সেলিনা আক্তার:
জাতিসংঘের উদ্যোগে ২০৩০ সালের মধ্যে একটি সুন্দর বিশ্বগড়ার লক্ষ্যে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি) লক্ষ্যমাত্রা গৃহীত হয়েছে। এসডিজি’র ১৭টি অভীষ্টের মধ্যে ৩ নম্বরে থাকা ‘সুস্বাস্থ্য ও কল্যাণ’ বাস্তবায়নে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় সহযোগী হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। স্বাস্থ্য মানুষের মৌলিক অধিকার। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৫ (ক) এবং ১৮ (১) অনুসারে চিকিৎসাসহ জনগণের পুষ্টি উন্নয়ন ও জনস্বাস্থ্যের উন্নতি সাধন রাষ্ট্রের অন্যতম দায়িত্ব। সাংবিধানিক এই দায়িত্ব পালন এবং স্বাধীনতার সুফল সকলের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য সরকার নিরলস কাজ করে যাচ্ছে। উন্নয়নের মহাসড়কে এগিয়ে চলছে বাংলাদেশ। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শী ও সফল নেতৃত্বের মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি স্বাস্থ্য খাতে ব্যাপক সাফল্য অর্জিত হয়েছে। স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নের ফলশ্রুতিতে সরকার দারুণ প্রশংসিত হয়েছে। পেয়েছে আর্ন্তজাতিক স্বীকৃতি ও পুরস্কার। স্বাস্থ্য অবকাঠামো খাতে তৃণমূল পর্যায়ে গ্রাম পর্যন্ত সেবা ব্যাপক বিস্তার করছে। সরকার ২০৩২ সালের মধ্যে সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। এ লক্ষ্য অর্জনের জন্য সরকারের প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।
ঠান্ডার এই মৌসুমে শিশুদের নানা রোগের প্রাদুর্ভাব বাড়ে। তার মধ্যে অন্যতম নিউমোনিয়া। এই রোগের জীবাণু মানুষের ফুসফুস এবং শ্বাসতন্ত্রকে আক্রান্ত করে। ভাইরাস, ব্যাকটেরিও, ফাঙ্গাস এবং টিবির জীবাণুর মাধ্যমে নিউমোনিয়া ছড়ায়। আক্রান্ত হয় বয়স্করাও।
নিউমোনিয়া হচ্ছে শ্বাসযন্ত্রের তীব্র সংক্রমণ, যা ফুসফুসকে আক্রান্ত করে। ফুসফুসের এক ধরনের ইনফেকশনের নাম নিউমোনিয়া। এটি সাধারণত শ্বাসতন্ত্রের প্রদাহের জন্য হয়ে থাকে, যাকে ইংরেজিতে বলা হয় রেসপাইরেটরি ট্রাক্ট ইনফেকশন। এই প্রদাহ যখন জীবাণুঘটিত বা সংক্রমণজনিত হয়ে রোগ তৈরি হয়, তখন এটিকে নিউমোনিয়া বলে। জনস্বাস্থ্যবিদরা জানান, ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, ফাঙ্গাস ও টিবির জীবাণুর মাধ্যমে নিউমোনিয়া ছড়ায়। সারাবিশ্বে পাঁচ বছরের কম বয়সি শিশুর নিউমোনিয়ায় আক্রান্তের হার বেশি। সব বয়সি এ রোগে আক্রান্ত হতে পারে। বয়স্করাও ঝুঁকিপূর্ণ। নির্দিষ্ট সময়ের আগে শিশুর জন্ম, ওজন কম হলে, অপুষ্টি, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, টিকা সময়মতো না নিলে অথবা অন্য কোনো শারীরিক সমস্যা, যেমন- জন্মগত হৃদরোগ হলে শিশু নিউমোনিয়ার ঝুঁকিতে থাকে।
