ভোটার তালিকা হালনাগাদ একটি সাংবিধানিক ও আইনগত প্রক্রিয়া, যা নির্বাচনের স্বচ্ছতা, গ্রহণযোগ্যতা এবং সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক অধিকার নিশ্চিত করতে সহায়তা করে। কিন্তু চট্টগ্রামে এবারের ভোটার তালিকা হালনাগাদ কার্যক্রমের গাফিলতির কারণে প্রশ্ন উঠেছে, এই প্রক্রিয়া কতটা কার্যকরভাবে সম্পন্ন হয়েছে। তথ্য সংগ্রহকারীদের দায়িত্বজ্ঞানহীনতা, নাগরিকদের অভিযোগ ও নির্বাচন কমিশনের বক্তব্যের মধ্যে বিস্তর ফারাক রয়েছে।
আইনগত বাধ্যবাধকতা ও বাস্তবতা
ডিজিটাল বৈষম্য ও নাগরিক অসুবিধা
নাগরিকদের অভিযোগ ও সমাধানের উপায়
তথ্য সংরক্ষণ ও যাচাই প্রক্রিয়া
ভোটার বৃদ্ধি: অনিয়ম নাকি বাস্তবতা?
গণতান্ত্রিক শুদ্ধাচার ও কমিশনের করণীয়
সরকার ও নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব জনগণের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা, যা সংবিধানের ৩১ ও ১২২ অনুচ্ছেদে নিশ্চিত করা হয়েছে। প্রত্যেক যোগ্য নাগরিকের ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে তথ্য সংগ্রহকারীদের যথাযথভাবে বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটারদের তালিকাভুক্ত করার কথা। অথচ অভিযোগ উঠেছে, অনেক স্থানে তারা যাননি, বরং কেবল মাইকিং করে কিংবা দেয়ালে যোগাযোগের নম্বর লিখে দায়সারা দায়িত্ব পালন করেছেন। এই ধরনের গাফিলতি নির্বাচন কমিশন আইন, ২০০৯ এবং ভোটার তালিকা আইন, ১৯৯৭-এর স্পষ্ট লঙ্ঘন।
চট্টগ্রাম জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা বশির আহমেদ জানিয়েছেন, অনলাইনে আবেদন করার সুযোগ রয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, দেশে এখনও এমন বহু মানুষ রয়েছেন, যাদের ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহারের সুযোগ সীমিত। ইন্টারনেট সুবিধাবঞ্চিত বা প্রযুক্তি বিষয়ে অজ্ঞ অনেক নাগরিকের জন্য এই পদ্ধতি বাস্তবায়ন কতটা কার্যকর হবে, সে বিষয়েও কোনো সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়নি।
অনেক ভোটার অভিযোগ করেছেন, তথ্য সংগ্রহকারীরা তাদের বাড়িতে আসেননি, ফলে তারা তালিকাভুক্ত হতে পারেননি। বিশেষ কওে চট্টগ্রাম নগরীর বায়েজিদ, অক্সিজেন, বাকলিয়া, নন্দনকানন, হালিশহর, পাহাড়তলী এলাকার অনেক বাসিন্দা এ ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন। নির্বাচন কমিশনের উচিত নাগরিকদের অভিযোগের একটি নির্দিষ্ট ফোরাম তৈরি করা, যেখানে তারা তাদের তথ্য হালনাগাদ সম্পর্কিত সমস্যার সমাধান পাবেন। এ ছাড়া, স্থানীয় প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে সচেতনতামূলক প্রচারণা চালিয়ে ভোটার তালিকা হালনাগাদের কার্যক্রমকে আরও স্বচ্ছ ও কার্যকর করা যেতে পারে।
নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুসারে, এবারের চট্টগ্রাম জুড়ে হালনাগাদে ২ লাখ ৫৬ হাজার ৯৩৫ জন নতুন ভোটার তালিকাভুক্ত হয়েছেন। অন্যদিকে, ৬০ হাজার ৪৮৫ জন মৃত ভোটারের নাম তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এই প্রক্রিয়াটির যথার্থতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েই যায়, কারণ বেশ কয়েকটি ওয়ার্ডে সরাসরি তথ্য সংগ্রহকারীদের উপস্থিতি না থাকার অভিযোগ উঠেছে। এটি নির্বাচন কমিশনের পরিচালনা নীতিমালার সঙ্গে সাংঘর্ষিক এবং ভবিষ্যৎ নির্বাচনের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে।
চট্টগ্রাম জেলার সবচেয়ে বেশি নতুন ভোটার তালিকাভুক্ত হয়েছেন বাঁশখালী উপজেলায়, যেখানে ২২,৯৬৬ জন নতুন আবেদন করেছেন। এ ছাড়া, লোহাগাড়া, আনোয়ারা, হাটহাজারী, বোয়ালখালীসহ বিভিন্ন উপজেলায় ভোটার সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে এই বৃদ্ধি স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার অংশ, নাকি কোনো অনিয়মের ফলাফল, তা নিরপেক্ষভাবে তদন্ত করা প্রয়োজন।
ভোটার তালিকা একটি রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ভিত্তি। এতে গাফিলতি থাকা মানে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার প্রতি অবহেলা এবং নির্বাচন কমিশনের প্রতি জনআস্থার সংকট তৈরি করা। তাই নির্বাচন কমিশনকে আরও স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও দায়িত্বশীলতার সঙ্গে হালনাগাদ কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। একই সঙ্গে, সংবিধান এবং প্রচলিত আইন মেনে এই প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন করতে হবে।
জনগণের আস্থা অর্জনের জন্য নির্বাচন কমিশনের উচিত, তথ্য সংগ্রহকারীদের আরও প্রশিক্ষিত ও দায়িত্বশীল করা এবং তাদের কর্মকা- পর্যবেক্ষণে কঠোর আইনগত পদক্ষেপ নেওয়া। একই সঙ্গে, একটি নির্দিষ্ট অভিযোগ গ্রহণ ও সমাধান কেন্দ্র চালু করা যেতে পারে, যেখানে নাগরিকরা সরাসরি তাদের সমস্যার সমাধান পাবেন। গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি হলো ভোটাধিকার, যা নিশ্চিত করতে হলে দায়িত্বশীলতার কোনো বিকল্প নেই।
লেখক: মোহাম্মদ ছৈয়দুল আলম, বাঁশখালী, চট্টগ্রাম।
লেখকের অন্যান্য লেখা:
তৈলারদ্বীপ সেতু টোলমুক্ত প্রসঙ্গ | মোহাম্মদ ছৈয়দুল আলম
বাঁশখালীর খাল ও ছড়াগুলো মুক্ত করা জরুরি | মোহাম্মদ ছৈয়দুল আলম
হোল্ডিং নাম্বার ও ট্যাক্স আদায়ের নামে বাণিজ্য বন্ধ করুন
[প্রিয় পাঠক, পাবলিক রিঅ্যাকশনের প্রায় প্রতিটি বিভাগে আপনিও লিখতে পারেন। আপনার অনুভূতির কথা আমাদের লিখে পাঠান। ছবিসহ মেইল করুন opinion2mail@gmail.com এই ঠিকানায়। যে কোনো খবর, ভ্রমণ, আড্ডা, গল্প, স্মৃতিচারণসহ যে কোনো বিষয়ে লিখে পাঠাতে পারেন। পাঠকের লেখা আমাদের কাছে সবসময়ই গুরুত্বপূর্ণ।]