ভাষার লড়াই ছিল বাঙালি সংস্কৃতি রক্ষার লড়াই

:: নাসরীন মুস্তাফা ::
প্রকাশ: ২ years ago

“নদীতে বসে আব্বাসউদ্দীন সাহেবের ভাটিয়ালি গান তাঁর নিজের গলায় না শুনলে জীবনের একটা দিক অপূর্ণ থেকে যেত। তিনি যখন আস্তে আস্তে গাইতেছিলেন তখন মনে হচ্ছিল, নদীর ঢেউগুলিও যেন তাঁর গান শুনছে। তাঁরই শিষ্য সোহরাব হোসেন ও বেদারউদ্দিন তাঁর নাম কিছুটা রেখেছিলেন। আমি আব্বাসউদ্দীন সাহেবের একজন ভক্ত হয়ে পড়েছিলাম। তিনি আমাকে বলেছিলেন, ‘মুজিব, বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে বিরাট ষড়যন্ত্র চলছে। বাংলা রাষ্ট্রভাষা না হলে বাংলার কৃষ্টি, সভ্যতা সব শেষ হয়ে যাবে। আজ যে গানকে তুমি ভালবাস, এর মাধুর্য ও মর্যাদাও নষ্ট হয়ে যাবে। যা কিছু হোক, বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করতেই হবে।’ আমি কথা দিয়েছিলাম এবং কথা রাখতে চেষ্টা করেছিলাম।”

পাবলিক রিঅ্যাকশনের সর্বশেষ খবর পেতে Google News অনুসরণ করুন

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরে এক ভ্রমণে গিয়ে নৌপথে আব্বাসউদ্দীনের কণ্ঠে ভাটিয়ালি গান শোনার অনুপম এই অভিজ্ঞতা বর্ণিত হয়েছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের লেখা ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে। আব্বাসউদ্দীন বলেছিলেন, ‘বাংলা রাষ্ট্রভাষা না হলে বাংলার কৃষ্টি, সভ্যতা সব শেষ হয়ে যাবে।’ এই ভয় অমূলক ছিল না। বাঙালি মুসলমানের মনে পাকিস্তান রাষ্ট্রের অভ্যুদয় সাম্প্রদায়িক ভাবনার জন্ম দিয়েছিল। রাষ্ট্র কেবলি একটি সম্প্রদায়ের হবে, একটি সম্প্রদায়ের কথা ভাববে, একটি সম্প্রদায়কে রক্ষার জন্য যা করতে হয় করবে এই যুক্তি সে সময়কার বাঙালি মুসলমান কবি-সাহিত্যিকদের মনেও ঠাঁই পেয়েছিল। পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদী চেতনায় তারা লিখতে শুরু করলেন তাদের গল্প-কবিতা-উপন্যাস-প্রবন্ধ। হুমায়ুন আজাদ এই সময়ের প্রসঙ্গে বলেছিলেন,“কবি-গল্পকার-প্রাবন্ধিক-ঔপন্যাসিকেরা ভয়াবহভাবে আক্রান্ত হয়েছিলেন পাকিস্তানি জ্বর ও ঘোর দিয়ে।’’ হুমায়ুন আজাদ আরও লিখেছেন, ‘‘একুশের আগে বাঙালি মুসলমানের ভাষা ছিলো অপরিশ্রুত, অনেকটা পুঁথি সাহিত্যের ভাষা; ওই ভাষার অবিরল আরবি-ফারসি-উর্দু শব্দ জানিয়ে দিত যে রচয়িতারা মুসলমান, পাকিস্তানি। বায়ান্নর পরে পরিশ্রুত হয়ে উঠতে থাকে বাঙলা ভাষা, বিদায় নিতে থাকে আরবি-ফারসি-উর্দু শব্দ এবং ষাটের দশকে বাঙলা ভাষা প্রায় বিশুদ্ধ বাংলায় পরিণত হয়। … ভাষা আন্দোলন ভাষাকেই স্বাধীন স্বায়ত্তশাসিত করেছে বেশি।’