প্রচণ্ড জ্বর, কাশি, সর্দি এবং শ্বাসকষ্ট হলো নিউমোনিয়ার প্রধান লক্ষণ। ১ বছরের বেশি এবং ৫ বছরের নিচের শিশুদের প্রতি মিনিটে ৪০ বা তার চেয়ে বেশি হলে তাকে নিউমোনিয়ার কারণেই দ্রুত শ্বাস হিসেবে ধরে নেওয়া হয়। জ্বরের সঙ্গে বাচ্চার শ্বাসকষ্ট, বুক দেবে যাওয়া- এসব লক্ষণ দেখা দেয়। শ্বাসকষ্টের কারণে শিশুর মুখে খাবার নিতে পারে না এবং ঘুমাতেও পারে না।এছাড়াও নিউমোনিয়া জন্মগত হৃদরোগ, সিস্টিক ফাইব্রোসিস বা ক্যানসারের জটিলতার কারণে হলে এবং সঙ্গে শারীরিক অন্যান্য সমস্যা দেখা দিতে পারে। নিউমোনিয়া থেকে রোগ জটিলতাস্বরূপ ফুসফুসে পানি, ফুসফুসে পুঁজ অথবা ফুসফুস একেবারে চুপসে যেতে পারে। নিউমোনিয়া থেকে পুষ্টিহীন বা রোগ প্রতিরোধহীন শিশুরা এনকেফালাইটিস বা মেনিনজাইটিস রোগে আক্রান্ত হতে পারে।
নিউমোনিয়া এখনো শিশুমৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ। দেশে প্রতিবছর ২৪ হাজারের বেশি শিশু মারা যাচ্ছে নিউমোনিয়ায়। তবে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির সমন্বিত প্রচেষ্টায় এই মৃত্যু কমিয়ে আনা সম্ভব।
বাংলাদেশে অপুষ্টি, মারাত্মক সংক্রমণ, নবজাতকের ধনুষ্টংকার, অপরিণত জন্ম, জন্ডিস, জন্মকালে আঘাত, জন্মকালে শ্বাসকষ্ট, ডায়রিয়া ও নিউমোনিয়ায় অনেক শিশু মারা যায়। সবচেয়ে বেশি মারা যায় নিউমোনিয়ায়। ১৮ শতাংশ শিশুমৃত্যুর কারণ নিউমোনিয়া। নিউমোনিয়া প্রতিরোধযোগ্য রোগ। তারপরও বছরে ২৪ হাজার ৩০০ শিশুর মৃত্যু হচ্ছে এই রোগে। নিউমোনিয়াপ্রতিরোধে আরো জরুরি পদক্ষেপ নেয়া নাহলে আগামী এক দশকে ১ লাখ ৪০ হাজারশিশু প্রাণ হারাতে পারে বলেও সতর্ক করে ইউনিসেফ। বাংলাদেশ জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপের তথ্য অনুযায়ী, ২০১১ সালে দেশে পাঁচ বছরের কমবয়সি প্রতি এক হাজার জীবিত জন্ম নেয়া শিশুর মধ্যে ১২ শিশু মারা যেত নিউমোনিয়ায়। ২০২০ সালে সেটি ছিল প্রতি হাজারে আটজন। বৈশ্বিক লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী, ২০২৫ সালের মধ্যে প্রতি এক হাজার জীবিত জন্ম নেয়া শিশুর মধ্যে মৃত্যুর সংখ্যা তিনে নামিয়ে আনার কথা। ২০১৯ সালে পাঁচ বছরের কম বয়সিদের মৃত্যুহার প্রতি ১০০০ জীবিত জন্মগ্রহণ করা শিশুর মধ্যে ৪০। সরকারি তথ্য অনুযায়ী, দেশে শিশুমৃত্যুর সবচেয়ে বড়ো কারণ এখন নিউমোনিয়া। বছরে যত শিশু (পাঁচ বছরের কম বয়সি) মারা যাচ্ছে, তাদের ১৮ শতাংশই মৃত্যুবরণ করে এরোগে আক্রান্ত্র হয়ে।
