলা দায়ের হয়েছে। হামলার ঘটনায় শহীদ আবু নাসের বিশেষায়িত হাসপাতালের চিকিৎসক নিশাত আব্দুল্লাহ বাদী হয়ে রোগীর পিতা এএসআই নাঈমুজ্জামান শেখসহ অজ্ঞাতনামা কয়েকজনের বিরুদ্ধে মঙ্গলবার রাতে সোনাডাঙ্গা থানায় মামলা দায়ের করেন। অপরদিকে, হামলাকারী পুলিশ কর্মকর্তার স্ত্রীকে শ্লীলতাহানির অভিযোগ এনে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক নিশাত আব্দুল্লাহ ও হক নার্সিংহোমের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নুরুল হক ফকিরের বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা দায়ের হয়েছে। এএসআই নাঈমুজ্জামান শেখের স্ত্রী নুসরাত আরা ময়না বাদী হয়ে এ মামলা দায়ের করেন।
এর আগে, ভুল চিকিৎসার অভিযোগ এনে গত ২৫ ফেব্রুয়ারি নগরীর শেখপাড়া এলাকার হক নার্সিং হোমের অপারেশন থিয়েটারে ঢুকে পুলিশের এএসআই নাঈম ও তার সঙ্গীরা ডা. শেখ নিশাত আবদুল্লাহকে মারধর করেন। এছাড়া অপারেশন থিয়েটারে ভাঙচুর চালায়। এক মাস আগে অপারেশন করা রোগীর ‘জটিলতার’ কথা বলে তারা এই হামলা চালায়। ডা. নিশাত বর্তমানে খুলনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে ভার্চুয়াল মতামত ও অন্যান্য ভিডিও পাবেন।
গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে সাথেই থাকুন।
Public Reaction একটি মতামতভিত্তিক সাইট।
মূলধারার সংবাদ এবং মতামত, প্রবন্ধ, গল্প, কবিতাসহ সৃজনশীল লেখা প্রকাশের একটি মুক্তমাধ্যম এটি। লিখুন আপনিও।
ইমেইল: opinion2mail@gmail.com, info@publicreaction.net