প্রত্যয় জসীম:
সমকালীন বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক জ্যোতির্ময় নাম ওবায়দুর কাদের। তিনি কথা বলেন, প্রাঞ্জল ভাষায় কাব্যময় ছন্দে। বহু পরিচয় তাঁর। প্রাবন্ধিক, কথাশিল্পী, সাংবাদিক ও রাজনীতিবিদ। সংস্কৃতি মনস্ক, বাগ্মী, স্পষ্টবাদী ও নিষ্ঠাবান পুরুষ। এক সময়ের তুখোড় ছাত্রনেতা। মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক। অমিত সাহসী মুক্তিযোদ্ধা। রাজবন্দি কুশীলব। সত্য কথক। বহুমাত্রিক প্রতিভার এক হিরক দ্যুতির নাম ওবায়দুল কাদের। ১ জানুয়ারি তার ৭৩তম শুভ জন্মদিন।
প্রজ্ঞাবান দেশপ্রেমি কর্মপ্রাণ ও সৃজনশীল রাজনীতির ফেরিওয়ালা। ওবায়দুল কাদের বিরল মেধা মননের অধিকারী। তিনি ১৯৫০ সালের ১ জানুয়ারি নোয়াখালী জেলার কোম্পানীগঞ্জ উপজেলাধীন বড় রাজাপুর গ্রামের এক অভিজাত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা মোশারফ হোসেন-বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সহপাঠী হিসাবে কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে অধ্যায়ন করেন। পরবর্তীতে তিনি সরকারি চাকরি ছেড়ে শিক্ষকতার মহান পেশায় যোগ দেন। মাতা বেগম ফজিলাতুন্নেসা। আর সহধর্মিনী ইসরাতুন্নেসা কাদের একজন খ্যাতিমান আইনজীবী। ওবায়দুল কাদের ছাত্রজীবন থেকেই অসাধারণ মেধার স্বাক্ষর রেখে চলেছেন। মেধাবী শিক্ষার্থীরা রাজনীতি বিমুখ একথাটি তিনি ভুল প্রমাণ করেছেন। বিদ্যালয়ের স্বনামধন্য ছাত্র ওবায়দুল কাদের বসুরহাট এ.এইচ.সি মডেল হাই স্কুল থেকে প্রথম বিভাগে মাধ্যমিক পাশ করেন ১৯৬৬ সালে। নোয়াখালী সরকারি কলেজ থেকে মেধা তালিকায় একাদশ স্থান অধিকার করে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন ১৯৬৮ সালে। এরপর প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ে ¯œাতক (সম্মান) ডিগ্রি লাভ করেন ১৯৭৪ সালে। একই বিশ^বিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান থেকে ¯œাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন ১৯৮০ সালে।
ছাত্রজীবনেই তাঁর রাজনীতিতে হাতেখড়ি। অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে আজন্ম প্রতিবদী ওবায়দুল কাদের ১৯৬৬ সালে ৬ দফা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালে গণঅন্দোলন ও ছাত্রদের ১১ দফা আন্দোলন সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। দেশমাতৃকার মুক্তির টানে ১৯৭১ সালে তিনি মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। তিনি কোম্পানীগঞ্জ থানা মুজিব বাহিনীর (বিএলএফ) অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেন। রাজনৈতিক জীবনের বিভিন্ন সময়ে তিনি একাধিকবার কারাবরণ করেন। ১৯৭৫-এর পর এক নাগাড়ে দীর্ঘ আড়াই বছর তাঁকে কারাগারে থাকতে হয়। কারাগারে থাকা অবস্থায়ই তিনি ১৯৭৮-১৯৮০ মেয়াদে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হয়ে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। ওবায়দুল কাদের দক্ষ নেতৃত্বের কারণেই সে সময়ে সারা দেশে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সংগঠন ‘বাংলাদেশ ছাত্রলীগ’ হয়ে উঠে জনপ্রিয় ছাত্র সংগঠন। এরপর তিনি যোগ দেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগে। ওবায়দুল কাদের ১২ জুন ১৯৯৬ এর ৭ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে নোয়াখালী -৫ আসন থেকে জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। একই বছরের ২৬ জুন যুব ও ক্রীড়া এবং সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। তিনি সততা ও নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালনের মধ্যদিয়ে দেশের যুবসমাজের উন্নয়নের পাশাপাশি ক্রীড়াঙ্গণে সফলতা বিশেষ করে দেশের ক্রিকেটকে আন্তর্জাতিক অঙ্গণে তুলে ধরতে ও টেস্ট মর্যাদা অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
