১১০ বছরের ‘ঔপনিবেশিক বৈরিতা’ নিয়ে ফ্রান্স-মরক্কো মুখোমুখি

::
প্রকাশ: ২ years ago

পাবলিক রিঅ্যাকশন ডেস্ক:
ফ্রান্সের উপনিবেশ ছিল মরক্কো। প্রায় শত বছরের ইতিহাসে প্রীতি ম্যাচ এবং প্রদর্শনী ম্যাচের বাইরে দুই দল আন্তর্জাতিক ফুটবলে প্রথমবার মুখোমুখি হচ্ছে। দুই দেশের রয়েছে দীর্ঘ এবং জটিল রাজনৈতিক ইতিহাস। ভূমধ্যসাগর দ্বারা বিচ্ছিন্ন দেশ দুটির মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই বললেই চলে। ১৯১২ সালে প্রথম ‘ফেজ চুক্তি’ স্বাক্ষরিত হওয়ার পর থেকে মরক্কো বিভক্ত হয়ে ফ্রান্স ও স্পেনের আশ্রিত রাজ্যে পরিণত হয়েছিল। এর পর ৪৪ বছর ফরাসিরা দেশটিকে শাসন করে। ১৯৫৬ সালে মরক্কো স্বাধীনতা অর্জন করে।

ফ্রান্সের ইনস্টিটিউট অফ স্ট্যাটিস্টিকস অ্যান্ড ইকোনমিক স্টাডিজের তথ্যমতে, মরক্কোর প্রায় আট লাখ মানুষ ফ্রান্সে অভিবাসী হিসেবে রয়েছেন। সম্প্রতি ম্যাক্রোঁ সরকার মরক্কো নাগরিকদের ভিসা দেওয়ার বিধিনিষেধ চালু করেছে। ফলে মরক্কোর নাগরিকদের জন্য ফ্রান্সে থাকা আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে দেখা করা কঠিন হয়ে পড়েছে।

বিশ্বকাপের ইতিহাসে মরক্কো এবারই প্রথম সেমিফাইনালে উঠেছে। ফ্রান্সের বিপক্ষে অতিরিক্ত অনুপ্রেরণা হিসেবে অতীত ইতিহাস প্রেরণা দিচ্ছে। দীর্ঘ সময়ে চলমান বঞ্চনার শোধ নেওয়ারও সুযোগ মনে করা হচ্ছে।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ফ্রান্স সেনাবাহিনীতে প্রায় ৪০ হাজার মরক্কান নিয়োগ করা হয়েছিল। তখন থেকেই ফ্রান্সের বিরুদ্ধে উপনিবেশবিরোধী অসন্তোষ বাড়তে থাকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে অনেক দেশ ইউরোপীয় উপনিবেশ থেকে স্বাধীনতা অর্জন করে। এরই ধারাবাহিকতায়, ১৯৪৪ সালে মরক্কোর নবগঠিত ‘ইস্তিকলাল পার্টি’ দেশটির স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়। ১৯৫২ সালে মরক্কোর ক্যাসাব্লাঙ্কায় উপনিবেশবিরোধী বিদ্রোহ হয়। ওই বিদ্রোহ কঠোরভাবে দমন করে মরক্কোর কমিউনিস্ট এবং ইস্তিকলাল দলগুলোকে বেআইনি ঘোষণা করে ফরাসি সরকার।

সুলতান পঞ্চম মোহাম্মদকে মাদাগাস্কারে নির্বাসিত করার ফলে উপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে মরক্কোর জনগণ। পরে তাকে মরক্কোতে ফিরে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়। এরপর ১৯৫৫ সালের ১৮ নভেম্বর সুলতান পঞ্চম মোহাম্মদ মরক্কোর স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। ১৯৫৬ সালের মার্চ মাসে ফ্রান্স থেকে মরক্কো পুরোপুরি স্বাধীনতা লাভ করে।

স্বাধীনতার পর, কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক অংশীদারের মাধ্যমে দেশটির সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে বেশ কয়েকটি দেশীয় নীতি প্রয়োগ করা হয়েছিল। ১৯৭৩ সালে রাজা দ্বিতীয় হাসান ৫০ শতাংশ করে দেশি-বিদেশি মালিকানায় অর্থনৈতিক সংস্কারধারা প্রণয়ন করেন। ১৯৮০ সালে মরক্কো রাজা ফরাসি থেকে আরবি ভাষা শিক্ষার উপর গুরুত্ব দেন। মরক্কোর প্রথম বিদেশি বিনিয়োগকারী হিসেবে ফ্রান্স দেশটির বাণিজ্যিক অংশীদারিত্ব লাভ করে। এরপর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখার চেষ্টা চালায় দুই দেশ। বেশ কয়েকটি উচ্চ পর্যায়ের কূটনৈতিকসভা অনুষ্ঠিত হয়।

