আধিপত্য বিস্তারে ‘মানবাধিকার আলোচনা’ কি দ্বিচারিতা নয়?

::
প্রকাশ: ২ years ago

আসিফ আনোয়ার:
গত ২২ জানুয়ারী, যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যের মনটেরি পার্ক নামে একটি শহরে এলোপাতাড়ি বন্দুক হামলায় অন্তত ১০ জন নিহত হয়েছেন, আহত হয়েছেন আরও ১০ জন। আবার, কিছুদিন আগেও ৪ জানুয়ারী, পুলিশের গুলিতে নিহত হন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত সাঈদ ফয়সাল নামের এক তরুণ। এসব মানবাধিকার বর্হিভূত হত্যাকান্ড যেদেশে নিত্য ঘটনা, সেই দেশই মানবাধিকার হস্তক্ষেপের ঠিকাদার হিসেবে বর্হিবিশ্বে সুপ্রতিষ্ঠিত।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারগুলোতে হস্তক্ষেপ যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসের সাথে ওতপ্রতোভাবে জড়িয়ে আছে। মিলিটারি ইন্টারভেনশন প্রজেক্ট (এমআইপি) ডাটাবেস অনুসারে, আমেরিকা ১৭৭৬ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে সারা বিশ্বে প্রায় ৪০০টি সামরিক হস্তক্ষেপ করেছে। দেশটির দীর্ঘদিনের বৈদেশিক নীতির ইতিহাসে বেশিরভাগ হস্তক্ষেপগুলি ঘটেছিল ’৯০ এর দশক থেকে, যখন বিশ্বব্যাপী সুপার পাওয়ার হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র একক আধিপত্য বিস্তার শুরু করে। তথাকথিত উদারনৈতিক মূল্যবোধের অজুহাতে, বিশেষত গণতন্ত্র এবং মানবাধিকারকে পুঁজি করে দেশটি একের পর এক সামরিক হস্তক্ষেপ করে গেছে।

যারা আমেরিকার পররাষ্ট্রনীতির স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউর (এসওপি) এর সাথে পরিচিত তারা সহজেই বলতে পারবেন যে, কিভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার হস্তক্ষেপবাদী বৈদেশিক নীতি এজেন্ডাকে এগিয়ে নেওয়ার একটি হাতিয়ার হিসেবে মানবাধিকার ইস্যুটিকে ব্যবহার করে আসছে। এই ধরণের অনুশীলনটি তার বিশ্বব্যাপী আধিপত্যবাদী স্বার্থ হাসিলে ভূমিকা রেখেছে।

মানবাধিকারের অস্ত্রায়ন
বৃহত্তর বৈদেশিক নীতির অংশ হিসেবে নিজেদের এজেন্ডা বাস্তবায়নের হাতিয়ার হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র মানবাধিকার প্রকল্পকে ব্যবহার করে আসছে। ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে ‘পলিটিকো’তে প্রকাশিত তৎকালীন স্টেট সেক্রেটারি রেক্স টিলারসনের কাছে আন্তর্জাতিক সংস্থা বিষয়ক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক্তন সহকারী সেক্রেটারি অফ স্টেট ব্রায়ান হুকের পাঠানো একটি ফাঁস হওয়া অভ্যন্তরীণ নথি থেকে পাওয়া যায় কিভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মানবাধিকারকে তার প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে একটি আধিপত্যবাদী এজেন্ডা হিসেবে ব্যবহার করে আসছে। নথিতে মানবাধিকারকে বিরোধী পক্ষের বিরুদ্ধে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে জোর দেওয়া হয়েছে।

এটিতে বলা হয়, ‘মিত্রদের সাথে প্রতিপক্ষের চেয়ে ভিন্নভাবে আচরণ করা উচিত’ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উচিত প্রতিপক্ষকে চাপে রাখতে, প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে এবং তাদের সাথে কৌশলগতভাবে এগিয়ে থাকতে মানবাধিকারকে একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হিসেবে বিবেচনা করা। বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে চীন, রাশিয়া, উত্তর কোরিয়া এবং ইরানের সাথে বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে এটি বহুল ব্যবহৃত কৌশল। প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে মানবাধিকারের অভিযোগকে কাজে লাগানোর কৌশল সম্পর্কে নথিতে আরও বলা হয়, পাল্টা চাপ প্রয়োগ করার মাধ্যমে তাদের কাছ থেকে স্বার্থ পুনরুদ্ধার করা। প্রতিপক্ষকে তাদের কাছে মাথা নত করতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সর্বদা বিশ্বব্যবস্থা এবং প্রতিষ্ঠানের উপর তার দীর্ঘকাল যাবত ধরে রাখা নিয়ন্ত্রণকে ধরে রাখতে কয়েকভাবে মানবাধিকারকে অস্ত্রায়ণ করে আসছে।

