হযরত মালেক শাহ’র আধ্যাত্মিক দিগন্ত: বার্ষিক ওরশ ১৮-১৯ ফেব্রুয়ারি

:: মোহাম্মদ ছৈয়দুল আলম ::
প্রকাশ: ৫ দিন আগে

বাংলাদেশের উপকূলীয় দ্বীপ কুতুবদিয়া শুধু প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে সমৃদ্ধ নয়, এটি আধ্যাত্মিক ইতিহাসেও এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান। এখানেই চিরনিদ্রায় শায়িত আধ্যাত্মিক আউলিয়া, সুফি দরবেশ, গাউসে জামান, মুজাদ্দিদে ওয়াক্ত, হযরত গাউসে মুখতার আল্লামা আবদুল মালেক শাহ্ আল কুতুবী মুহিউদ্দিন আজমী (রহ.)।

তাঁর জীবন ও কর্ম ইসলামের প্রকৃত আদর্শ, সুফিবাদের মহৎ শিক্ষা এবং মানবতার কল্যাণের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তাঁর দরবার শরীফ ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের জন্য আধ্যাত্মিক সাধনার এক পবিত্র স্থান।

দুনিয়াবী মোহবিহীন জীবন ও আধ্যাত্মিক সাধনা: হযরত আবদুল মালেক শাহ্ আল কুতুবী (রহ.) ছিলেন দুনিয়াবী মোহ-মায়া থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন একজন আউলিয়া। তিনি অপার দয়ালু, নিরহংকারী ও নির্মোহ মানুষ ছিলেন। তিনি বেশিরভাগ সময় খালি গায়ে থাকতেন এবং খুবই কম আহার গ্রহণ করতেন। তাঁর জীবনের একমাত্র লক্ষ্য ছিল আল্লাহর ইবাদত করা ও মানবতার কল্যাণে কাজ করা। তিনি নিজেকে সবসময় সাধারণ মানুষের কাতারে রেখেছেন এবং দরিদ্র-অসহায়দের পাশে দাঁড়িয়েছেন।

শিক্ষা জীবন: শৈশব থেকেই হযরত আবদুল মালেক শাহ্ আল কুতুবী (রহ.) কুরআন ও হাদিস অধ্যয়নে গভীর মনোনিবেশ করেন। তিনি ইসলামী শিক্ষা ও সুফিবাদের জ্ঞান অর্জনের জন্য দেশ-বিদেশের বিভিন্ন আলেম ও সুফি দরবেশদের সান্নিধ্যে থেকেছেন। বিশেষত তিনি তাসাউফ ও আত্মশুদ্ধির গভীর প্রশিক্ষণ লাভ করেন এবং তাঁর আধ্যাত্মিক জ্ঞান দ্বারা অসংখ্য ভক্ত ও অনুসারীকে ইসলামের সঠিক পথের দিশা দেখান।

পুত্র সন্তানগণ: হযরত আবদুল মালেক শাহ্ আল কুতুবী (রহ.)-এর সাতজন পুত্র সন্তান রয়েছেন, যাঁরা তাঁর আধ্যাত্মিক শিক্ষা ও তরিকতের ধারক ও বাহক।

নারী-পুরুষের পৃথক এবাদত ব্যবস্থা ও প্রবেশ নীতি: কুতুব শরীফ দরবারে নারী-পুরুষের জন্য পৃথক এবাদতের ব্যবস্থা রয়েছে। বিশেষ করে বার্ষিক ওরশ উপলক্ষে মহিলাদের কুতুব শরীফ দরবারে বা ওরশে না আসার জন্য কর্তৃপক্ষ নিয়মিতভাবে প্রচারণা চালিয়ে আসছেন। দরবারে প্রবেশে নারী ও পুরুষদের জন্য আলাদা স্থান নির্ধারণ করা হয়েছে, যাতে ধর্মীয় বিধান ও শৃঙ্খলা বজায় থাকে।