২০০২ সালের ত্রিবার্ষিক সম্মেলন থেকে ২০০৯ এর সম্মেলন পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রথম যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন। এক/এগার পরবর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে তিনি ২০০৭ সালের ৯ মার্চ জরুরি বিধিতে গ্রেফতার হয়ে ১৭ মাস ২৬ দিন কারাবরণ করেন। ২০০৮ সালে ৫ সেপ্টেম্বর তিনি জামিনে মুক্ত হন। কারাগারে থাকাকালে কারাজীবনের বর্ণনা দিয়ে, অনুস্মৃতিঃ যে কথা বলা হয়নি, গ্রন্থটি লিখেন। তিনি ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর দ্বিতীয়বারের মতো নোয়াখালী-৫ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং তথ্য মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৯ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ত্রিবার্ষিক সম্মেলনে প্রথমবারের মতো তিনি দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য নির্বাচিত হন। এছাড়া তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সংসদীয় মনোনয়ন বোর্ড, স্থানীয় সরকার পরিষদসমূহের মনোনয়ন বোর্ডের সদস্য। এর আগে ২৩ জুন ২০০০ থেকে ২৬ ডিসেম্বর ২০০২ পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন।
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউ-এ তিনি ভয়াবহ গ্রেনেড হামলায় মারাত্মক আহত হন। গ্রেনেডের স্পিøন্টার তাঁর শরীরকে ক্ষতবিক্ষত করে। কিছু সারতে পারলেও এখনো তাঁর শরীরে রয়েছে অসংখ্য স্পিন্টার।
২০১১ সালের ২৮ নভেম্বর মহাজোট সরকার এর মন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন এবং যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। এ ছাড়া তিনি কিছুদিনের জন্য রেলপথ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করেন। সরেজমিন পরিদর্শন ও নিবিড় মনিটরিং এর মাধ্যমে দেশের সড়ক অবকাঠামো উন্নয়নে তাঁর নিরলস প্রয়াস দেশ-বিদেশে প্রশংসিত হয়েছে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি তৃতীয়বারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। বর্তমানে তিনি সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন। বর্তমান সরকারের শাসনামলে দেশে সড়ক যোগাযোগ অবকাঠামো উন্নয়নে যুগান্তকারী বিপ্লব সাধিত হয়েছে। ২৫ জুন ২০২২ দেশের বৃহত্তম সেতু পদ্মাসেতু উদ্বোধন করেছেন প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা। পদ্মাসেতু, মেট্টোরেল, কর্ণফুলী টানেল, ফোরলেন সড়ক, উড়াল সড়কসহ বহু উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন ও চলমান রয়েছে। এসব বহুমুখি উন্নয়ন কাজের আইকন লিডার হিসাবে নেতৃত্ব প্রদানে ওবায়দুল কাদেরের অতুল্য কর্মদক্ষতা ইতোমধ্যে সর্বমহলে প্রশংসিত হয়েছে।
২২ ও ২৩ অক্টোবর ২০১৬ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ২০তম জাতীয় সম্মেলনে ওবায়দুল কাদের উপমহাদেশের অন্যতম প্রাচীন রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী- এর সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। পরবর্তীতে ২০১৯ সালের ২১ ও ২২ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত ২১তম জাতীয় সম্মেলনে তিনি দ্বিতীয়বারের মতো বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এর সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। যোগ্যতা