নিজের সুখ বেঁচে অন্যের সুখ ক্রয়!

:: মোহাম্মদ আবু নোমান ::
প্রকাশ: ২ years ago
পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় নিজের টাকায় কাঁচা এই সড়ক করে দিয়েছেন কৃষক গাজী কামাল হোসেন (ডানে)। ছবি: পাবলিক রিঅ্যাকশন

‘এক বছর আগে আমি ভেড়ির (ছোট রাস্তা) ওপর দিয়া হাইট্টা যাইতেছিলাম। তহন ভেড়ির ওপর দিয়া এক গর্ভবতী মাকে একটা ভ্যানে কইরা হাসপাতালে লইয়া যাইতে দেখলাম। দুর্ভাগ্যবশত ভ্যানটি হঠাৎ বিলের মধ্যে উল্টাইয়া পইড়া যায়। ওই গর্ভবতী মা এই ভেড়ির পাশেই সন্তান প্রসব করেন। এই দৃশ্য দেইখ্যা আমার খুবই খারাপ লাগে। তহনই আমি নিজের অর্থে রাস্তাডা নির্মাণ করার চিন্তা করি।’
পটুয়াখালী জেলার কলাপাড়ায় নিজের জমি বেঁচে গ্রামের মানুষের জন্য রাস্তা নির্মাণ করা প্রসঙ্গ উল্লেখ করতে যেয়ে কৃষক কামাল হোসেন গণমাধ্যকে উক্ত কথাগুলো বলেন। নিজের জমি বিক্রির ৭ লাখ টাকা দিয়ে ‘গ্রামীণ রাস্তা’ বানিয়ে দিয়েছেন পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার নীলগঞ্জ ইউনিয়নের কুমিরমারা গ্রামের গাজী কামাল হোসেন নামের এক কৃষক। দৃষ্টান্ত ও জনকল্যাণমূলক এ কাজ করে তিনি এলাকায় সবার বাহবা পাচ্ছেন। সবাই কামাল হোসেনের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। কলাপাড়া উপজেলার নীলগঞ্জ ইউনিয়নের কুমিরমারা গ্রাম থেকে পূর্ব সোনাতলা বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের পেছন পর্যন্ত রাস্তাটি নির্মাণ করে দিয়েছেন তিনি।
আমরা প্রতিনিয়ত যেখানে দেখছি-শুনছি কিছু মানুষের বাড়ি দখল, বস্তি দখল, রাস্তা দখল করে সীমানা প্রাচীর ও বাড়ি নির্মাণ, রাস্তায় হাট-বাজার স্থাপন ও চাঁদা আদায়, রাস্তার ফুটপাত দখল। দেশে এতো এতো দুর্নীতি, অনিয়ম ও দখলের হাজারো খারাপ খবরের ভীড়ে একজন কৃষকের নিজের জমি বিক্রয় করে গ্রামের রাস্তা নির্মাণের খবরে চোখ আটকে গেল।
এটাই মানবতা! যা অনেক সম্পদশালীরাও পারেন না। কৃষক কামাল হোসেন সারা বাংলাদেশের সব মানুষের মাঝে মানবতার অতুলনীয় উদাহরণ। এরকম মানুষ আছে বলেই আমরা সুন্দরের গল্প করতে পারি, গল্প লিখতে পারি। এদের জন্যই পৃথিবীটা এখনো সুন্দর। কামাল হোসেনের এই জনকল্যাণমূলক কাজ সমাজের মানুষের যেমন অনেক উপকারে আসবে। তেমনি এতে সমাজের বিত্তশালী লোকদের শিক্ষণীয় রয়েছে অনেক কিছু। এক প্রেগন্যান্ট মায়ের কষ্ট দেখে নিজের জমি বিক্রি করে রাস্তা করেছেন কৃষক কামাল হোসেন। এর আগে বাঁশের সাঁকোও করে দিয়েছিলেন তিনি।
জানা যায়, কামাল হোসেন রাস্তাটি নির্মাণ করার জন্য নিজের ৩০ শতাংশ জমি বিক্রি করেন। জমি বিক্রির টাকা দিয়ে তিনি ১ হাজার ২০০ ফুট দৈর্ঘ্যের, ১৪ ফুট প্রস্থের এবং ১৪ ফুট উচ্চতার গ্রামীণ রাস্তাটি নির্মাণ করেছেন। গত ২০ জানুয়ারি রাস্তাটির নির্মাণকাজ শুরু হয় এবং ৫ ফেব্রুয়ারি রাস্তার কাজ শেষ হয়েছে। কুমিরমারা গ্রামের বাসিন্দা খলিল প্যাদা গণমাধ্যমকে বলেন, ‘অ্যাহন যেহানে নতুন রাস্তাটি তৈরি করা হইছে, সেইখানে আগে একটি ছোট রাস্তা আছিল। এই রাস্তা দিয়া আমাগো চলাফেরা করতে কষ্ট হইত। জোয়ারের পানি যহন ঢুকত, তহন সবই তলাইয়া যাইত। এইতে আমাগো আরও ভোগান্তি বাড়ত। কামাল হোসেন নিজের জমি বিক্রি করার টাহা দিয়া রাস্তাডা কইরা দেওনে আমাগো উপকার হইছে।’
