শবে বরাত: রহমত, মাগফিরাত ও আত্মশুদ্ধির মহিমান্বিত রাত

:: মোহাম্মদ ছৈয়দুল আলম ::
প্রকাশ: ১ সপ্তাহ আগে

ইসলামি বর্ষপঞ্জির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রাত শবে বরাত। এটি লাইলাতুল বরাত নামেও পরিচিত, যা আরবি শব্দ “লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান” থেকে উদ্ভূত, যার অর্থ শাবান মাসের মধ্যবর্তী রাত। ২০২৫ সালে শবে বরাত পালিত হবে যথারীতি গভীর ভাবগাম্ভীর্যের মধ্য দিয়ে, যা মুসলমানদের আত্মশুদ্ধি, ক্ষমাপ্রার্থনা ও ইবাদতের অনন্য সুযোগ এনে দেয়। এই রাত বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, ইরান, তুরস্কসহ বিভিন্ন মুসলিমপ্রধান দেশে পালিত হয়।

শবে বরাত কেন চালু করা হয়?
শবে বরাত মূলত আল্লাহর রহমত ও ক্ষমা লাভের জন্য চালু করা হয়। ইসলামি বর্ণনায় পাওয়া যায়, এই রাতে মহান আল্লাহ বান্দাদের গুনাহ মাফ করেন এবং তাদের জন্য তাকদির নির্ধারণ করেন। নবী করিম হযরত মুহাম্মদ (সা.) শাবান মাসকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিতেন এবং বিশেষভাবে ১৫ শাবানের রাত ইবাদতে কাটাতেন। সাহাবিগণও এই রাতের গুরুত্ব উপলব্ধি করে ইবাদতে ব্যস্ত থাকতেন। শবে বরাত আত্মশুদ্ধির এক মহিমান্বিত রাত, যেখানে মুসলমানরা অতীত জীবনের ভুলত্রুটি সংশোধনের সুযোগ পান এবং ভবিষ্যতে সৎ পথে চলার প্রতিজ্ঞা করেন।

শবে বরাত কখন থেকে শুরু হয়?
শবে বরাত ইসলামি চান্দ্র বর্ষপঞ্জির শাবান মাসের ১৪ তারিখের রাত অর্থাৎ ১৫ শাবানের সূর্যাস্তের পর শুরু হয় এবং পুরো রাত ধরে চলে। এই রাতটি মাগরিব নামাজের পর শুরু হয়ে ফজরের আগ পর্যন্ত স্থায়ী থাকে। এটি এমন একটি মুহূর্ত, যখন মুসলমানরা ইবাদত-বন্দেগিতে লিপ্ত হয় এবং আল্লাহর রহমত ও ক্ষমার আশায় রাত জাগে।

শবে বরাত কত হিজরি থেকে শুরু হয়েছে?
শবে বরাত পালনের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট নিয়ে বিভিন্ন মতামত রয়েছে। তবে বেশিরভাগ ইসলামি পণ্ডিত ও ইতিহাসবিদরা মনে করেন, এটি হিজরি দ্বিতীয় শতাব্দী থেকে পালন হয়ে আসছে। কিছু বর্ণনায় পাওয়া যায় যে, নবী করিম হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর সময় থেকেই শাবান মাসের মধ্যরাত বিশেষ গুরুত্ব বহন করত এবং তাঁর সাহাবিরাও এটি পালন করতেন। পরবর্তীতে ইসলামের বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে এটি মুসলিম বিশ্বে ব্যাপকভাবে প্রচলিত হয়।

দ্বিতীয় শতাব্দী এই দীর্ঘ সময় ধরে শবে বরাত মুসলিম বিশ্বে বিশেষ গুরুত্ব বহন করে আসছে এবং আত্মশুদ্ধি ও ইবাদতের রাত হিসেবে স্বীকৃত হয়েছে।

শবে বরাতের তাৎপর্য:
শবে বরাত মূলত আল্লাহর করুণা ও ক্ষমার রাত। হাদিসে বর্ণিত আছে, এই রাতে মহান আল্লাহ তাঁর বান্দাদের প্রতি বিশেষ দয়া বর্ষণ করেন এবং তাদের পাপ মোচনের সুযোগ প্রদান করেন। এই রাতে বিশ্বব্যাপী মুসলমানরা বিশেষ নামাজ, কোরআন তিলাওয়াত, জিকির-আজকার ও দোয়ার মাধ্যমে তাদের সৃষ্টিকর্তার নৈকট্য লাভের চেষ্টা করেন। অনেকে রোজা রাখার প্রস্তুতিও গ্রহণ করেন, কারণ প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) শাবান মাসে অধিক পরিমাণে নফল রোজা রাখতেন।

শবে বরাতের গুরুত্ব:
শবে বরাত আত্মশুদ্ধি, আত্মবিশ্বাস ও আত্মসমালোচনার এক অনন্য সুযোগ। এই রাতে মুসলমানরা তাদের অতীতের ভুলত্রুটি স্বীকার করে ভবিষ্যতে ভালো কাজের সংকল্প গ্রহণ করে। আল্লাহর রহমত লাভের জন্য ইবাদত করা এবং পরিবারের জন্য দোয়া করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই রাতে আল্লাহ মানুষের তাকদির নির্ধারণ করেন বলে অনেক হাদিসে উল্লেখ আছে। তাই, এই রাতকে গুরুত্বসহকারে গ্রহণ করে যথাযথ ইবাদত করা প্রয়োজন।

