জাতীয় ভোটার দিবস: গণতন্ত্রের শক্তি ও আমাদের দায়িত্ব

:: মোহাম্মদ ছৈয়দুল আলম ::
প্রকাশ: ৭ দিন আগে

জাতীয় ভোটার দিবস একটি গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যপূর্ণ দিন, যা নাগরিকদের গণতান্ত্রিক অধিকার সম্পর্কে সচেতন করে এবং তাদের ভোটাধিকার চর্চায় উদ্বুদ্ধ করে। ২ মার্চ বাংলাদেশে জাতীয় ভোটার দিবস পালিত হয়, যা বিশেষভাবে নতুন ভোটারদের উদ্বুদ্ধ করে এবং নির্বাচনী প্রক্রিয়ার প্রতি জনগণের আস্থা বাড়াতে সহায়তা করে।

২০১৯ সাল থেকে বাংলাদেশ সরকার এই দিনটিকে জাতীয় ভোটার দিবস হিসেবে ঘোষণা করেছে, যা দেশের গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রার একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। এই দিবসটি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, গণতন্ত্র কেবল একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থা নয়, এটি নাগরিকদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ও দায়িত্ববোধের মাধ্যমেই সঠিকভাবে কার্যকর হতে পারে।

ভোট প্রদান: অধিকার ও দায়িত্ব:
ভোট একটি মৌলিক গণতান্ত্রিক অধিকার, যা সুশাসন ও অংশগ্রহণমূলক রাজনৈতিক ব্যবস্থার ভিত্তি রচনা করে। এটি কেবলমাত্র একটি অধিকার নয়, বরং নাগরিকদের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বও বটে। একটি শক্তিশালী গণতান্ত্রিক কাঠামোর জন্য সচেতন ও দায়িত্বশীল ভোটার অপরিহার্য।

ভোট প্রদান গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রাণশক্তি। এটি এমন একটি প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে জনগণ তাদের প্রতিনিধি নির্বাচন করে এবং রাষ্ট্র পরিচালনার অংশীদার হয়। প্রতিটি নাগরিকের নৈতিক দায়িত্ব হলো যোগ্য প্রার্থীকে ভোট প্রদান করা এবং ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে দেশের সঠিক নেতৃত্ব নির্ধারণ করা।

ভোট দেওয়া মানে শুধু একটি প্রক্রিয়ায় অংশ নেওয়া নয়, বরং এটি রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারণে জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণের অন্যতম মাধ্যম। ভোটের মাধ্যমে জনগণ সরকারকে জবাবদিহির আওতায় নিয়ে আসতে পারে এবং ন্যায়ভিত্তিক ও গ্রহণযোগ্য শাসন প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখতে পারে।

বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন এই দিনটি উদযাপনের মাধ্যমে নতুন ও তরুণ ভোটারদের নিবন্ধন, ভোটাধিকার ব্যবহারের গুরুত্ব এবং স্বচ্ছ নির্বাচন সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করে। বর্তমানে প্রযুক্তির ব্যবহারের ফলে ভোটার নিবন্ধন প্রক্রিয়া সহজ হয়েছে। স্মার্ট জাতীয় পরিচয়পত্র এবং বায়োমেট্রিক তথ্যভিত্তিক নিবন্ধন ব্যবস্থা ভোটারদের জন্য নিরাপদ ও কার্যকর পরিচয় নিশ্চিত করছে। তবে, এখনো অনেক মানুষ বিশেষত প্রান্তিক জনগোষ্ঠী ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হতে নানা চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হন। সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের স্বার্থে নির্বাচন কমিশনকে আরও উদ্যোগী হয়ে জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।

ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে সাধারণ মানুষের করণীয়:
সচেতন ও দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে ভোটার তালিকায় নাম নিবন্ধন করা। ভোটাধিকার প্রয়োগের গুরুত্ব বোঝা এবং সঠিক তথ্যের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেওয়া।

যোগ্য ও সৎ প্রার্থী নির্বাচন করা এবং ভোট প্রদানের মাধ্যমে গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করা। নির্বাচন সংক্রান্ত ভুল তথ্য ও গুজব থেকে দূরে থাকা এবং অন্যদের সচেতন করা। নির্বাচন প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও প্রশাসনের সঙ্গে সহযোগিতা করা।