খুবই ভালো ও প্রশংসামূলক কাজ করেছেন কৃষক গাজী কামাল হোসেন। জননেতারা রাস্তার নির্মাণের টাকা মেরে, জমি কিনে নিজেরা জমিদার বনে যান। জনপ্রতিনিধিরা রাস্তা, কালভার্ট নির্মাণের প্রতিশ্রুতি শোনাতে শোনাতে বছরের পর বছর পার করে থাকেন। চাপাবাজ ও ভাওতাবাজ জনপ্রতিনিধিদের নির্বাচনের আগের ও পরের কথার মিল থাকে না। যার প্রমাণ ওই এলাকার জাকির হোসেন নামের এক সবজিচাষির কথায় প্রমাণ হয়। তিনি বলেন, ‘কুমিরমারা গ্রামে সবচাইতে বেশি সবজি চাষ হয়। এ এলাকার বেশির ভাগ মানুষই কৃষক। দীর্ঘদিন ধইরা রাস্তা না থাহার কারণে আমাগো খেতের তোলা সবজি বাজারে লইয়া যাইতে কষ্ট হইত। আমরা এই রাস্তাডার লাইগা মেম্বার-চেয়ারম্যানরেও বহুবার কইছি। রাস্তার লাইগা আমরা গ্রামবাসী মানববন্ধন করছি, কিছুই হয় নাই। আমাগো পাশে শ্যাষ পর্যন্ত কামাল হোসেনই দাঁড়াইলেন। রাস্তাডা কইরা দিয়া তিনি একটা মহৎ কাজ করলেন।’
যে কাজ এলাকার জনপ্রতিনিধি, লোকাল প্রশাসন তথা রাষ্ট্রের করার কথা, সে কাজ ব্যক্তিগত উদ্যোগে করেছেন। কৃষক গাজী কামাল হোসেনরাই হচ্ছে প্রকৃত দেশপ্রেমিক। কলিজাওয়ালা, চমৎকার মানসিকতার মানুষ! যথেষ্ট আর্থিক সঙ্গতি না থাকলেও লোভ নাই, অন্তর আছে। আমরা বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই এমন মানুষকে।
কুমিরমারা গ্রামে প্রচুর সবজি উৎপাদন হয়। বলা যায়, কলাপাড়া উপজেলার মানুষের সবজির একটা বিরাট চাহিদা পূরণ হয় এ গ্রাম থেকে। সবজিচাষিসহ গ্রামের মানুষের যাতায়াতের সড়কটি ভালো না থাকায় দীর্ঘদিন ধরে মানুষজনকে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছিল। বর্ষা মৌসুমে গ্রামীণ এ পথসহ কুমিরমারা গ্রামটি আন্ধারমানিক নদের জোয়ারের পানিতে তলিয়ে যায়। এতে কৃষককুলের চাষাবাদও ব্যাহত হতো। এ ছাড়া স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের চলাচলেও অসুবিধা হতো। এলাকার মানুষসহ কৃষকের দুর্ভোগ দেখে গ্রামের সড়কটি নির্মাণের উদ্যোগ নেন কৃষক কামাল হোসেন।
কামাল হোসেন বলেন, এক্সকাভেটর (মাটি খনন করার যন্ত্র) দিয়ে মাটি কেটে এ রাস্তাটি নির্মাণ করা হয়। এ ছাড়া ১০-১২ জন শ্রমিক রাস্তা নির্মাণকাজে অংশ নিয়েছে। এতে তার ব্যয় হয়েছে প্রায় ৭ লাখ টাকা। রাস্তাটি মসৃণ করতে আরও টাকা দরকার। এ জন্য গোয়ালের গরু বিক্রি করার চিন্তা করেছেন তিনি।
আমরা বলতে চাই, ওখানে কি সরকার দলের এমপি, স্থানীয় প্রতিনিধি নেই যে, একজন সাধারণ মানুষকে জমি বিক্রি করে রাস্তা করতে হবে? মানুষ যেখানে ক্ষেতের আইল ঠেলে অন্যের জমি দখল করে, সেখানে নিজের জমি বিক্রি করে মানুষের জন্য রাস্তা বানানো এইসময় অভাবনীয় কাজ। এদেশে বেশির ভাগ জনপ্রতিনিধিরা দুর্নীতিবাজ, ভালো মানুষ হয় নির্যাতিত। ওই কাজ সড়ক ও জনপথ কর্তৃপক্ষের টেন্ডার হলে ৩০ লাখেও কি হতো? দেশে এমন মহান মানুষ আছে বলেই আমরা আশা করতে পারি, এ দেশ একদিন পরিবর্তন হবেই। সরকারের উচিত অনতিবিলম্বে এ মানুষটির ব্যয় করা পুরো টাকা সরকারি কোষাগার থেকে দেওয়ার ব্যবস্থা করার সাথে এই মহতী উদ্যোগের প্রতি সম্মান জানিয়ে কৃষক গাজী কামাল হোসেনকে পুরস্কৃত করা।