শবে বরাতের পর থেকে রমজান শুরু পর্যন্ত আমাদের করণীয়:
শবে বরাতের পর থেকে রমজান মাস শুরু হওয়া পর্যন্ত মুসলমানদের জন্য এটি আত্মশুদ্ধি ও প্রস্তুতির সময়। শাবান মাসের অবশিষ্ট দিনগুলোতে তারা নিজেদের রমজানের জন্য মানসিক, শারীরিক ও আধ্যাত্মিকভাবে প্রস্তুত করতে পারেন। নিম্নে কিছু করণীয় উল্লেখ করা হলো:

নফল রোজা পালন: নবী করিম (সা.) শাবান মাসে বেশি পরিমাণে নফল রোজা রাখতেন। তাই, মুসলমানদের উচিত এই মাসে নফল রোজা রাখা, যাতে রমজানের দীর্ঘ রোজার জন্য প্রস্তুতি নেওয়া যায়।

কোরআন তিলাওয়াত বৃদ্ধি: শবে বরাতের পর থেকে রমজান মাস পর্যন্ত বেশি পরিমাণে কোরআন তিলাওয়াত করা উচিত, যাতে রমজানে নিয়মিত কোরআনের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকা সহজ হয়।

ইবাদতের অভ্যাস গড়ে তোলা: নিয়মিত তাহাজ্জুদ নামাজ আদায় করা, নফল ইবাদত বৃদ্ধি করা এবং অধিক পরিমাণে জিকির-আজকার করা উচিত।

তওবা ও ইস্তিগফার: আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা এবং অতীতের পাপের জন্য অনুশোচনা করা গুরুত্বপূর্ণ।

সাদকাহ ও দান-খয়রাত: গরিব-দুঃখীদের সাহায্য করা এবং দান-খয়রাত করা রমজানের জন্য মানসিক প্রস্তুতির একটি অংশ।

শরীরিক প্রস্তুতি: সুস্থ থাকার জন্য স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া, পানির পরিমাণ বাড়ানো এবং শারীরিক সক্ষমতা ধরে রাখার জন্য পর্যাপ্ত বিশ্রাম নেওয়া।

রমজানের পরিকল্পনা: রমজানকে সর্বোত্তমভাবে কাজে লাগানোর জন্য পরিকল্পনা করা, যেমন—ইফতার ও সেহরির প্রস্তুতি, তারাবিহর অভ্যাস গড়ে তোলা এবং রমজানের সময়সূচি নির্ধারণ করা।

আমাদের করণীয়:
শবে বরাত শুধুমাত্র ইবাদতের রাত নয়, এটি আত্মশুদ্ধিরও রাত। অতীত জীবনের পাপের জন্য অনুশোচনা করা, ভবিষ্যতে ভালো কাজ করার সংকল্প গ্রহণ করা এবং সমাজের প্রতি দায়িত্বশীলতা বাড়ানোর জন্য এই রাত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

এছাড়া, আত্মীয়স্বজনদের খোঁজ নেওয়া, দুঃস্থদের সাহায্য করা এবং সমাজের কল্যাণমূলক কাজে অংশ নেওয়া শবে বরাতের শিক্ষা হতে পারে। ইসলাম ধর্মে আত্মশুদ্ধির পাশাপাশি সামাজিক কল্যাণকেও গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, যা এই রাতে বিশেষভাবে অনুশীলন করা যেতে পারে।

শবে বরাত আমাদের জীবনে আত্মশুদ্ধির এক মহিমান্বিত সুযোগ এনে দেয়। ২০২৫ সালের শবে বরাত আমাদের জন্য যেন প্রকৃত তওবা, ক্ষমাপ্রার্থনা এবং আত্মার পরিশুদ্ধির মাধ্যম হয়। এই রাতের বরকত ও শিক্ষা যেন আমাদের জীবনকে আলোকিত করে এবং আমাদের সমাজকে কল্যাণের পথে এগিয়ে নিয়ে যায়।

লেখক: মোহাম্মদ ছৈয়দুল আলম, সাংবাদিক ও গবেষক।

লেখকের অন্যান্য লেখা:
বসন্ত উৎসব, বইমেলা ও ভালোবাসার দিন, একই দিনে তিন উৎসব

দৈনিক পূর্বকোণ: চার দশকের নির্ভীক পথচলা ও নামকরণের গল্প

ভোটার তালিকা হালনাগাদ: দায়সারা উদ্যোগে গণতন্ত্র ও আইনগত প্রশ্ন

তৈলারদ্বীপ সেতু টোলমুক্ত প্রসঙ্গ | মোহাম্মদ ছৈয়দুল আলম
বাঁশখালীর খাল ও ছড়াগুলো মুক্ত করা জরুরি | মোহাম্মদ ছৈয়দুল আলম
হোল্ডিং নাম্বার ও ট্যাক্স আদায়ের নামে বাণিজ্য বন্ধ করুন


[প্রিয় পাঠক, পাবলিক রিঅ্যাকশনের প্রায় প্রতিটি বিভাগে আপনিও লিখতে পারেন। আপনার অনুভূতির কথা আমাদের লিখে পাঠান। ছবিসহ মেইল করুন opinion2mail@gmail.com এই ঠিকানায়। যে কোনো খবর, ভ্রমণ, আড্ডা, গল্প, স্মৃতিচারণসহ যে কোনো বিষয়ে লিখে পাঠাতে পারেন। পাঠকের লেখা আমাদের কাছে সবসময়ই গুরুত্বপূর্ণ।]