মেধা ও নেতৃত্বের গুণেই তিনি এ বিরল সৌভাগ্য অর্জন করেছেন। বঙ্গবন্ধু কন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনার অবিচল আস্থাভাজন ও বিশ^স্ত ওবায়দুল কাদের। বাংলাদেশ তথা দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম রাজনৈতিক সংগঠন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এর ২৪ ডিসেম্বর ২০২২ এ অনুষ্ঠিত ২২তম সম্মেলনে তৃতীয়বারের মতো সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছেন। যোগ্যতা, মেধা, নেতৃত্বগুণে তিনি এক অনন্য উচ্চতায় আসীন। সৌভাগ্যের বরপুত্র তিনি।
দেশের অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ ওবায়দুল কাদের ছাত্রনেতা থেকে গণমানুষের নন্দিত নেতায় পরিণত হয়েছেন দীর্ঘ ত্যাগ আর কর্মীদের অকৃত্রিম ভালোবাসার কারণেই। আওয়ামী লীগের দুর্দিনে, দুঃসময়ে ওবায়দুল কাদের বঙ্গবন্ধুর আদর্শ থেকে একচুলও বিচ্যুত হননি কখনো। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বাস্তবায়ন করতে গিয়ে ওবায়দুল কাদের কারা নির্যাতিত হয়েছেন বারবার। তিনি স্বৈরাচার- সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনে রেখেছেন সাহসী ভূমিকা।
কুশলী লেখক ওবায়দুল কাদের। বইপড়া ও গানশোনা তাঁর সখ। রাজনীতির পাশাপাশি সাংবাদিকতা আর লেখালেখির জগতেও জনপ্রিয় তিনি। দৈনিক বাংলার বাণী পত্রিকার সহকারী সম্পাদক হিসেবে দীর্ঘ সময় কাজ করেছেন। ইতোমধ্যে তাঁর বেশ কিছু গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। ২০১৫ সালে বাংলা একাডেমির বইমেলায় তাঁর লেখা উপন্যাস ‘গাঙচিল’ সর্বোচ্চ সংখ্যক কপি বিক্রি হয়েছে। অন্যান্য গন্থের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশের হৃদয় হতে, এই বিজয়ের মুকুট কোথায়, মেঘে মেঘে অনেক বেলা, রচনা সমগ্র, কারাগারে লেখা অনুস্মৃতি : যে কথা বলা হয়নি, নির্বাচিত কলাম এবং ভ্রমণকাহিনী তিন সমুদ্রের দেশ, রাজনৈতিক কলাম, মাটি ও মানুষের কথা, বঙ্গবন্ধু ও দেশের কথা। কোলকাতা থেকে প্রকাশিত তাঁর এ রিভ্যলুশন বিট্রেইড গ্রন্থটি দেশ-বিদেশে ব্যাপক আলোচিত একটি গ্রন্থ। এছাড়া তিনি রবার্ট পেইনের লেখা দ্যা টর্চারড এন্ড দ্যা ড্যামন্ড গ্রন্থের ভাবানুবাদে লিখেন পাকিস্তানের কারাগারে বঙ্গবন্ধু। তিনি বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় দক্ষ। সরকারি, রাষ্ট্রীয়, ধর্মীয় ও ব্যক্তিগত কাজে তিনি ভারত, শ্রীলঙ্কা, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, দক্ষিণ আফ্রিকা, চিন, জার্মানি, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, তুরস্ক, ইতালি, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ভূটান, নেপাল, ফিলিপাইন এবং জাপানসহ বিশে^র অনেক দেশ সফর করেছেন।
ওবায়দুল কাদের রাজনীতির বরপুত্র! তাত্ত্বিক রাজনীতিবিদ। নন্দিত কর্মবীর! লেখক মনীষা! তিনি বাক পটু! তাঁর কথাই যেন সাহিত্য! পঙক্তি পর পঙক্তি মিলিয়ে কথার মালা সাজান জনভাষ্যের এ রূপকার। কখনো অপরাজেয় বাংলার বেদীমূলে, কখনো সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে, কখনো প্রান্তিক জনপদে স্পষ্টভাষী এ রাজনীতিক মানুষের প্রাণে সঞ্চারিত করেন আশা ও স্বপ্ন। এ রাজপুরুষ তাঁর রাজনীতি ও লেখায় আমাদের প্রণোদনা যোগান বঙ্গবন্ধুর আদর্শ, দেশপ্রেম ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার অবিরত সংগ্রামে। ৭৩তম জন্মদিনে তাঁর সুস্থ সুন্দর কর্মময় দীর্ঘজীবন কামনা করছি।
লেখক: কবি, কথাসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক।
সাবেক ছাত্রলীগ নেতা এবং সভাপতি, বাংলাদেশ রাইটার্স ফাউন্ডেশন।