১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারির জন্ম না হলে জ্বর ও ঘোর থেকে কবি-সাহিত্যিক-ঔপন্যাসিক-প্রাবন্ধিকরা বেরুতে পারতেন কি না সন্দেহ আছে। বাংলা ভাষাভাষী বুদ্ধিজীবী এবং সুশীল সমাজের কেউ কেউ বাংলা অক্ষর ঠিকঠাক ইসলামি নয়, এই ফতোয়া দিয়ে আরবি অক্ষরে বাংলা লেখার উপর জোর মতামত প্রকাশ করলেন। একবারও ভাবলেন না ভাষার ধর্মীয় পরিচয় তৈরি করে সব ধর্মের ঐক্যকে প্রতিষ্ঠা করা যায় না। ভাষা আন্দোলনে ছাত্রদের খুনি সরকার প্রপাগান্ডা ছড়িয়েছিল, কলকাতা থেকে হিন্দু ছাত্ররা পায়জামা পরে এসে আন্দোলন করেছে। এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ বইয়ে লিখেছেন, “যে সত্তর-পঁচাত্তরজন ছাত্র বন্দি হয়েছিল তার মধ্যে একজনও হিন্দু ছাত্র ছিল না। এমনকি যারা আহত হয়েছিল তার মধ্যেও একজন হিন্দু ছিল না।’ তিনি আরও লিখেছেন, “দুনিয়ার বিভিন্ন দেশের মুসলমানরা বিভিন্ন ভাষায় কথা বলে। আরব দেশের লোকেরা আরবি বলে। পারস্যের লোকেরা ফার্সি বলে, তুরস্কের লোকেরা তুর্কি ভাষা বলে, ইন্দোনেশিয়ার লোকেরা ইন্দোনেশিয়ান ভাষায় কথা বলে, মালয়েশিয়ার লোকেরা মালয়া ভাষায় কথা বলে, চীনের মুসলমানরা চীনা ভাষায় কথা বলে। এ সম্বন্ধে অনেক যুক্তিপূর্ণ কথা বলা চলে। শুধু পূর্ব পাকিস্তানের ধর্মভীরু মুসলমানদের ইসলামের কথা বলে ধোঁকা দেওয়া যাবে ভেবেছিল, কিন্তু পারে নাই। যে কোনো জাতি তার মাতৃভাষাকে ভালোবাসে। মাতৃভাষার অপমান কোনো জাতিই কোনো কালে সহ্য করে নাই।”

বুদ্ধিজীবী ও সুশীল সমাজের জ্বর ও ঘোর কেটে যাওয়ায় উপকার হলো বাংলা সাহিত্যের। নিজের জাতিগোষ্ঠীর প্রতি ইসলামের নামে করা শাসক শ্রেণির বৈষম্য ও অত্যাচারকে তারা তুলে ধরতে শুরু করলেন। বাংলা সাহিত্য আবার মানবিক ধারায় ফিরল। আর মৃত্যু ঘটল সাম্প্রদায়িক পাকিস্তানি জাতীয়বাদী চেতনার বাংলা সাহিত্যের স্বল্পস্থায়ী সেই ধারাটির। একইভাবে বাংলা ভাষাকে হিন্দুয়ানি বানিয়ে পাকিস্তানের শাসক শ্রেণি ও তাদের ধামাধরা রাজনীতি চেতনার সাহিত্যিক ও সংস্কৃতিবানদের অপচেষ্টায় রবীন্দ্র সংগীতকে নিষিদ্ধ করা, কাজী নজরুল ইসলামের গান ও কবিতায় শ্মশান মুছে গোরস্থান বসিয়ে বেশি বেশি মুসলমানি ঘটানোর অপচেষ্টাকেও রহিত করা গেল। এতে উপকার হলো বাংলা সংস্কৃতির। অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে বাঙালি সংস্কৃতির সমর্থক হিসেবে গ্রহণ করতে মন উন্মুক্ত হলো, দৃষ্টি হলো উন্মোচিত। পাকিস্তানের শাসক শ্রেণি ও তাদের তল্পিবাহক বুদ্ধিজীবী ও সুশীল সমাজ নামের সুবিধাবাদী গোষ্ঠী কখনোই অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রের ভাবনা ভাবেননি। এখনো, এই এত বছর পরেও পাকিস্তান অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র হিসেবে আকার নিতে পারেনি। যদিও অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র মানেই যে মানবিক ও সভ্য রাষ্ট্র হওয়ার প্রথম ধাপ, সেই মানসিকতার অধিকারী তারা ছিলেন না, ব্যক্তিস্বার্থ কখনোই তাদেরকে তেমনটি হতে দেয়নি। এখনো এই বাংলাদেশে যারা সাম্প্রদায়িকতার ঘাড়ে ভর দিয়ে পাকিস্তান-চেতনাকে ইনিয়ে বিনিয়ে প্রতিষ্ঠিত করতে চান, বাংলাদেশকে মানবিক ও সভ্য রাষ্ট্র হতে দিতে ঘোরতর আপত্তি তাদের। এরা এখনো ভয় পায় ভাষা আন্দোলনের প্রতিটি বিষয়কে। মায়ের ভাষা বাংলা ভাষাকে সর্বোচ্চ সম্মান দিতে এরা কখনোই রাজি নয়। নিজের দেশ বিপদে পড়তে যাচ্ছে- এই জাতীয় গুজবে ভাতঘুমের আরাম খুঁজে পায়। আবদুল গাফফার চৌধুরী’র ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ কবিতা, একাত্তরের শহীদ আলতাফ মাহমুদের সুরে গীত ভাষা আন্দোলনের সেই অমর কবিতার একটি লাইন ছিল এরকম- “ওরা এদেশের নয়”!

