জাহান আরা খাতুনের নিবন্ধ ‘রবীন্দ্রনাথের ধর্ম’

:: জাহান আরা খাতুন ::
প্রকাশ: ২ দিন আগে

রবীন্দ্র প্রতিভার বিস্ময়কর জাদুস্পর্শে বাংলা সাহিত্যে সোনার ফসল ফলেছে। ঐশ্বর্যে, মাধুর্যে,বিভায়, আভায়,দীপ্তিতে সর্বোপরি শিল্প -সফল সুবিশাল ব্যাপ্তিতে বাংলা সাহিত্য পেয়েছে অনিন্দ্যকান্তি।
বিশ্বসাহিত্যের আসরেও লাভ করেছে হিরণ্ময় আসন।
বিচিত্র রাগে রবীন্দ্র প্রতিভা বিকশিত হয়ে বাংলা সাহিত্যকে অমূল্য মণি-কাঞ্চনে বৈভব- দীপ্ত করেছে। এর মাঝে তাঁর নিতল ধর্মানুভূতি অন্যতম।
এবার আমরা সাম্প্রদায়িক সংকীর্ণতার সীমিত গণ্ডি ছাড়িয়ে রবীন্দ্রনাথের বিশিষ্ট ধর্ম চিন্তা বিশেষ করে ইসলাম বিষয়ে তাঁর অকুণ্ঠ শ্রদ্ধা বোধ বিষয়ে আলোকপাত করার চেষ্টা করব।
রবীন্দ্রনাথের ধর্ম বিশ্ব- মানবধর্ম। নিষ্কলুষ মনুষ্যত্বই এ ধর্মের মূল এবং একমাত্র সুর । তাঁর মানবিক মনস্বিতা গভীর জীবনচিন্তন, ভাব- মাধুর্য,নিতল অনুভূতি, দর্শন ইত্যাদি মণিকাঞ্চনযোগে স্বাতন্ত্র্যে দীপ্র এবং শিল্পের অমিত ব্যঞ্জনায় ভাস্বর। ভারতবর্ষের জাতীয় সংগীত হিসাবে বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বন্দেমাতরম ‘এর অনুপযুক্ততা স্পষ্ট ভাষায় ব্যক্ত করে সমাজমর্মী রবীন্দ্রনাথ হিন্দু সমাজের বিরাগভাজন হয়েছিলেন। এ সংগীতের প্রতি মুসলমানদের শীতল মনোভাব, আপত্তি হৃদয়ধর্মী কবি গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। সম্ভবত এক্ষেত্রে তিনিই একমাত্র হিন্দু চিন্তাবিদ।
প্রকৃতার্থে সত্য, সুন্দর কল্যাণ তথা সার্বিক সামঞ্জস্যের পথ নির্দেশের মাধ্যমে সুদৃঢ় সামাজিক ভিত্তির উপর মনুষ্যত্বকে প্রতিষ্ঠিত করাই হল রবীন্দ্রনাথের ধর্ম। জোড়াসাঁকো থেকে শান্তিনিকেতনে আসার পর রবীন্দ্রনাথের ধর্মীয় চিন্তা এক বিশিষ্ট রূপ পরিগ্রহ করে। পরমতসহিষ্ণুতার অমিয় ধারাসিঞ্চনে তখন রবীন্দ্র -মানস প্রবলভাবে প্রতিনিয়তই অভিসিঞ্চিত হতে থাকে । “সেই কারণেই আমরা দেখতে পাই শান্তিনিকেতনের উপাসনা গৃহে পৃথিবীর বিভিন্ন ধর্মগুরুদের জীবন নিয়ে আলোচনা হয়েছে সঙ্গীত সহযোগে।
বুদ্ধদেব সম্পর্কে তাঁর লেখা ‘হিংসায় উন্মত্ত পৃথ্বী ‘এবং যীশু খ্রীষ্ট সম্পর্কে ‘একদিন যারা মেরেছিল তারে গিয়ে’_ গান দুটি তাঁদের জন্মদিনে মন্দিরে গাওয়া হতো।
গুরু নানকের জন্মদিনে’ গগনের থালে রবিচন্দ্র দীপক জ্বলে:ও গাইতে শুনেছি। শুধু তাই নয়, হযরত মুহম্মদের জন্মদিনে মন্দিরের অনুষ্ঠানে ‘কোন আলোতে প্রাণের প্রদীপ জ্বালিয়ে ধরায় আসো ‘ গাওয়া হত। তাছাড়া রবীন্দ্রনাথ ইরানের সুফিদের দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত হন। লালন ফকির, সিরাজ সাঁই প্রমুখ সব সাধক গাইয়েরা রবীন্দ্রনাথের অতি আপনজন ছিলেন । “১
তাঁর ধর্ম কখনোই একান্তভাবে শাস্ত্র নির্ভর নয়। জীবনাচরণসহ বিচিত্র বিপুল রচনাবৈভবে তাঁর অনন্য ধর্মানুভূতি দিব্যরাগে ভাষায়িত হয়েছে।
পৌত্তলিকতায় কবির সমর্থন ছিলনা। মাটি বা পাথরের বিগ্রহ উপাসনায় তাঁর মন বসে নি। প্রচলিত হিন্দুত্বের আচার বিচার কবিকে বৃত্তাবদ্ধ করতে পারেনি। ফলে আপন ধর্মের নানা অসঙ্গতিও তাঁরল নিবিড় অনুধ্যান এড়াতে পারেনি ।
