শুভ বড়দিন, ভালোবাসা বিনিময়

::
প্রকাশ: ২ years ago

সিস্টার মেরী প্রশান্ত, এসএমআরএ:
বর্ষচক্রে প্রতি বছরই বড়দিন আসে আমাদের মাঝে। খ্রিস্টানদের ভুবনে বড়দিন হলো একটি প্রধান ও অনন্য উৎসব, যা মোটামুটি গোটা বিশ্বেই পালিত হয়। যিশু খ্রিস্টের জন্মকে কেন্দ্র করেই এই উৎসব পালন করা হয়। তাই খ্রিস্টানদের জন্য ডিসেম্বর মাসটি একটি বিশিষ্ট মাস, প্রস্তুতির মাস, আত্মায় শুদ্ধিকরণের প্রস্তুতি। পরিত্রাতা আসবেন মানবজাতিকে ত্রাণ করতে, মুক্তি দিতে। এমন একটি সময়ে যিশুর আগমন ঘটেছিল যখন পৃথিবী অন্যায়-অবিচারে, শাসন-শোষণে, অত্যাচারে-নিপীড়নে পাপের অন্ধকারে ছিল নিমজ্জিত। এমন সময় আমাদের দয়ালু পিতা তার পুত্রকে পাঠালেন মানবজাতিকে মুক্তি দিতে।

বড়দিনের সত্যিকারের আনন্দ যিশুকে আমাদের ধ্যানের চেতনায় ও হৃদয়ে রেখে তার আদর্শ অনুসরণ করার মধ্যে। প্রকৃতপক্ষে তার ভালোবাসার দৃষ্টান্তে জীবনযাপন করা এবং অন্যদের সেবায় নিজের জীবনকে ব্যয় করার মধ্যেই নিহিত রয়েছে বড়দিনের প্রকৃত আনন্দ ও তাৎপর্য। বড়দিন হলো অত্যন্ত সুন্দর ও উপযুক্ত একটি সময়। আমাদের প্রত্যেকের জীবনকে শিশু যিশুর ভালোবাসায় নবীকরণ এবং হৃদয়কে তার ভালোবাসায় উদ্দীপিত করে খ্রিস্টীয় প্রেম ও সেবায় আত্মনিয়োগ করার।

যিশু খ্রিস্টের জন্মের শুভ সূচনায় তার আগমনী বার্তা খ্রিস্টভক্তদের অন্তরে বাজতে থাকে। মানুষের অন্তরে জাগে নতুন আশা, চারদিকে সাজ সাজ রব, মানুষের কণ্ঠে কণ্ঠে ধ্বনিত হয় যিশু খ্রিস্টের আগমনী গান। খ্রিস্টীয় সংগীত শিল্পীদের আগমনী গানগুলো ছুঁয়ে যায় মনের আঙ্গিনা, রোমাঞ্চে ভরে ওঠে হৃদয়-মন। এই আনন্দ উৎসবকে কেন্দ্র করে প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে খ্রিস্টান জনগোষ্ঠী।

এই উৎসবের একটি বিশিষ্ট অংশ হলো সাজসজ্জা। গির্জাঘর সাজানো, ঘরবাড়ি সাজানো, গোশালা সাজানো, ক্রিসমাস ট্রি সাজানো, নতুন নতুন পোশাকে, দামি অলংকারে নিজেদের সাজাতে ব্যস্ত হয়ে ওঠে ভক্ত জনগণ। যুগ যুগ ধরেই চলে আসছে এই উৎসবের ঘনঘটা। তারা গৃহাঙ্গন সুন্দর করে সাজানোর সঙ্গে সঙ্গে আধ্যাত্মিক অনুশীলনের মাধ্যমে সাজিয়ে তোলে হৃদয় মন্দিরও।

আয়োজন চলে হরেকরকমের খাবার-দাবারের। বহু রকমের পিঠা-পুলি তৈরি করার হিড়িক পড়ে যায় পরিবারে পরিবারে। পিঠা তৈরি করাটা বড়দিনের ঐতিহ্যবাহী একটি রীতি, যা গ্রামবাংলায় পরিলক্ষিত হয় বেশিরভাগ। বড়দিনের বিশিষ্ট খাবার হলো কেক ও কমলা। খ্রিস্ট ভক্তগণ বানাবে, বিলাবে, খাবে, খাওয়াবে, মিলিবে একসঙ্গে। এটাই বড়দিনের মিলন উৎসব।