নির্বাচন কমিশনের করণীয়:
সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করতে শক্তিশালী পদক্ষেপ নেওয়া। ভোটার তালিকা হালনাগাদ করা ও ভোটার নিবন্ধন প্রক্রিয়াকে আরও সহজ করা। ভোটারদের সচেতন করতে গণমাধ্যম ও ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করা। বিশেষত নারী, প্রতিবন্ধী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ভোটাধিকারের সুবিধা নিশ্চিত করা। ভোট কেন্দ্রে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং অনিয়ম প্রতিরোধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

রাষ্ট্রপক্ষের করণীয়:
গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার সংরক্ষণে নীতিগত সহায়তা প্রদান। নির্বাচনের সময় আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখতে কার্যকর ভূমিকা পালন করা। শিক্ষা ও প্রচারের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করা। তরুণদের মধ্যে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ গড়ে তুলতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভোটাধিকার বিষয়ে সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করা। নির্বাচন ব্যবস্থার স্বচ্ছতা বজায় রাখতে নিরপেক্ষ প্রশাসনিক সহায়তা প্রদান করা।

বিভিন্ন সংস্থার করণীয়:
নাগরিক সমাজ ও এনজিওগুলোকে ভোটার সচেতনতা কার্যক্রম পরিচালনায় সহায়তা করা। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতে নির্বাচন পর্যবেক্ষণের ব্যবস্থা করা। গণমাধ্যমের মাধ্যমে ভোটাধিকার ও নির্বাচন প্রক্রিয়া সম্পর্কে তথ্য প্রচার করা। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সুস্থ প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করতে উদ্যোগ নেওয়া। তরুণদের মধ্যে ভোটদানের আগ্রহ সৃষ্টি করতে কর্মশালা ও প্রচার কার্যক্রম পরিচালনা করা।

গণতন্ত্র সুসংহত করতে সবার ভূমিকা:
ভোটাধিকার কেবল ব্যক্তিগত অধিকার নয়, এটি গণতান্ত্রিক সমাজ গঠনের অন্যতম প্রধান ভিত্তি। একজন সচেতন ভোটারই পারে দেশকে উন্নয়নের পথে এগিয়ে নিতে। তাই ভোটাধিকার প্রয়োগে উদাসীনতা নয়, বরং সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক চর্চাকে শক্তিশালী করতে হবে। নির্বাচন কমিশন, রাষ্ট্রপক্ষ, রাজনৈতিক দল এবং সাধারণ নাগরিক-সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে, যাতে নির্বাচন সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ হয়।

ভোটাধিকার নিয়ে উদাসীনতা, ভীতি বা অনীহা গণতন্ত্রকে দুর্বল করে। কিছু নাগরিক ভোট দিতে না যাওয়ার কারণে অযোগ্য বা অনৈতিক প্রার্থীরা বিজয়ী হতে পারে। তাই প্রতিটি নাগরিকের উচিত দায়িত্বশীলভাবে ভোটদান করা এবং অন্যদেরও ভোট দিতে উৎসাহিত করা।

জাতীয় ভোটার দিবস কেবল আনুষ্ঠানিকতা নয়, এটি গণতন্ত্রের প্রতি আমাদের অঙ্গীকারের প্রতিফলন। এটি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, গণতন্ত্র টিকিয়ে রাখতে হলে সক্রিয় নাগরিক হিসেবে আমাদের দায়িত্ব পালন করতে হবে। তাই, আসুন, আমরা সবাই ভোটাধিকার প্রয়োগে সচেতন হই এবং দেশকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য সঠিক নেতৃত্ব নির্বাচনে ভূমিকা রাখি।

লেখক: মোহাম্মদ ছৈয়দুল আলম, সাংবাদিক ও গবেষক।

 


[প্রিয় পাঠক, পাবলিক রিঅ্যাকশনের প্রায় প্রতিটি বিভাগে আপনিও লিখতে পারেন। আপনার অনুভূতির কথা আমাদের লিখে পাঠান। ছবিসহ মেইল করুন opinion2mail@gmail.com এই ঠিকানায়। যে কোনো খবর, ভ্রমণ, আড্ডা, গল্প, স্মৃতিচারণসহ যে কোনো বিষয়ে লিখে পাঠাতে পারেন। পাঠকের লেখা আমাদের কাছে সবসময়ই গুরুত্বপূর্ণ।]