২০০৭ সালে ফ্রান্সের রাষ্ট্রপতি নিকোলাস সারকোজি রাষ্ট্রীয় সফরে মরক্কো যান। ওই সময় তিনি ফ্রান্সের অর্থায়নে উচ্চ গতিসম্পন্ন ট্রেন সার্ভিস চালু করেন। এর দুই মাস পর আন্তর্জাতিক ফুটবল প্রীতি ম্যাচে অংশ নেয় দুই দেশ। ম্যাচটি ২-২ গোলে ড্র হয়।

২০১৪ সালে নির্যাতনের অভিযোগে মরক্কোর অভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান আবদেলাতিফ হাম্মুচিকে জিজ্ঞাসাবাদ করে ফ্রান্স। এর ফলে ফ্রান্সের সঙ্গে সব ধরনের বিচারিক সহযোগিতা স্থগিত করে মরক্কো। এর পরের বছর কূটনৈতিক উত্তেজনা হ্রাস পেলে আবার সহযোগিতার পরিবশে তৈরি হয় দেশদুটির মধ্যে।

২০১৮ সালে মরক্কোর রাজা ষষ্ঠ মোহাম্মদ ও ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ টাঙ্গিয়ার-রাবাতের মধ্যে উচ্চগতির রেলসংযোগের উদ্বোধন করেন। এমনিভাবে এই দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের উত্থান-পতন হয়। চলতি বছরের শুরুতে পশ্চিম সাহারার স্বায়ত্তশাসনের পরিকল্পনাকে সমর্থন করেছিলেন ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ। পশ্চিম সাহারা পলিসারিও ফ্রন্ট দীর্ঘদিন ধরে একটি আন্দোলন করে মরক্কো থেকে তাদের স্বাধীনতা চেয়ে আসছে।

সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ২০২০ সালের ডিসেম্বরে ওই বিতর্কিত ভূখণ্ডে মরক্কোর সার্বভৌমত্বকে স্বীকৃতি দিলে ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ সেই সিদ্ধান্ত নিয়ে চুপ থাকেন।

 

আরও পড়ুন: ফ্রান্স বনাম মরক্কো: বিশ্লেষণ, প্রেডিকশন ও অন্যান্য রেকর্ড

 

২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে ফ্রান্স সরকার ঘোষণা দেয়, তারা মরক্কো ও আলজেরিয়ান নাগরিকদের জন্য ৫০ শতাংশ এবং তিউনিসিয়ানদের জন্য দুই-তৃতীয়াংশ ভিসা কমিয়ে দেবে। এর ফলে দেশগুলোর সঙ্গে ফ্রান্সের সম্পর্ক খারাপ হয়।

ফরাসি সরকার বলেছে, এটি উত্তর আফ্রিকার সরকারগুলোর সঙ্গে ফরাসিদের পাঠানো আশ্রয়প্রার্থীদের ফিরিয়ে নিতে অস্বীকার করার প্রতিক্রিয়া। মরক্কোর পররাষ্ট্রমন্ত্রী নাসের বোরিতা এই পদক্ষেপকে ‘অযৌক্তিক’ বলে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, ফ্রান্স থেকে বহিষ্কৃত মরোক্কানদের জন্য ৪০০ কনস্যুলার নথি জারি করেছিলেন। তারা ফ্রান্সে প্রবেশে কভিড-১৯ বাধ্যতামূলক পরীক্ষা দিতে অস্বীকার করেছিল। তবে এটাকে তিনি ‘ফ্রান্সের সমস্যা’ বলে চিহ্নিত করেছিলেন। ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে ম্যাক্রোঁর রাবাতে যাওয়ার কথা রয়েছে।

উভয় দেশ তাদের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের গুরুত্ব স্বীকার করলেও দুই দেশের ফুটবল দল একটি ঐতিহাসিক বিশ্বকাপ সেমিফাইনালের মুখোমুখি হবে। উভয়পক্ষের জন্য কঠিন ম্যাচ হতে পারে। যে ম্যাচের উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়তে পারে প্রতিবেশি দুই দেশের রাজনীতিতে।

 

ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকার
স্বাধীনতার পর মরক্কো একাধিক নীতি বাস্তবায়ন করে, যাতে ফ্রান্সের প্রভাব থেকে বের হওয়া যায়। একইসঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক অংশীদার হিসেবে ফ্রান্সের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখা হয়।

১৯৭৩ সালে বাদশাহ হাসান দ্বিতীয় একাধিক অর্থনৈতিক সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়ন করেন। এতে বেসরকারি খাতে ৫০ শতাংশের বিদেশি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানকে রাষ্ট্রীয়করণ করা হয়। এগুলোর বেশিরভাগের মালিকানা ছিল ফ্রান্সের।