কামাল হোসেন আরও বলেন, ‘আমরা হাতে টাকা আছিল না। যে কারণে আমার নিজের ৩০ শতাংশ জমি বিক্রি করতে হইছে। জমি বিক্রির ৭ লাখ টাকায় রাস্তাডা নির্মাণ করতে সক্ষম হইছি। এ রাস্তার মাঝখান দিয়ে এখন যদি একটি পানি নিষ্কাশনের জলকপাট করে দেওয়া হয়, তাহলে কৃষকদের অনেক উপকার হবে।’ এর আগে ২০০৭ সালে নিজ অর্থায়নে নীলগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ের পাশ দিয়ে কুমিরমারা খালের ওপর একটি বাঁশের সাঁকো তৈরি করে দিয়েছিলেন কামাল হোসেন। ৩৬৫ ফুট দৈর্ঘ্যের সাঁকোটি তৈরি করতে তখন তার ২ লাখ টাকা খরচ হয়েছিল। পরে প্রতিবছর সাঁকো মেরামত করতে তার এক লাখ টাকা করে খরচ হয়। স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর ২০১২-১৩ অর্থবছরে সাঁকোর ওই জায়গায় লোহার কাঠামো দিয়ে সেতু নির্মাণ করে দেয়। এ ছাড়া তিনি এলাকার মসজিদ-মাদ্রাসায় অর্থসহায়তা, কন্যাদায়গ্রস্ত পিতাকে আর্থিক সহায়তাসহ জনহিতকর বহু কাজ করে থাকেন বলে জানা যায়। এসব কাজের জন্য স্থানীয় গ্রামবাসী তাকে ২০১০ সালে নীলগঞ্জ ইউনিয়নের ৩নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য নির্বাচিত করেন।
দায়িত্ববানরা দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার কারণেই জনদরদি কামাল হোসেন এগিয়ে এসেছেন। মহত হতে বড়লোক আর কাড়িকাড়ি টাকা লাগেনা। জনসেবা করতে কলিজা লাগে, অন্তরের প্রশস্ততা লাগে। এরাইতো সোনার দেশের সোনার মানুষ! এরাই সমাজের আসল হিরো। এরাই হলো সত্যিকারের জনপ্রতিনিধি। যারা নিজেদের সুখ বেঁচে অন্যের সুখ কিনে আনে। গাজী কামাল হোসেনরাই প্রকৃত মানুষ, যে অন্যের জন্য নিজেকে বিলিয়ে দেয়।
নীলগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. বাবুল মিয়া বলেন, ‘যে কাজ আমরা করতে পারিনি, তা কৃষক কামাল হোসেন করেছেন। সত্যিই তিনি ভালো কাজ করেছেন। তিনি এ সমাজের এক আলোকবর্তিকা, যা অনুকরণীয় এবং সবার জন্য দৃষ্টান্তমূলক। রাস্তাটি নির্মাণ হওয়ায় ওই এলাকার অন্তত দুই হাজার মানুষের কষ্ট দূর হয়েছে। তা ছাড়া এ রাস্তা হওয়ায় ধুলাসার, ডালবুগঞ্জ, মিঠাগঞ্জ, বালিয়াতলী ইউনিয়নের বাসিন্দারাও সহজে এ রাস্তা দিয়ে চলাচল করতে পারবে। রাস্তার মাঝখান দিয়ে যাতে একটি জলকপাট নির্মাণ করা যায়, সে চেষ্টা অবশ্যই করা হবে।’
কামাল হোসেন আপনিই প্রকৃত মানুষ। এই সমাজে ও রাষ্ট্রে আপনার মতো লোকের প্রয়োজন। আপনাকে দেখে এরকম হাজারো মানুষ অনুপ্রাণিত হবে এটাই আমাদের কামনা। সালাম, শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, অনেক অনেক দোয়া আলোকিত মানব দরদী গাজী কামাল হোসেনের জন্য। কৃত্তিমানের মৃত্যু নেই।


আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে ভার্চুয়াল মতামত ও অন্যান্য ভিডিও পাবেন।

গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে সাথেই থাকুন।


Public Reaction একটি মতামতভিত্তিক সাইট।
মূলধারার সংবাদ এবং মতামত, প্রবন্ধ, গল্প, কবিতাসহ সৃজনশীল লেখা প্রকাশের একটি মুক্তমাধ্যম এটি। লিখুন আপনিও।
ইমেইল: opinion2mail@gmail.com, info@publicreaction.net