নিউমোনিয়ার লক্ষণগুলো দেখা দিলে অবশ্যই শিশুরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে। নিউমোনিয়ার মাত্রা বুঝে বাড়িতে বা হাসপাতালে চিকিৎসার প্রয়োজন হতে পারে। সময়মতো সঠিক চিকিৎসা পেলে শিশু ৫ থেকে ৭ দিনে ভালো হয়ে যায়। যেসব শিশু মায়ের বুকের দুধ পান করেনি, একই ঘরে অনেক লোকের সংস্পর্শে থাকে, ঘরের পরিবেশ খোলামেলা ও আলো–হাওয়া যুক্ত নয় এবং সঙ্গে অন্য কোনো অসুখ (যেমন হাম, অপুষ্টি) থাকে, তারা নিউমোনিয়ার ঝুঁকিতে থাকে। এমন আক্রান্তদের সেরে উঠতেও বেশি সময় লাগতে পারে।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলেছেন, নিউমোনিয়া আক্রান্ত হওয়ার প্রধান কারণগুলোর একটি হচ্ছে বায়ুদূষণ। মানুষের শরীরে, বিশেষ করে শিশু ও বয়স্কদের ফুসফুসে ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, ফাঙ্গাস প্রভৃতি ইনফেকশন বা সংক্রমণ হয়ে থাকে। বিশেষ করে ঘনবসতিপূর্ণ বস্তি এলাকার ঘরগুলোতে ভেন্টিলেশন সুবিধা কম থাকায় হাঁচি-কাশির মাধ্যমে নিউমোনিয়ার ঝুঁকি বাড়ে। তারা আরও বলেছেন, দেশে প্রতিবছর পাঁচ বছরের কম বয়সি ৮০ হাজারের মতো শিশু ভাইরাল নিউমোনিয়ায় ও বিভিন্ন ধরনের রেসপিরেটরি সমস্যা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়। এর মধ্যে পাঁচ বছরের কম বয়সিদের শতকরা ৩০ ভাগ মৃত্যুর কারণ নিউমোনিয়া।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য মতে, ১৪ হাজারের বেশি কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে নিউমোনিয়া বিষয়ে সচেতনতা কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। কমিউনিটি ক্লিনিকে পালসঅক্সিমিটার আছে। ভবিষ্যতে সব কমিউনিটি ক্লিনিকে নেবুলাইজার দেওয়া হবে। হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলো প্রস্তুত রাখার ব্যবস্থা করতে হবে যেন নিউমোনিয়ার গুরুতর রোগী পৌঁছানো মাত্রই চিকিৎসা শুরু করা সম্ভব হয়। নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তির রক্তে অক্সিজেনের পরিমাণ কমে যায়। এই পরিস্থিতিকে বলে হাইপোক্সিয়া। অক্সিজেন পরিমাপের জন্য পালসঅক্সিমিটার খুবই দরকার। অক্সিজেনের পরিমাণ না জানার কারণে কোনো শিশুর যেন মৃত্যু না হয় সে ব্যাপারে বিশেষ জোর দিতে হবে।
শিশুকে নিউমোনিয়া থেকে বাঁচাতে করণীয় হলো নিউমোনিয়ার কিছু ভ্যাকসিন বের হয়েছে। ভ্যাকসিনগুলো যদি সময়মতো নেওয়া যায়, তা হলে ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাসজনিত নিউমোনিয়া প্রতিরোধ করা যায়। তবে অবশ্যই ডাক্তারের সঙ্গে পরামর্শ করতে হবে। শিশুকে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত শিশুর কাছ থেকে দূরে রাখতে হবে। এ ছাড়া হাঁচি-কাশি আক্রান্ত লোকের