বড়দিনের আরও একটি অংশে রয়েছে উপহার আদান-প্রদানের উৎসব। উপহার আদান-প্রদানের মধ্য দিয়ে তারা অন্তরের ভালেবাাসা বিনিময় করে। এই দেওয়া-নেওয়ার মাধ্যমে পারস্পরিক একটি নিবিড় বন্ধন সৃষ্টি হয় তাদের মধ্যে। গরিব-দুঃখী ভাই-বোনদের তারা উদারভাবে দান করে অন্তরের ভালোবাসা প্রকাশ করে। এই সহভাগিতাটাও কিন্তু এক ধরনের উপহার এবং তা বড়ই আন্তরিক। তবে বড়দিনের সর্বশ্রেষ্ঠ উপহার হলো ঈশ্বর পুত্র মানুষ হয়ে আমাদের মাঝে নেমে এলেন এই মাটির ধরায়, জীর্ণ গোয়ালঘরে। এটা পরম পিতার অকৃত্রিম ভালোবাসার এক অনন্য দান।

এবার দেখা যাক বড়দিনের এই মহাউৎসবে মহামানব শিশু যিশুর জন্য আমাদের উপহার কেমন হতে পারে? কি উপহার আমরা তাঁকে দেব? কেমন হৃদয় নিয়ে দেব? আমাদের অন্তরের গোয়ালঘরটি কি আমরা যথাযথভাবে সাজাতে পেরেছি? এক উজ্জ্বল তারকা নম্র-বিনীত প্রাণ রাখালদের পথ দেখিয়ে নিয়ে গিয়েছিল সেই গোশালায়। তারা শুনতে পেয়েছিল স্বর্গদূতদের মধুর সংগীত। সেই উজ্জ্বল তারা কি আমাদের হৃদয়াকাশে উদিত হয়েছে? আমরা কি শুনতে পাচ্ছি আকাশ থেকে ভেসে আসা সেই সুমধুর সংগীত?

তাই আসুন, আমরা আরও একটু গভীরভাবে আত্মমূল্যায়ন করে দেখি। নম্রচিত্তে নত হয়ে গোয়ালঘরের সেই নবজাত শিশুটিকে, যিনি আমাদের ভালোবেসে নত হয়ে নেমে এলেন আমাদের এই মর্ত্যে ধুলার ধরায়। তাই এসো তাঁর রাঙ্গা চরণে আমাদের প্রাণের প্রণামটি রেখে বলি, ‘প্রভু, তুমি এসো, এসো আমার হৃদয়ে জন্মগ্রহণ করে আমার মলিন হৃদয় শুচি করে দাও। নবসাজে সাজিয়ে দাও আমার হৃদয়ের জীর্ণ, মলিন গোশালাটি, আমার সেই পুরনো জীবনটাকে ধৌত করে তোমার ভালোবাসায় প্লাবিত করে নবজীবনের দিকে চালিত কর।’

বড়দিনের রেশ কাটতে না কাটতেই ডিসেম্বর মাসের সমাপ্তি শুরু হতে যাচ্ছে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুসারে নতুন বছর। এবারের ইংরেজি নববর্ষ নিয়ে আসুক নতুনের বার্তা। নিয়ে আসুক অন্যরকম স্বপ্ন আর অমিত সম্ভাবনার ফুলঝুড়ি। মুছে দিক সকল পাপ, তাপ, ব্যথা, বেদনা ও গ্লানি। বছরের প্রতিটি মুহূর্ত, ক্ষণ ভরে উঠুক আনন্দ, হাসি, গান আর সাফল্যে। আমাদের অঙ্গীকার হোক জরা ও জীর্ণ, দীনতা ও নীচতাকে পদতলে পিষ্ট করে সুন্দরের পথে অবিরাম হেঁটে চলার। এর জন্য দরকার দিকে দিকে শুভবোধ ও মঙ্গলব্রতের উদ্বোধন, যা মিলতে আর মেলাতে শেখায়। শেখায় অন্যকে আপন করতে। হিংসার বদলে ভালোবাসতে শেখায়। শেখায় সবার অংশ হতে।

আজকের শিশু যিশুর জন্মতিথিতে সবাইকে জানাই বড়দিনের শুভেচ্ছা। যিশু খ্রিস্টের প্রেমের বন্যায় ভেসে যাক সমগ্র পৃথিবী। সবাইকে বড়দিনের শুভেচ্ছা। শুভ বড়দিন।

লেখিকা : ক্যাথলিক খ্রিস্টান সন্ন্যাসব্রতী