বার্ষিক ওরশ ও মাসিক ফাতেহা: হযরত আবদুল মালেক শাহ্ আল কুতুবী (রহ.)-এর স্মরণে প্রতিবছর তাঁর দরবার শরীফে এক বিশাল ওরশ শরীফের আয়োজন করা হয়, যেখানে দেশ-বিদেশ থেকে আগত ভক্তরা অংশগ্রহণ করেন। ১৮ ও ১৯ ফেব্রুয়ারী বার্ষিক ওরশ অনুষ্ঠিত হবে। এই দুই দিনব্যাপী বিশাল মাহফিলে দেশ বরেণ্য ওলামায়ে কেরামগণ উপস্থিত হয়ে তাফসির পেশ করেন, ওয়াজ ও আধ্যাত্মিক আলোচনায় অংশ নেন। এতে হাজার হাজার ধর্মপ্রাণ মুসলমান ইবাদত-বন্দেগিতে লিপ্ত থাকেন এবং আল্লাহর রহমত লাভের জন্য বিশেষ দোয়া করেন।

তবে শুধু বার্ষিক ওরশই নয়, প্রতি আরবি মাসের ১২ তারিখে মাসিক ফাতেহার আয়োজন করা হয়। এই দিনে কুতুব শরীফ দরবারে দেশ ও বিদেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ভক্তবৃন্দ ছুটে আসেন। ফাতেহা শরীফ উপলক্ষে দরবারে কোরআন তিলাওয়াত, জিকির-আসকার, মিলাদ মাহফিল, বিশেষ দোয়া ও মোনাজাত অনুষ্ঠিত হয়। এতে অসংখ্য ধর্মপ্রাণ মানুষ অংশগ্রহণ করে তাঁদের মানত পূরণ করেন এবং বারাকাত লাভের জন্য বিশেষ দোয়া করেন।

যোগাযোগ ব্যবস্থা ও নিরাপত্তার উন্নয়ন: কুতুব শরীফ দরবারে লক্ষ লক্ষ ভক্তদের সমাগম ঘটে, যার ফলে যোগাযোগ ব্যবস্থা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সরকার ও প্রশাসনের প্রতি আহ্বান, যাতে কুতুবদিয়ার সড়ক ও নৌপথ আরও উন্নত করা হয় এবং ভক্তদের যাতায়াতে সুবিধা নিশ্চিত করা হয়। বিশেষ করে, কুতুবদিয়ার অভ্যন্তরীণ সড়কগুলো সংস্কার, ফেরি সার্ভিস বৃদ্ধি, পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা ও পর্যটকদের জন্য বিশ্রামাগার স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। পাশাপাশি, ওরশ ও অন্যান্য ধর্মীয় সমাবেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সক্রিয় উপস্থিতি নিশ্চিত করা দরকার, যাতে ভক্তদের যাত্রা নির্বিঘ্ন ও নিরাপদ হয়।

সুফিবাদ ও আধ্যাত্মিক জীবন: হযরত আবদুল মালেক শাহ্ আল কুতুবী (রহ.) ছিলেন একজন প্রকৃত সুফি আউলিয়া, যিনি জীবনভর ইবাদত-বন্দেগি, জিকির-আসকার, ধ্যান ও মানবতার কল্যাণে আত্মনিয়োগ করেছিলেন। তাঁর শিক্ষার মূল প্রতিপাদ্য ছিল আত্মশুদ্ধি, আল্লাহর প্রেম ও মানবসেবা। তিনি তরিকতের পথ অনুসরণ করে অগণিত ভক্তদের আধ্যাত্মিক দীক্ষা দিয়েছেন এবং ইসলামের শান্তি ও সহনশীলতার বাণী প্রচার করেছেন।

কুতুবদিয়ার কুতুব শরীফ দরবার শুধু ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতার স্থান নয়, এটি এক আধ্যাত্মিক কেন্দ্র যেখানে মানুষ শান্তি ও সঠিক পথের দিশা খুঁজে পায়। হযরত আবদুল মালেক শাহ্ আল কুতুবী (রহ.)-এর শিক্ষা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, প্রকৃত ইবাদত কেবল নামাজ-রোজায় সীমাবদ্ধ নয়, বরং আল্লাহর প্রেম, মানবসেবা ও আত্মশুদ্ধির মধ্যেই নিহিত।