সামনে থেকে শিশুদের দূরে রাখতে হবে। এমনকি ধুলাবালি থেকেও শিশুকে দূরে রাখতে হবে। শিশুকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতায় রাখতে হবে। বাইরে থেকে এসে হাত-মুখ সাবান দিয়ে ধুয়ে ফেলা। এ ছাড়া খাবার খাওয়ার আগে অবশ্যই হাত ধুতে হবে। বয়স ছয় মাসের কম এমন শিশু যদি বুকের দুধ পান করে, তবে সে নিউমোনিয়ার জীবাণু অনেকটাই প্রতিহত করতে পারবে। যে শিশুর বয়স ছয় মাসের বেশি, তাদের যদি বুকের দুধের পাশাপাশি বাড়তি খাবার হিসেবে দেশীয় খাবার খাওয়ানো যায়, তাহলে নিউমোনিয়া প্রতিহত করা সম্ভব হবে। এ সময় শিশুর গোসলে কুসুম গরম পানি ব্যবহার করতে হবে এবং শীতে শিশুদের ডায়াপার ঘন ঘন পরিবর্তন করা উচিত। এই রোগের চিকিৎসা সাধারণত নির্ভর করে কী ধরনের নিউমোনিয়া রোগীকে আক্রমণ করছে তার ওপর। নিউমোনিয়ার লক্ষণগুলো ও বিপদ চিহ্ন সম্পর্কে জনগণকে অবহিত করতে হবে, যেন দ্রুত নিউমোনিয়া আক্রান্ত শিশুকে স্বাস্থ্যকেন্দ্র নিয়ে সঠিক চিকিৎসার মাধ্যমে বিপদমুক্ত করা যায়।
সরকার প্রতিটি মানুষের স্বাস্হ্য সেবা নিশ্চিত করতে বদ্ধপরিকর। নিউমোনিয়ায় শিশুমৃত্যুর হার কমানোর বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচনা করেছেন সরকার। সরকারের সাফল্যের খাত হিসেবে ইপিআই কার্যক্রম বিশ্বে একটি রোল মডেল হিসেবে বিবেচিত হয়েছে।মা ও নবজাতকের স্বাস্থ্য (এমএনসিএইচ অপারেশন প্ল্যান), ম্যাটারনাল, চাইল্ড, রিপ্রোডাকটিভ অ্যান্ড অ্যাডোলেসেন্ট হেলথ (এমসিআরএএইচ) অপারেশন প্ল্যান ও জনস্বাস্থ্য পুষ্টি প্রতিষ্ঠান (এনএসএস অপারেশন প্ল্যান)—এ তিনটি জায়গায় সরকার যথেষ্ট জোর দিয়েছে। অর্থনৈতিক পরিস্থিতির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে দেশের মানুষের মাথাপিছু ব্যয় বাড়ছে। স্বাস্থ্য খাতে সরকার যে ব্যয় করে, তার ৯৩ শতাংশ আসে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে আসে ১ দশমিক ৬ শতাংশ এবং বাকি ৫ দশমিক ৪ শতাংশ আসে অন্যান্য মন্ত্রণালয় থেকে।
নিউমোনিয়ার ভয়াবহতা কমিয়ে আনতে আধুনিক বৈজ্ঞানিক চিকিৎসার পাশাপাশি স্বাস্থ্যসচেতনতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শিশুদের মাতৃদুগ্ধ পান, সময়মতো টিকা নেয়া, সুষম খাদ্যাভ্যাস, দূষণমুক্ত পরিবেশ, শারীরিক ব্যায়াম, ধূমপান ও অন্যান্য বদভ্যাস পরিত্যাগ ইত্যাদির মাধ্যমে আমরা নিউমোনিয়াকেনিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে পারি। নিউমোনিয়া হলো চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে কখনোই দেরি করা উচিত নয়। সম্পূর্ণরূপে নির্মূল না করা গেলেও নিউমোনিয়া নিয়ন্ত্রণ অবশ্যই সম্ভব।
পিআইডি ফিচার।