ড. আবু সালেহ মুহাম্মদ তোহা:
পারস্পরিক সাহায্য-সহযোগিতা ও অন্যের প্রয়োজনে এগিয়ে আসা ইসলামী সমাজব্যবস্থার একটি অনন্য বৈশিষ্ট্য। সাহায্য-সহযোগিতার নানা ধরন ও উপায়ের মধ্যে অভাবগ্রস্তকে বিনা সুদে ঋণ প্রদান অন্যতম সাদকা হিসেবে বিবেচিত। বিনিময়হীন ঋণ প্রদানের মাধ্যমে অন্যকে সহযোগিতা করা হয়, অন্যের বিপদে পাশে দাঁড়ানো হয়। অর্থনৈতিক সংকটে নিপতিত ব্যক্তিকে ঋণ প্রদানের মাধ্যমে তাকে বিশেষ সহায়তা করা হয়।
তবে ঋণ প্রদান করা ভালো হলেও ঋণ গ্রহণ করা ভালো কিছু নয়। ইসলামে ঋণ প্রদানে উৎসাহ দিলেও ঋণী হতে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। তার পরও প্রয়োজনে ঋণের আদান-প্রদান হয়। সে ক্ষেত্রে ঋণদাতা ও গ্রহীতার দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে।
ঋণ সুদমুক্ত হওয়া : ঋণের বিনিময়ে মূলধনের অতিরিক্ত কোনোরূপ শর্তারোপ করা যাবে না। এটিই সুদ, যা সম্পূর্ণ হারাম। সাধারণ সুদ ও চক্রবৃদ্ধি সুদ সব একই। আল্লাহ বলেন, ‘যারা সুদ খায় (কিয়ামতের দিন) তারা সেই ব্যক্তির মতো উঠবে, শয়তান যাকে স্পর্শ দ্বারা মোহাবিষ্ট করে দেয়। এটা এ জন্য হবে যে তারা বলেছিল, বিক্রিও তো সুদেরই মতো হয়ে থাকে। অথচ আল্লাহ বিক্রিকে হালাল করেছেন আর সুদকে হারাম করেছেন। ’ (সুরা বাকারা, আয়াত: ২৭৫)
ঋণ লিপিবদ্ধ করা : ঋণদাতা ও গ্রহীতা পরস্পরের চাওয়া-পাওয়ায় একমত হয়ে লিপিবদ্ধ করে রাখা উচিত। এরপর যথাসাধ্য তা মেনে চলতে হবে। সব ধরনের চুক্তি ও লেনদেনের ক্ষেত্রেই লিখিত থাকাটা উত্তম। আল্লাহ বলেন, ‘তা ছোট হোক বা বড় হোক, মেয়াদসহ লিখতে তোমরা কোনোরূপ বিরক্ত হইয়ো না। আল্লাহর কাছে তা নায্যতর ও প্রমাণের জন্য দূঢ়তর এবং তোমাদের মধ্যে সন্দেহের উদ্রেক না হওয়ার নিকটতর। ’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ২৮২)
অতি দীর্ঘ মেয়াদে ঋণ না হওয়া : মানুষের জীবন স্বল্পমেয়াদি। যেকোনো সময় মৃত্যু এসে যেতে পারে। আগামীকাল পর্যন্ত জীবিত থাকার যেখানে নিশ্চয়তা নেই, সেখানে দীর্ঘ মেয়াদি ঋণ নিয়ে তা পরিশোধ করতে পারার নিশ্চয়তা কোথায়? মানুষের জীবনের বাস্তবতা হাদিসে এভাবে প্রকাশিত হয়েছে। আবু সাঈদ খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত, একদা উসামা ইবন জায়েদ এক শ দিনার দিয়ে একটি হালাল প্রাণীর মাদি বাচ্চা কিনলেন এই আশায় যে এক মাস পর তা খাওয়ার যোগ্য হবে। রাসুলুল্লাহহ (সা.) শুনে বললেন, ‘এক মাস মেয়াদে খরিদকারী উসামাকে দেখে তোমরা কি অবাক হচ্ছো না? উসামা তো দীর্ঘ আশা পোষণকারী। যার হাতে আমার জীবন সেই আল্লাহর কসম! আমি চোখ মেলে তাকানোর পর ভাবি, হয়তো চোখের পাতা মিলিত হওয়ার আগেই আল্লাহ আমার প্রাণ কেড়ে নেবেন। একটা পেয়ালা মুখে তুলে পান করার পর ভাবি, হয়তো পেয়ালাটা নামানোর আগেই আমি মারা যাব। এক লোকমা খাবার মুখে নেওয়ার পর ভাবি, হয়তো ওটা গিলে খাওয়ার আগেই আমার মৃত্যু হয়ে যাবে। মহান আল্লাহর কসম! তোমাদের যার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে (কৃতকর্মের ফল লাভ ও হিসাব-নিকাশ) তা অবশ্যই পূর্ণ করা হবে। তোমরা কোনো ভাবেই তা প্রতিহত বা বন্ধ করতে পারবে না। ’ (শুয়াবুল ঈমান, হাদিস: ১০০৮০)
ঋণ পরিশোধে আন্তরিক হওয়া : বিশেষ প্রয়োজনে ঋণ গ্রহণ করলে যতদ্রুত সম্ভব তা পরিশোধ করতে চেষ্টা করতে হবে। আল্লাহর কাছে ঋণ পরিশোধের সামর্থ কামনা করতে হবে। ঋণ পরিশোধ করার সদিচ্ছা থাকলে এবং এ ব্যাপারে আন্তরিক হলে আল্লাহ তায়ালা তা পরিশোধ করার ব্যবস্থা করেন। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে মানুষের সম্পদ পরিশোধের নিয়তে (ঋণ) নেয়, আল্লাহ তার পক্ষ থেকে পরিশোধ করে দেন। আর যে আত্মসাতের উদ্দেশ্যে (ঋণ) নেয়, আল্লাহ তা ধ্বংস করে দেন। ’ (বুখারি, হাদিস: ২২৫৭)