ভাষার লড়াইয়ের সেই ভয়ংকর সময়ে বাংলার লেখক-সাহিত্যিক-শিল্পী তথা শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির মানুষগুলো তাঁদের সৃষ্টকর্ম দিয়ে মানুষের মনকে আরও ভয়হীন করে গড়ে তুলতে পেরেছিলেন। ভাষার দাবি কেনো যৌক্তিক, তা বোঝাতে কণ্ঠশিল্পীরা পথে পথে গান গেয়ে বেড়াতেন, চিত্রশিল্পীরা তেমনি রাজপথকে ক্যানভাস বানিয়ে ভাষার দাবিতে রং তুলিকে হাতিয়ার বানিয়ে ফেলেছিলেন।

হাজার বছরের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ১৯৪৮ সাল থেকে শুরু হওয়া বাংলা ভাষার মর্যাদা ও অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই, যা ১৯৫২ সালে চূড়ান্ত ভাষা আন্দোলনে রূপ পেয়ে বাঙালিকে স্বাধিকার আন্দোলনে প্রস্তুত করে তোলে। সেই প্রস্তুতিই ১৯৭১ সালে যখন বঙ্গবন্ধু ঘোষণা দিলেন, ‘যার যা কিছু আছে তা নিয়ে’ প্রতিরোধ করার, তখন বাঙালি মরনপণ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে সময় নেয়নি। অপরিমেয় আত্মত্যাগের বিনিময়ে স্বাধীনতার সূর্যকে ছিনিয়ে আনতে পেরেছিল বলেই বাংলার নিজস্ব ভাষার বই প্রকাশিত হচ্ছে আজ, বইমেলা হচ্ছে। আজ বাংলায় গান গাই, বাংলার সুরে নেচে উঠি। বাঙালি নিজের গল্পে চলচ্চিত্র নির্মাণ করে যা বিশ্বজুড়ে প্রদর্শিত হয়। বাঙালি সংস্কৃতি রক্ষা পেয়েছিল ভাষার লড়াইয়ের মাধ্যমেই। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, ‘সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা ছাড়া রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতা অর্থহীন। তাই মাটি ও মানুষকে কেন্দ্র করে গণমানুষের সুখ, শান্তি ও স্বপ্ন এবং আশা-আকাঙ্ক্ষাকে অবলম্বন করে গড়ে উঠবে বাংলার নিজস্ব সাহিত্য-সংস্কৃতি।’ভাষার লড়াইয়ের চেতনায় উজ্জীবিত হোক বাঙালি। জয় হোক বাংলার নিজস্ব সাহিত্য-সংস্কৃতির।

 

লেখিকা: শিশুসাহিত্যিক ও নাট্যকার।


আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে ভার্চুয়াল মতামত ও অন্যান্য ভিডিও পাবেন।

গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে সাথেই থাকুন।


Public Reaction একটি মতামতভিত্তিক সাইট।
মূলধারার সংবাদ এবং মতামত, প্রবন্ধ, গল্প, কবিতাসহ সৃজনশীল লেখা প্রকাশের একটি মুক্তমাধ্যম এটি। লিখুন আপনিও।
ইমেইল: opinion2mail@gmail.com, info@publicreaction.net