প্রথমত, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মানবাধিকারের নামে শোষণ করেছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সুকৌশলে এবং বেছে বেছে তার প্রতিদ্বন্দ্বীদের বিরুদ্ধে একতরফাভাবে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার উপর তার অপ্রতিরোধ্য প্রভাব প্রয়োগ করে থাকে। দেশটির নিজেদের আইন-কানুন ও মূল্যবোধকে ব্যাপকভাবে সার্বজনীনভাবে আরোপ করার প্রবনতা বহুদিনের। আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক আন্তঃনির্ভরতাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার, এবং বৈশ্বিক `পাবলিক গুডস’-কে রাজনীতিকরণের মাধ্যমে প্রতিপক্ষকে নির্লজ্জভাবে দমিয়ে রাখায় তারা দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। বাংলাদেশে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব) এর বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা এ ধরণের ঘটনার একটি সাম্প্রতিক উদাহরণ। অথচ র‌্যাব অভ্যন্তরীণ সন্ত্রাসবাদের হুমকি রোধে কাজ করা বাংলাদেশের একটি অত্যন্ত কার্যকর ও সুদক্ষ বাহিনী।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থের জন্য মানবাধিকারকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের ক্ষেত্রে সর্বদা তার পশ্চিমা মিত্রদেরকে পাশে পেয়েছে, যারা ধারাবাহিকভাবে বৈদেশিক নীতিতে ‘সমগোত্রীয় রাষ্ট্র’ হিসেবে কাজ করে। এই মিত্রজোটের কতিপয় সদস্য ২০২২ সালের শীতকালীন অলিম্পিককে কূটনৈতিকভাবে বয়কট করে। এটিকে চীনের বিরুদ্ধে প্রচারণার মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করএকটি প্রচেষ্টা যা তাদের বিরুদ্ধে মানবাধিকারের অস্ত্র ব্যবহারের অভিযোগের সত্যতা বহন করে।

দ্বিতীয়ত, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো ইউরোপ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং জাপানের মত দেশের অর্থায়নের উপর নির্ভরশীলতার কারণে তাদের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে মানবাধিকারের অস্ত্রায়নে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। পশ্চিমা বিশ্ব, প্রধানত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, বিশ্বব্যাপী মানবাধিকার শিল্পের কেন্দ্র হিসেবে কাজ করে এবং তার বিরোধীদের বিরুদ্ধে বানোয়াট মানবাধিকারের অভিযোগ তৈরি করার জন্য অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এবং হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মতো সংস্থাগুলিকে প্রায়শই ব্যবহার করে।

পশ্চিমা সরকারগুলোর বৈদেশিক নীতির এজেন্ডা পূরণে বেছে বেছে ইস্যু তৈরি করা এবং পশ্চিমা স্বার্থের সাথে সাংঘর্ষিক বিষয়গুলোতে মুখে কুলুপ আটার অভিযোগ রয়েছে পশ্চিমের অর্থায়নে পরিচালিত এই সংস্থাগুলোর বিরুদ্ধে। আফগানিস্তানে মার্কিন সেনাদের সম্ভাব্য যুদ্ধাপরাধের তদন্ত করতে চাওয়ায় ২০১৯ এর এপ্রিল মাসে যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) এর সদস্যদের ভিসা প্রত্যাহার করেছিল তখন এই সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকে এই ধরনের নির্লজ্জ ‘সিলেকটিভিজম’ প্রদর্শিত হয়েছিল।

তৃতীয়ত, মানবাধিকার রক্ষা বা প্রচারের নামে সামরিক হস্তক্ষেপ হল আরেকটি বহুল ব্যবহৃত স্বার্থসিদ্ধির হাতিয়ার। তারা যুদ্ধগুলোকে প্রায়ই ‘মানবিক হস্তক্ষেপ’ বলে প্রচারণা চালায়। নিকারাগুয়া থেকে সিরিয়া এবং ইরাক থেকে লিবিয়া পর্যন্ত যুদ্ধের ন্যায্যতা দেওয়ার জন্য মানবাধিকারের বয়ানকে ব্যবহার করা হয়েছিল। কিন্তু উভয় যুদ্ধের ফলাফলই অগণিত মানুষ হত্যা ও তাদের অধিকার হরণের মাধ্যমে সমাপ্ত হয়েছে।

চীনের বিরুদ্ধে নতুন কৌশল
চীনের সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সর্বাত্মক কৌশলগত প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। চীনকে আটকানোর জন্য একাধিক ফ্রন্টে তাদেরকে লড়তে হচ্ছে। এই ধরনের একটি পূর্ণাঙ্গ শীতল যুদ্ধের মতো ভূ-কৌশলগত প্রতিযোগিতায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘদিন ধরে তার প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগকে কাজে লাগিয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হলো মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ উত্থাপন করা।

পশ্চিমা বয়ানে সহিংস বিচ্ছিন্নতাবাদ এবং সন্ত্রাসবাদের সাথে সম্পর্কিত ‘জিনজিয়াং ন্যারেটিভ’ এর আলোচনা খুব বেশি পুরাতন হয়নি। কিন্তু সাম্প্রতিক অতীতে, ইস্যুটি ধীরে ধীরে জিনজিয়াং স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলে প্রধানত মুসলিম সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে তথাকথিত মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ বা গণহত্যার অভিযোগের ঠিক বিপরীত মোড় নিচ্ছে, বিশেষ করে ট্রাম্প-প্রশাসনের সময় যখন চীন-বিরোধী প্রচারণা বেশ জোরেশোরেই এগিয়ে নেওয়া হয়েছে। এতে সহজেই বোঝা যায় যে চীনের বিরুদ্ধে ভূ-রাজনৈতিক বৈরিতা বৃদ্ধির সাথে সাথে জিনজিয়াংয়ে তথাকথিত মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগের প্রচারণা তাল মিলিয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে।

 

লেখক: গবেষক ও লেখক।


Public Reaction একটি মতামতভিত্তিক সাইট।
মূলধারার সংবাদ এবং মতামত, প্রবন্ধ, গল্প, কবিতাসহ সৃজনশীল লেখা প্রকাশের একটি মুক্তমাধ্যম এটি। লিখুন আপনিও।
ইমেইল: opinion2mail@gmail.com, info@publicreaction.net