হেমন্তবালা দেবীকে লিখেছেন, (১৪নং পত্র) “আমি আজন্ম ব্রাত্য। —যে বাহ্য আচার মানুষে মানুষে ভেদ ঘটিয়ে প্রাচীর তুলে বেড়ায়, তাকে বর্জন করে নাস্তিক অধার্মিক পদবী নিতে আমার কোনো সংঙ্কোচ নেই। —আমাকে ভিন্ন জাতের মানুষ বলেই জেনো, আমি তোমাদের ত্যাজ্য। ” ২
রবীন্দ্রনাথের বিশ্বানুভূতি ও মানবিকতা নয়নের মাঝে নয়নের পাতার মতই অবিচ্ছেদ্য।
‘ঘরে বাইরে’ ‘উপন্যাসে নিখিলেশ চরিত্রের অন্তরালে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথই কথা বলেছেন, “কেবল গরুই যদি অবধ্য হয় আর মোষ যদি অবধ্য না হয় তবে ওটা ধর্ম নয়, ওটা অন্ধ সংস্কার। ” ৩
শিলাইদহে এসে রবীন্দ্রনাথ নায়েবের প্রবল আপত্তিসত্ত্বেও জাত প্রথা তথা আসনের জাতিভেদ ভেঙে দেন । হরিজন, ব্রাহ্মণ, মুসলমানের বসারজন্য আর আলাদা আলাদা আসন থাকবে না। একই মর্যাদায় সবার জন্য এক আসন করতে হবে এ হুকুমে কবি অনড় ছিলেন।
মানবমুক্তির চিন্তানায়ক রবীন্দ্রনাথের একান্ত কাম্য আত্মিক সমুন্নতি, বোধের উৎকর্ষ । নিরপেক্ষ বিবেচনায় নানা বিষয়ে হিন্দুদের দায়ী করে মুসলমানদের সমর্থন করতেও তিনি কুণ্ঠিত হননি।
১৩১২ সনে বিজয়ার এক অনুষ্ঠানের ভাষণে তিনি শ্রোতাদের চাষি,রাখাল, পূজার্থী সকলকে সম্ভাষণের আবাহন জানান । এক পর্যায়ে কবি বলেন,” অস্ত সূর্যেরদিকে মুখ ফিরাইয়া যে মুসলমান নামাজ পড়িয়া উঠিয়াছে তাহাকে সম্ভাষণ কর।”৪
সার্বজনীন দৃষ্টিভঙির এই অনিঃশেষ প্রজ্ঞা মননশীল শিল্পীর মহত্তম চেতনায় উদ্ভাসিত, একথা বলাই বাহুল্য ।
রবীন্দ্রতথ্যবিশারদ অমিতাভ চৌধুরীর ‘ইসলাম ও রবীন্দ্রনাথ’ গ্রন্থ থেকে জানা যায়, ১৯৩৩ সালে বোম্বেতে পয়গম্বর দিবস উদযাপন অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বিচারপতি মির্জা আলী আকবর খাঁ। এই সভায় রবীন্দ্রনাথের পাঠানো বাণীটি পাঠ করেন শ্রীমতি সরোজিনী নাইডু। ইসলামপ্রশস্তিপূর্ণ সেই বাণীর একটি উক্তি,”জগতে যে সামান্য কয়েকটি ধর্ম আছে, ইসলাম ধর্ম তাদেরই অন্যতম । ” ৫
১৯৩৪ সালে মিলাদুন্নবি দিবসের বাণীতেও একই কথা শোনা যায়।
১৯৩৬ সালে নয়া দিল্লির জামে মসজিদ থেকে প্রকাশিত পত্রিকার পয়গম্বর সংখ্যার শুভেচছাবার্তায় রবীন্দ্রনাথ লেখেন, “যিনি বিশ্বের মহত্তমদের অন্যতম, সেই পবিত্র পয়গম্বর হযরত মুহম্মদের উদ্দেশে আমি আমার অন্তরের গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করি । মানুুষের ইতিহাসে এক নতুন সম্ভাবনাময় জীবনীশক্তির সঞ্চার করেছিলেন পয়গম্বর। এনেছিলেন নিখাদ,শুদ্ধ ধর্মাচরণের আদর্শ। সর্বান্তকরণে প্রার্থনা করি পবিত্র পয়গম্বরের প্রদর্শিত পথ যারা অনুসরণ করছেন,আধুনিক ভারতবর্ষের সুসভ্য ইতিহাস রচনা করে তাঁরা যেন জীবন সম্পর্কে তাদের গভীর আস্থা এবং পয়গম্বরপ্রদত্ত শিক্ষাকে যথাযথ মর্যাদা দেন। “৬
ইসলাম ধর্ম বিষয়ে এমন স্বতঃস্ফূর্ত,অনাবিল সত্য উচ্চারণ আর কোনো অমুসলিম করেছেন কিনা আমাদের জানা নেই।
আসলে জীবনে ও সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন সম্পূর্ণ মানবিক। পরধর্মপ্রীতির হিরণ্ময় আলোকে তাঁর ধর্মবোধও তাই চিরোজ্জ্বল ।