ঋণ পরিশোধ করতে গড়িমসি না করা : সামর্থ্য থাকার পরও ঋণ পরিশোধ না করা বড় অন্যায়। সামর্থ্য থাকার পরও ঋণ পরিশোধে গড়িমসি করাকে নবী (সা.) জুলুম হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘সামর্থ্যবানদের পাওনা পরিশোধে গড়িমসি করা জুলুম। ’ (বুখারি, হাদিস: ২১৬৬; মুসলিম, হাদিস: ৪০৮৫)
ঋণদাতার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ : ঋণ প্রদান করার জন্য ঋণদাতার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা এবং তার জন্য দোয়া করা সুন্নত। এতে সে খুশি হয় এবং ঋণদানে উৎসাহ বোধ করে। আবদুল্লাহ ইবনে আবি রাবিয়া (রা.) থেকে বর্ণিত, হুনাইন যুদ্ধের সময় নবী (সা.) আমার কাছ থেকে ৩০ বা ৪০ হাজার (দিরহাম) ঋণ নিয়েছিলেন। যুদ্ধ থেকে ফিরে এসে তিনি তা পরিশোধ করেন এবং বলেন, ‘বারকাল্লাহু লাকা ফি আহলিকা ওয়া মালিকা’। (আল্লাহ তোমার পরিবারে ও সম্পদে বরকত দান করুন) ঋণের বিনিময় হলো, পরিশোধ ও কৃতজ্ঞতা। (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস: ১৬৪১০; নাসায়ি, হাদিস: ৪৬৮৩)
ঋণগ্রহীতার প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়া : ঋণগ্রহীতা বাস্তবিকই অসচ্ছল ও অভাবী হলে ঋণ দাতার উচিত ঋণগ্রহীতার প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়া। মহান আল্লাহ বলেন, ‘যদি অভাবগ্রস্ত হয় তাহলে সচ্ছলতা পর্যন্ত তাকে অবকাশ দেওয়া বিধেয়। আর যদি তোমরা ছেড়ে দাও তবে তা তোমাদের জন্য কল্যাণকর, যদি তোমরা জানতে। ’ (সুরা বাকারা, আয়াত: ২৮০)
হাদিসে বলা হয়েছে, আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি অভাবী ঋণগ্রস্তকে অবকাশ দেয় অথবা ক্ষমা করে দেয়, আল্লাহ তাকে কিয়ামতের দিন তাঁর আরশের নিচে আশ্রয় দেবেন যে দিন তাঁর আরশের ছায়া ছাড়া আর কোনো ছায়া থাকবে না। ’ (তিরমিজি, হাদিস : ১৩০৬)
ঋণগ্রহীতাকে কষ্ট না দেওয়া : খোঁটা বা অন্য কোনোভাবে ঋণগ্রহীতাকে কষ্ট দিলে ঋণ প্রদানের সাওয়াব নষ্ট হয়ে যেতে পারে। ঋণ দেওয়া অপেক্ষা ঋণপ্রার্থীর সঙ্গে সুন্দর কথা বলা ও দোয়া করাই উত্তম। আল্লাহ বলেন, ‘হে মুমিনরা, খোঁটা ও কষ্ট দিয়ে নিজেদের সদাকাকে সেই ব্যক্তির মতো নষ্ট কোরো না, যে নিজের সম্পদ ব্যয় করে মানুষকে দেখানোর জন্য এবং আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস রাখে না। সুতরাং তার দৃষ্টান্ত এ রকম—যেমন এক মসৃণ পাথরের ওপর মাটি জমে আছে, অতঃপর তাতে প্রবল বৃষ্টি পড়ে এবং সেটিকে (পুনরায়) মসৃণ পাথর বানিয়ে দেয়। এরূপ লোক যা উপার্জন করে তার কিছুই তাদের হস্তগত হয় না। আর আল্লাহ কাফেরদের হিদায়াতে উপনীত করেন না। ’ (সুরা বাকারা, আয়াত: ২৬৪)
নম্রতার সঙ্গে পাওনা চাওয়া : ঋণ পরিশোধের সময় হলে বা প্রয়োজনে আগেও পাওনা চাওয়া যায়। তবে সর্বাবস্থায় নম্রতার সঙ্গে চাওয়া উচিত। কঠোরতা, গালাগাল, ঝগড়া-বিবাদ থেকে বিরত থাকা উচিত। উত্তম চরিত্র মুমিনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। লেনদেন করতে উত্তম চরিত্রের প্রকাশ একান্ত কাম্য। জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘আল্লাহ এমন ব্যক্তির প্রতি রহমত বর্ষণ করেন যে নম্রতার সঙ্গে ক্রয়-বিক্রয় করে ও পাওনা ফিরিয়ে চায়। ’ (বুখারি, হাদিস : ১৯৭০)
পরিশেষে বলা যায়, মানুষের একার পক্ষে সব সময় সব প্রয়োজন পূরণ সম্ভব হয় না। অনেক ক্ষেত্রে পরস্পরকে সাহায্য করতে হয়। প্রয়োজনে ঋণের আদান-প্রদান হয়। বিশেষ প্রয়োজনে কেউ ঋণ চাইলে সামর্থ্য থাকলে এবং সমীচীন মনে হলে ঋণ দেওয়া উচিত। আবার ঋণগ্রহীতারও ঋণ পরিশোধে আন্তরিক হওয়া উচিত।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, আরবি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
(কৃতজ্ঞতা: কালের কণ্ঠ)