আশির দশকে বাদশাহ বাস্তবায়ন করেন আরবিকরণ নীতি। এর আওতায় দেশটির স্কুল ব্যবস্থা ফরাসি ভাষার বদলে আরবিতে চালু হয়। ত্রিশ বছর পর এই নীতি সংশোধন করে মাধ্যমিক স্কুলের গণিত, বিজ্ঞান ও পদার্থ বিষয়ের জন্য ফরাসি ভাষায় শিক্ষাদানে ফিরে যাওয়া হয়।

ফ্রান্স এখনও মরক্কোর প্রধান বিদেশি বিনিয়োগকারী, বাণিজ্যিক অংশীদার। ফলে দেশ দুটি বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখে আসছে।

মরক্কো সফরে সাবেক ফরাসি প্রেসিডেন্ট সারকোজি। ছবি: রয়টার্সমরক্কো সফরে সাবেক ফরাসি প্রেসিডেন্ট সারকোজি। ছবি: রয়টার্স

২০০৭ সালে তৎকালীন ফরাসি প্রেসিডেন্ট নিকোলাস সারকোজি মরক্কো সফর করেন। আর বোরাক নামের দ্রুতগতির ট্রেন সেবার কাজ পরিদর্শন করেন তিনি। এই প্রকল্পে ৫১ শতাংশ অর্থায়ন করে ফ্রান্স।

দুই মাস আগে মরক্কো ও ফ্রান্স একটি আন্তর্জাতিক প্রীতি ফুটবল ম্যাচ খেলে ফ্রান্সে। ওই ম্যাচ ২-২ গোলে ড্র হয়েছিল।

২০১৪ সাল থেকে দুই দেশের সম্পর্কে জটিলতা বাড়তে শুরু করে। মরক্কোর অভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান আব্দেললতিফ হামৌচিকে ফ্রান্স জিজ্ঞাসাবাদ করতে চেয়েছিল। এর ফলে মরক্কো দেশটির সঙ্গে বিচারিক সহযোগিতা স্থগিত করে। এক বছর পর কূটনৈতিক উত্তেজনা নিরসন হয় এবং দেশ দুটি পুনরায় সহযোগিতায় ফিরে।

২০১৮ সালে বাদশাহ মোহাম্মদ ষষ্ঠ ও ফরাসি প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাক্রোঁ একটি নতুন উচ্চগতির ট্রেনের উদ্বোধনী সফরে ছিলেন একসঙ্গে।

 

জটিলতা
বিভিন্ন সময় দেশ দুটির সম্পর্কে উত্থান-পতন ছিল। এই বছরের শুরুতে পশ্চিম সাহারাকে মরক্কো নিজের অংশ বলে যে দাবি করে আসছে, সেটির প্রতি সমর্থন জানান ম্যাক্রোঁ। পশ্চিম সাহারার পোলিসারিও ফ্রন্ট দীর্ঘদিন ধরে মরক্কোর কাছ থেকে স্বাধীনতা দাবি করে আসছে।

প্যারিসে মরক্কোর জয় উদযাপন আলজেরীয়দের। ছবি: রয়টার্সপ্যারিসে মরক্কোর জয় উদযাপন আলজেরীয়দের। ছবি: রয়টার্স

ম্যাক্রোঁর আগে ২০২০ সালের ডিসেম্বরে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বিতর্কিত অঞ্চলের ওপর মরক্কোর মালিকানাকে স্বীকৃতি দেন। কিন্তু বর্তমান মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এই অবস্থান বদলে ফেলেছেন।

কিন্তু ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে সম্পর্কে আবারও জটিলতা দেখা দেয়। ওই সময় ফরাসি কর্তৃপক্ষ ঘোষণা করে, মরক্কো ও আলজেরিয়ার নাগরিকদের ভিসা প্রদানের হার ৫০ শতাংশ কমিয়ে আনা হবে।

ফরাসি সরকার বলছে, উত্তর আফ্রিকার সরকারগুলো নিজেদের রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থীদের ফিরিয়ে নিতে অস্বীকৃতি জানানোর ফলেই এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।

মরক্কোর পররাষ্ট্রমন্ত্রী নাসের বৌরিটা এই পদক্ষেপকে ‘অন্যায্য’ বলে উল্লেখ করেছেন।

ফ্রান্স ও মরক্কো পরস্পরের সম্পর্কের গুরুত্ব অনুধাবন করে, এটি স্পষ্ট। ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে মরক্কো সফরের পরিকল্পনা রয়েছে ম্যাক্রোঁর। কিন্তু এর আগে ঐতিহাসিক বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে দুই দল মুখোমুখি হচ্ছে।

ইতিহাস যদি পদনির্দেশক হয়, তাহলে কোনও পক্ষের জন্য ম্যাচটি সহজ হবে না।

 

সূত্র: আল জাজিরা