তথ্যসূত্র
১. অমিতাভ চৌধুরী, একত্রে রবীন্দ্রনাথ, পৃ ৩৭৫-৩৭৬, কলকাতা, ৭৩।
২. সাদ কামালী, রবীন্দ্রনাথ :অন্য এক মানুষ, পৃ ৭০, ঢাকা, ২০১১।
৩. সাদ কামালী,পূর্বোক্ত, পৃ ৭০।
৪. আবুল ফজল, রবীন্দ্র -প্রসঙ্গ পৃ৩৭, ঢাকা, ১৯৯১।
৫. অমিতাভ চৌধুরী, পূর্বোক্ত, পৃ ৭৬।
৬. অমিতাভ চৌধুরী, পূর্বোক্ত, পৃ ৩৭।

 

লেখক: জাহান আরা খাতুন, অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ, হবিগঞ্জ সরকারি মহিলা কলেজ, হবিগঞ্জ।


[প্রিয় পাঠক, পাবলিক রিঅ্যাকশনের প্রায় প্রতিটি বিভাগে আপনিও লিখতে পারেন। আপনার অনুভূতির কথা আমাদের লিখে পাঠান। ছবিসহ মেইল করুন opinion2mail@gmail.com এই ঠিকানায়। যে কোনো খবর, ভ্রমণ, আড্ডা, গল্প, স্মৃতিচারণসহ যে কোনো বিষয়ে লিখে পাঠাতে পারেন। পাঠকের লেখা আমাদের কাছে সবসময়ই গুরুত্বপূর্ণ।]